বিষয়ে আসার আগে ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখবো। চিকিৎসকের দায়িত্ব বোঝাতে গিয়ে অ্যামব্রোস প্যারি বলেছিলেন, ‘Cure occasionally, relieve often, console always’। এই সান্ত্বনা দেওয়ার চিকিৎসার নাম প্লাসিবো। সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ পাওয়া মুশকিল। তবে বোঝার খাতিরে ‘মিছিমিছি ওষুধ’ ধরে নেওয়া যায়। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্লাসিবোর আত্মপ্রকাশ। ১৮১১ সালে প্লাসিবো চিকিৎসার সংজ্ঞায় বলা হয়, “Any medicine adopted more to please than to benefit the patient”
ইতিহাসের পাতায় বিখ্যাত বা কুখ্যাত প্লাসিবো চিকিৎসার অন্যতম উদাহরণ পারকিন্স ট্রাক্টর। ১৭৯৫-৯৬ সালে এলিশা পারকিন্স ছুঁচোলো মুখওয়ালা দুটি তিন ইঞ্চি ধাতব রড নিয়ে এই পারকিন্স ট্রাক্টর বানান। যদিও সেটা স্টিলের তৈরি ছিল তবু পারকিন্স প্রচার করতেন সেটা অজানা কোনও ধাতুসংকরের তৈরি। তিনি দাবী করতে শুরু করলেন কুড়ি মিনিট এই ট্রাক্টর চেপে রাখলে মাথার ব্যথা, বাতের ব্যথা সহ শরীরের বিভিন্ন ব্যথার উপশম হয়। কারণ হিসেবে বললেন, এই ধাতব যন্ত্র দিয়ে শরীরের বিভিন্ন খারাপ বৈদ্যুতিক তরল বের হয়ে আসে।
কী আশ্চর্য!! পারকিন্সের দাবী মিলে গেল। কোপেনহেগেন ছাড়িয়ে গোটা ডেনমার্কে তাঁর অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারের খবর ছড়িয়ে গেল। প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ তাঁর ট্রাক্টরের ব্যবহারে সুফল পেলেন। তাঁদের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনও ছিলেন।
এলিশার ছেলে বেঞ্জামিন এই ট্রাক্টর লন্ডনে নিয়ে এলেন। ১৭৯৮-তে ফলাও করে বই ছাপা হ’ল। ১৭৯৯ সালে রমরমিয়ে বিজ্ঞাপন বেরোলো। সেসময় যাঁরাই এর বিরোধিতা করেছেন তাঁদের ‘নাক উঁচু বিরোধী’ বা ‘উদ্ধত’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদিও ট্রাক্টর ব্যবহারের পেছনে কোনও বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা না পাওয়া যাওয়ায় তৎকালীন মূলধারার চিকিৎসক সমাজ এই ট্রাক্টরের ব্যবহার মেনে নেন নি। অবশ্য তাতে কী আসে যায়? সাধারণ মানুষ যেখানে চোখের সামনে সুফল পাচ্ছে সেখানে গুটিকয়েক মানুষের বিরোধিতার দাম কতটুকু? কাজেই, পারকিন্স ট্রাক্টর ঝড়ের বেগে বিক্রি হওয়া শুরু হ’ল। দামও ছিল যথেষ্ট উঁচুর দিকে। তৎকালীন হিসেবে পাঁচ গিনি।
অবশেষে, পারকিন্স ট্রাক্টরের জালিয়াতি ফাঁস করলেন ডা. জন হেগ্রাথ। রোগীদের না জানিয়ে কাঠের তৈরি একইরকম ট্রাক্টর পাঁচজন বাতের রোগীর ওপর প্রয়োগ করলেন। এবং, সন্দেহ সত্যি করে তাঁদের মধ্যে চারজনই সুফল পাওয়ার দাবী করলেন। পরিষ্কার বোঝা গেল অজানা ধাতুসংকর নয়, আসলে খেলাটা প্লাসিবোর। আধুনিক বিজ্ঞানের আলোয় ভাবলে, খুব সম্ভবত পুরোটাই ‘গেট কন্ট্রোল থিওরি অফ পেইন’ এবং মনস্তত্বের ওপরে প্রভাব বিস্তার দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। যেখানে বলা হয়, স্পর্শ বা অন্য কোনও মনোরম অনুভূতি দ্বারা ব্যাথায় সংবেদনশীল নার্ভগুলোর দরজা বন্ধ করে দিলে ওই দরজা দিয়ে ব্যথার কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র অব্দি পৌঁছোনো বন্ধ হয়ে যায়। ফলত, আমরা ব্যথার অনুভূতি কিছুক্ষণ ভুলে যাই। আপনি ভাবতে পারেন, বেশ তো! তাই বা হ’লে ক্ষতি কী? হ্যাঁ। ক্ষতি আছে। কারণ ব্যথাটা সামান্য চিমটি কাটা বা ছোট্ট পিঁপড়ের কামড় হলে ঠিক আছে কিন্তু যদি ক্যান্সারের ব্যথা, হাড় ভাঙার ব্যথা, হার্ট অ্যাটাকের ব্যথা কিংবা অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা হয়? তখন কিন্তু এই মিছিমিছি ওষুধের ব্যবহার আপনাকে সাময়িক ভুলিয়ে রাখলেও তাতে রোগের মূল কারণ অব্দি পৌঁছোনো হয় না। আসল রোগ গোকুলে বাড়তেই থাকে। সেসব ক্ষেত্রে মিছিমিছি ওষুধের সাময়িক মানসিক প্রবোধ প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে, দুর্ভাগ্য এটাই। পারকিন্স তাঁর ট্রাক্টরের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে রক্ত-আমাশা, গলার সংক্রমণ ও ইয়োলো-ফিভারেও অনুরূপ মিছিমিছি ওষুধ প্রবর্তন করেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাঁর নিজের মৃত্যুও ইয়োলো-ফিভারেই হয়। মৃত্যুকালে তাঁর ভিনিগার আর সোডা দিয়ে তৈরি মিছিমিছি ওষুধ কাজে আসেনি বলাই বাহুল্য। ১৯০৩ সালে রিচার্ড ক্যাবট প্লাসিবো নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন, “I haven’t yet found any case in which a lie doesn’t do more harm than good”
আবার ইতিহাসের দিকে ফিরে যাবো। ষোড়শ শতকের ইউরোপে ক্যাথলিক চার্চে জীন, ভূত, ডাইনি বা অন্যান্য খারাপ শক্তিতে পাওয়া মানুষকে পবিত্র জল বা ক্রুশের দ্বারা চিকিৎসা করা হ’ত। অদ্ভুতভাবে তাঁদের অনেকেই ক্রুশ দেখলেই ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে উঠতেন। এরপর আর ক্রুশের প্রভাব প্রমাণ না হয়ে পারে? এখানেও বহু বহুদিন বাদে প্রমাণ হয় মনস্তত্বের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারলে শুধু ক্রুশ বা পবিত্র জল নয় অন্যান্য সাধারণ জিনিস ব্যবহারেও ‘দৈত্যে পাওয়া’ মানুষ একইরকম উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ, সেই প্লাসিবো। আজ আরও চারশো বছর পেরিয়ে এখনও সর্ষে ছুঁড়ে, ঝাঁটা পিটিয়ে ডাইনি তাড়ানোর ঘটনা শোনা যায়। খুব গৌরবের ব্যাপার নয়। তাই না?
মিছিমিছি ওষুধ খাইয়ে রোগীকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা বিংশ শতাব্দীর শেষ অব্দি রমরমিয়ে চলেছে। অথচ, তারও বহু বহু বছর আগে ১৭৫২ সালে বিজ্ঞানী ডা. জেমস লিন্ড পৃথিবীকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে প্রমাণ খুঁজতে হয়। লিন্ডের সময়ে স্কার্ভি একটি মারাত্মক রোগ। সমুদ্রযাত্রীরা অবধারিতভাবে এ রোগের কবলে পড়তেন। প্রথমে সাধারণ দুর্বলতা। তারপর, চামড়া আর মাড়ি থেকে রক্তপাত। ধীরে তীব্র হাড়ের ব্যথা, সমগ্র দেহ থেকে রক্তপাত, পেশীর ক্ষয় এবং যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। বিভিন্নজন নানারকম প্রতিষেধকের কথা বলেন কিন্তু সঠিক সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না। ডা. লিন্ড বারো জন নাবিককে ছ’ভাগ করে ১৫ দিন ধরে ছ’রকম জিনিস খাওয়ান। ১. আপেল জুস ২. ২৫ ফোঁটা সালফিউরিক অ্যাসিড ৩. ছ’চামচ ভিনিগার ৪. সমুদ্রের জল ৫. দুটো কমলালেবু, একটি পাতিলেবু ৬. বিভিন্ন মশলা আর বার্লি। তুল্যমূল্য বিচারে উঠে আসে পাঁচ নম্বর খাবার এবং আংশিকভাবে এক নম্বর খাবার স্কার্ভি প্রতিরোধ করতে সক্ষম। পরে জানা যায় আসলে ভিটামিন সি-এর অভাবজনিত কারণেই স্কার্ভি রোগ হয়। এবং, টাটকা টক ফল ভিটামিন সি-তে ভরপুর। আবারও, মূল ব্যাপার কারও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা মনে হওয়া নয়। পরীক্ষার নিরপেক্ষতা আর বিজ্ঞানমনস্কতা ছাড়া প্রকৃত নিরাময় অসম্ভব।
চলুন, এবার সোজা বর্তমানের দুনিয়ায় নেমে আসি। সাপের কামড়। অধিকাংশ সাপই বিষহীন এবং বিষধর সাপেরও অনেক কামড় বিষহীন (ড্রাই বাইট)। সেসব ক্ষেত্রে আপনি ওঝার ফুঁকই দিন কিংবা অশ্বডিম্বের ওমলেট, কাজ হতে বাধ্য। আপনার বিজ্ঞানমনস্কতা না থাকলে আপনি বিশ্বাস করবেন ওঝার ফুঁকেই বিষ নেমে গেছে। কিন্তু, যদি কামড়ে বিষ থাকে?
ধরে নেওয়া হয়, প্রায় ৮০% ক্রনিক শারীরিক কষ্ট শরীর নিজেই সারায়। বহমান নদীর নিজের আবর্জনা মুছে ফেলার মতো। সেসব ক্ষেত্রে মিছিমিছি ওষুধ আপনাকে আপাতদৃষ্টিতে চুড়ান্ত নিরাময় দেবে। কিন্তু, যদি রোগটি সত্যিকারের গুরুতর হয়? আপনার পক্ষে তো সেটা বোঝাও মুশকিল। সত্যিকারের গুরুতর রোগে, আপৎকালীন অবস্থায় কিন্তু মিছিমিছি ওষুধের বরাভয় থাকবে না। কাজেই আপনার হাতের ওষুধটি সত্যিই কার্যকরী কিনা, সেটি বিজ্ঞানের আবেগহীন কষ্টিপাথরে যাচাই করা কিনা বুঝে নেওয়াটা জরুরি।
আরও, একটি সহজ উদাহরণ দিই। ধরা যাক, আপনি রোগা হওয়ার ওষুধ চাইলেন। আমি আপনাকে একটি করে চিনির দানা (‘মার্কারিকাম চিনিবাম’ নাম দিয়ে) রোজ খালিপেটে খেতে বললাম। সাথে রোজ দু’শ স্কিপিং আর আধঘন্টা সাঁতার আর খাবার পরিবর্তনের নিদান দিলাম। আপনি একমাস বাদে দেখলেন আপনার তিন কেজি ওজন কমেছে। বিজ্ঞানমনস্কতা না থাকলে আপনি বুঝতেই পারবেন না আসলে সবটাই জীবনযাত্রা পরিবর্তনের অবদান। আপনার দেখার চোখ থাকাটা জরুরি।
বিভিন্ন উন্নত দেশে নিষিদ্ধ বা প্রায় অবলুপ্ত হলেও আজও এদেশে অপ্রমানিত অণুহীন অ্যালকোহল ফোঁটা বা পুরিয়া-চিকিৎসা রমরমিয়ে চলে। সেগুলো কীভাবে কাজ করে কেউ জানে না। বরং, তা প্রথাগত বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ বিরোধী। শুধু সবাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দিব্যি জানেন ওসব খেয়েই ‘সেজোমাসির ছোট ননদের আঁচিল ঝরে গেছিল’। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যে বিজ্ঞান নয় সেটা স্পষ্ট বুঝে নেওয়া দরকার। ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিজ্ঞানের মাপকাঠি হলে তাবিজ-মাদুলি সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান। এমনকি খুব বিখ্যাত মানুষের উদাহরণও একটি অপবিজ্ঞানকে ‘বিজ্ঞান’ বানায় না।
জর্জ ওয়াশিংটনের নাম দিয়ে পারকিন্স ট্রাক্টর ‘বিজ্ঞান’ হয়ে যায় নি। ব্যবহারকারীর নামের ওজন দিয়ে বিজ্ঞানের বিচার হাস্যকর। সেদিন যেসব মূলধারার চিকিৎসক পারকিন্স ট্রাক্টরের বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন তাঁদের ‘উদ্ধত, বিরোধীপক্ষ’ বলে দেগে দেওয়া হয়। সে ট্র্যাডিশন আজও অব্যাহত। যদিও এ যুগের পারকিন্সদের নিজেদের সত্যিকারের গুরুতর অসুখে মডার্ন মেডিসিনের দ্বারস্থ হতেই দেখা যায়। বিপদে পড়েন সেইসব মানুষ যাঁরা সরল বিশ্বাসে প্লাসিবো চিনির গোল্লায় ভরসা রাখেন। অজ্ঞানতার বিপক্ষে বলতে গেলেই অন্ধবিশ্বাসীদের ঝাঁকে ঝাঁকে বক্রোক্তি ছুটে আসে। তবে আশার কথা, কুৎসা দিয়ে কোনোদিন সত্যকে ঢাকা যায়নি। আজও যায় না।
ভালো লেখা।
খুব সহজবোধ্য লেখা। এইসব লেখার প্রচার খুব প্রয়োজন। আমাদের মতন দেশে। যেখানে IT প্রফেশনাল দের T-Shirt এর হাতের তলা দিয়ে তাবিজ কবজ বেরিয়ে পড়ে।