১৮৯৫ সাল। জার্মানির উর্জবার্গ শহর আসন্ন বড়দিন উপলক্ষ্যে সেজে উঠেছে। চারিদিকে উৎসবের আমেজ। আর মাত্র তিনদিন..
এ সময় প্রিয়জনকে উপহার দিতে হয়। অথচ বছর পঞ্চাশের ফিজিক্স প্রফেসরের প্রায় কোনও বছরই আর পাঁচজনের মতো উৎসবের আনন্দ উপভোগ করা হয়ে ওঠে না। ল্যাবের অন্ধকার ঘরেই দিনের পর দিন কেটে যায়। শেষ কয়েক সপ্তাহ তো প্রায় পাগলের মতো নাওয়া-খাওয়া ভুলে ল্যাবে পড়ে থেকেছেন। স্ত্রী ঈষৎ অনুযোগ করলেও মেনে নিয়েছেন। কাজপাগল মানুষটিকে তিনি ভালোভাবেই চেনেন। এই চূড়ান্ত ব্যস্ততা মানে নতুন কোনও আবিষ্কারের দিন সমাগত! এই তো ক’দিন আগেই রাত করে ল্যাব থেকে ফিরে ডিনার টেবিলে উত্তেজনায় ফুটতে ফুটতে বলেছিলেন– বুঝলে অ্যানা, এবারের বড়দিনের ছুটিতে তোমার জন্য স্পেশাল গিফট থাকবে। যদি খুব ভুল না করে থাকি.. আচ্ছা থাক! সিক্রেটটা তখনই জানবে খন..
এই এক অভ্যেস! সবসময় রহস্যগুলো চেপে রাখে! এখন জিজ্ঞেস করেও লাভ নেই। কাজ পুরো না হওয়া অব্দি উত্তর মিলবে না। তারপর তো পাঁচদিন বাড়িমুখোই হয়নি। ল্যাবে সারাদিন কী করছে কে জানে! জানলার ধারে বসে এইসব সাতপাঁচ ভাবছিলেন অ্যানা বার্থা লাডউইগ। হঠাৎ, দরজায় স্বামীর গলা পাওয়া গেল– জলদি রেডি হয়ে নাও অ্যানা..
– কেন? কী ব্যাপার?
– ল্যাবে যাবে আমার সাথে..
– এই ক্রীসমাসে কোথায় ঘুরতে যাওয়ার কথা বলবে, সেসব না.. শেষমেশ ল্যাব!
– আরে চলো, চলো.. গিফটটা তো ওখানেই রাখা!
পলক ফেলতে না ফেলতে পরবর্তী কয়েক ঘন্টা কেটে গেল। ল্যাবের অন্ধকার ঘরে স্ত্রীর আংটি পরা হাতটা নিয়ে বেরিয়াম প্লেটের সামনে রাখলেন প্রফেসর। ক্যাথোড রশ্মি নিঃসরণকারী কাচের টিউবের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল। ছিটকে বেরিয়ে এলো ইলেকট্রন! পুরো ঘটনাটা তখনও পরিষ্কার নয় অ্যানার কাছে। প্রফেসর আলো জ্বাললেন। এবং, তারপরেই চমক! বেরিয়াম প্লেটে ফুটে উঠেছে অ্যানার হাতের হাড়ের ছায়া। তাতে আংটি পরা। বিস্ময়ে হতবাক অ্যানা বলে উঠলেন-
– কী করেছো এটা! আমি তো মৃত্যুকে দেখে ফেললাম!
*
প্রফেসর উইলহেম রন্টজেন। মাস দেড়েক আগে বায়ুশূন্য টিউব নিয়ে কাজ করতে করতে আকস্মিকভাবেই এই অজানা রশ্মি আবিষ্কার করে ফেলেন। তারপর, আর পাঁচটা অজানা জিনিসের মতোই অজানা রশ্মির নাম দেন এক্স-রে। যে কাচের টিউব নিয়ে ক্যাথোড রশ্মির পরীক্ষা করছিলেন তার চারদিকে কালো কাগজ দিয়ে ঢেকে দেন। অজানা রশ্মি কালো কাগজ ভেদ করে সামনে রাখা বেরিয়াম প্লেটে আলোছায়া হয়ে ফুটে ওঠে। প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর বুঝে নিতে কষ্ট হয়নি এই রশ্মি শরীরের মধ্যেও অপেক্ষাকৃত কম ঘনত্বের কলা ভেদ করে যাবে কিন্তু হাড়ের মতো বেশি ঘনত্বের জিনিস অভেদ্য থাকবে। ফলে শরীরের মধ্যেকার বিভিন্ন বিকৃতি বাইরে থেকেই বুঝে ফেলা সম্ভব হবে। তখনও অব্দি কেটে দেখা ছাড়া এসব বোঝার কোনও উপায় ছিল না। রন্টজেন আমেরিকা ও ইউরোপের চিকিৎসক মহলে তাঁর আবিষ্কারের কথা জানালে চারিদিকে শোরগোল পড়ে গেল। ১৮৯৬ সালেই এই অজানা রশ্মির ব্যাপারে নামকরা জার্নালগুলিতে ৪৯ টি প্রবন্ধ ও ১০৪৪ টি আর্টিকেল লেখা হ’ল।
রোগ-নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে গেল। যুদ্ধে আক্রান্ত সৈনিকরা বুলেটে জখম হলে এবার আগে থেকেই বুলেটের অবস্থান জেনে নিচ্ছিলেন সার্জেন। হাড় ভেঙে যাওয়া কিংবা ভাঙা হাড় জোড়ার পরবর্তী অবস্থা বোঝা অনেক সহজ হ’ল। ডা. জন হল এডওয়ার্ড শরীরে ফুটে থাকা ছুঁচের অবস্থান জানতে এক্স-রের সাহায্য নিলেন। ১৯০১ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাকিনলে গুলিবিদ্ধ হলে তাঁর পেটে বুলেটের অবস্থান বুঝতে এক্স-রের সাহায্য নেওয়া হয়। যদিও প্রেসিডেন্টকে বাঁচানো যায় নি। বুলেটের ক্ষত বিষিয়ে গিয়ে তিনি মারা যান।
মূলত চিকিৎসা ক্ষেত্রে এক্স-রের ভূমিকার জন্য বিজ্ঞানী রন্টজেন ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। আবিষ্কারের স্বত্ত্ব তিনি নিজের কাছে রাখেন নি। মানুষের জন্য নিজের আবিষ্কার বিলিয়ে দেন।
*
যদিও বিকিরক রশ্মি নিয়ে এর আগেও কাজ হয়েছে। ১৮৬৯ সালে প্রথমবার এরকম রশ্মির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। ১৮৭৫ সালে বিজ্ঞানী উইলিয়াম মর্গান ক্রুকস টিউবের সাহায্যে বিকিরক রশ্মির পরীক্ষা করেন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফার্নান্দো স্যানফোর্ড বিকিরক রশ্মির সাহায্যে ইলেকট্রিক ফটোগ্রাফি তৈরি করেন। কিন্তু তখনও সেসব পরীক্ষাগারের বিষয় হয়েই ছিল। অধ্যাপক রন্টজেনের কৃতিত্ব এখানেই। তিনি বিজ্ঞানকে মুক্তি দেন। যে আবিষ্কার পরে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যায় সম্পূর্ণ নতুন এক দিকের সন্ধান দেবে..
হুজুগে কিছু লোকের কল্যাণে এক্স-রের অপব্যবহারও শুরু হ’ল। তখন অকারণে এক্স-রে দিয়ে ছবি তোলানোর মাতামাতি! এমনকি একটি জুতোর বিপণিকেন্দ্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া হ’ল জুতো কিনলেই বিনে পয়সায় পায়ের পাতার এক্স-রে ছবি তুলে দেওয়া হবে!
*
অন্যান্য অনেক কিছুর মতোই ভালোর আয়োজনে কালোর দিকও ছিল। বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা কিংবা থমাস এডিসন পরীক্ষাগারে বিকিরণঘটিত ক্ষতির ব্যাপারে সতর্কীকরণ দিলেন। ক্লারেন্স ম্যাডিসন ড্যালি বিজ্ঞানী এডিসনের পরীক্ষাগার-সহায়ক ছিলেন। গ্লাসব্লোয়ার হিসেবে কাজ করার সময় খালি হাতেই বিকিরক পদার্থ ধরতেন। তখনও জানা ছিল না এর ফল কতটা মারাত্মক হতে পারে। ড্যালির দু’হাতে ক্যান্সারের ঘা ছড়িয়ে পড়ল। কাঁধ থেকে কেটে বাদ দিয়েও ক্যান্সার রোধ করা গেল না। বিকিরণের বলি হয়ে তিনি মারা গেলেন। ডা. উইলিয়াম ডুডলের কাছে বুলেট ক্ষত নিয়ে এক রোগী এলে ডাক্তার নিজে আগে পুরো ব্যবস্থা ঠিক হয়েছে কিনা দেখে নিতে চান। নিজের ওপরেই এক্স-রে বিম প্রয়োগ করেন। ২১ দিন বাদে দেখা যায় মাথায় দু-ইঞ্চি চওড়া জায়গায় সব চুল ঝরে গেছে! তারপর অগুনতি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী চিকিৎসা করতে গিয়ে বিকিরণের শিকার হয়েছেন। কারো চামড়া পুড়েছে, কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন, কারো ফুসফুস কিংবা হৃৎযন্ত্রে চিরস্থায়ী ক্ষতি করে গেছে বিকিরক রশ্মি। তাঁদের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে বিজ্ঞান ক্রমশ উন্নত হয়েছে। এক্স-রের বিকিরণজনিত ক্ষতি কমেছে অনেকখানি। উন্নত মেশিন এসেছে। ফ্লুরোস্কোপির মতো নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু যাঁরা বিকিরণের ক্ষতি শিকার করে ভবিষ্যতের চলার পথ সহজ করে দিলেন তাঁদের অধিকাংশেরই নামটুকুও আমরা মনে রাখিনি। রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেরাই রোগের শিকার হয়ে যান বারবার। বর্তমান অতিমারীর কথাই যদি ধরি, স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার সাধারণের তুলনায় বহুগুণ বেশি। করোনাও চলে যাবে একদিন। আমরা অকালমৃত স্বাস্থ্যকর্মীদের মনে রাখবো কি?
*
“গেদে কাশি বাপু.. একটা এক্সিরা কর্যা দ্যাখলে হত নি?” কিংবা “এত ছোট বাচ্চার এক্স-রে করছেন ডক্টর.. রেডিয়েশন নিয়ে সমস্যা হবে না তো?”
এসব প্রশ্নগুলো চিকিৎসকদের জীবনে রোজকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একশো পঁচিশ বছর পেরিয়ে এক্স-রে এখন আধুনিক চিকিৎসার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তবু শুরুর দিনগুলোর কথা মনে রাখা খুব দরকার। ল্যাবের অন্ধকার থেকে সমাজের নিম্নতম স্তর অব্দি আবিষ্কারের আশীর্বাদ চুঁইয়ে আসার ইতিহাস.. না, কিছু নীরস তথ্য নয়। সে ইতিহাস নিজেই একজন শিক্ষক।