আমার মেজকাকার কাছে সম্প্রতি দুটি বাচ্চা ছেলে আসাযাওয়া করছে| পাশের বাড়ির গৃহরক্ষকের দুই ছেলে| দুই ভাই|
আমার মেজকাকা ইতিহাসের একনিষ্ঠ পণ্ডিত মানুষ| সারাদিন নিজের বই লেখার কাজ করেন| তবু মাঝে মাঝে ছেলেপিলের গলা, তাদের গল্পগুজব না শুনলে তাঁর লেখায় মন বসে না| তাই এই ভাইদুটো কেবল নিজের নিজের গলা শোনাবার জন্য এবং গলা দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেবার কাজে বাহাল হয়েছে|
বড় ভাইটি ভারী সোজা মানুষ| দিনরাত কারণে অকারণে ছোটটাকে পেটায়, ঘন্টার পর ঘন্টা টিভি দেখে, মোবাইলে মানুষ মারার গেম খেলে আর তারপর মেজকাকার পাশের বিছানায় ভাইকে দিয়ে মশারি টাঙিয়ে ঘুমিয়ে পরে| কারণ পরের দিন ওই কাজগুলোই তাকে ধারাবাহিক ভাবে করে যেতে হবে| পরীক্ষায় ফেলটা ধারাবাহিক না হলেও বেশি সংখ্যাতেই ঘটে| পাশ অল্প অল্প| পাশ হলেই মোবাইল খেলায় মানুষ মারা তার আরো বাড়ে| আর এইসব করে করে খুব গম্ভীর আর স্বল্পবাক হয়ে গেছে সে|
ছোট ভাই কিন্তু ভারী চপল| এক কথা ফুলঝুরি| অনর্গল দাদার সাথে, আমাদের সাথে বকে চলে, হাসেও| পাখির একটা দানা খেতে যত সময় লাগে এতটুকু হাসি একেক বারে| সন্ধের পুজোর টিংটং ঘন্টার মত মিষ্টি ঠেকে তার ওইটুকু হাসির আওয়াজ| মারকুটি দাদাটাকে জড়িয়ে ঘুমোয়| দাদার মার খেয়ে দাদার সাথে বসে ভাত, ডাল আলুসিদ্ধ খায়|
একদিন–হঠাৎ| দেখলাম দাদার মত করেই মার থেকে মোবাইল নিল কেঁদেকেটে| তারপর অনেকক্ষণ খেলার পর মোবাইলটা ফেলে চুল মুঠো করে ধরে বসে রইল| চোখে কেমন সহায়হীনের কাতরতা| আরে!
আমার ভেতরের কালো কাকটা ঠোকরালো আমায়| মনের ভূতপাখিটা বলল–“যা ময়ূরা, জিজ্ঞেস কর কেন এমন মাঝে মাঝেই করে বাচ্চাটা!
“এমন করিস কেন রে তুই? চুল মুঠো করে বসে থাকিস দুঃখবুড়োর মত করে? কেন? মা, বাবা দাদা, টিভি, মোবাইল, চিকেন বিরিয়ানী সব এখানে! তাও হঠাৎ করে চুপ হয়ে যাস কেন?” —আমাকে অবাক করে ছেলে বললে —“সব এখানে, কিন্তু আসলটা আমাদের সুন্দরবনের গ্রামে|”
বললাম– “আসল আবার কী? এই তো মায়ের সাথে ঝামেলা করে মোবাইল নিলি! আবার আসল কী?” ছেলে আনমনে বলে– “সেখানে বড় মাঠের মধ্যে একটা স্কুল আমাদের| অনেক ঘাস মাঠে| ধপাস হয়ে গেলেও লাগে না| সবাই একসাথে খেলি| একসাথে পড়ি| একই রকমভাবে পড়ি|” বুঝলাম– “একইরকম” শব্দটা সে আমদানি করেছে টিভিতে সাম্প্রতিক অনলাইন পড়ানোর পদ্ধতি দেখে|
পরশু তার ঠাকুরদা মারা গেছে| সেই মৃত্যু তার মুক্তি এনে দিল| দেখলাম– হাসতে হাসতে মুখে একটুকরো গেঞ্জি বেঁধে চলল মা বাবার সাথে| মন খারাপ হচ্ছিল| কাছে ডাকলাম| অন্যান্য দিনের থেকে শান্ত ভাবে আমার কাছে এল| বুঝলাম, পছন্দের গ্রামে যাবে বলে তার এই বাড়তি বাধ্যতা| ভুল বললাম– মনের জিনিস পেয়ে সেদিন মধুর এক সৌজন্য জন্মেছিল তার| জুতো ফুতো খুলে তখনই এল আমার কাছে| বললাম–“কোভিড চারদিকে| মা বাবা ঘুরে আসুক| তুই দাদার সাথে থাক আমাদের বাড়িতে|”
কনফিডেন্ট উত্তর–“একসাথে খেললে, একসাথে সবাই মিলে পড়লে, একইরকম মিড ডে টিফিন খেলে কিছু হয় না| আমি গ্রামেই যাব| ওখানেই পড়ব|” আবার সেই ‘একইরকম’|
চলে গেছে| এখন স্কুল নেই তাও| আসলে ওই একসঙ্গে বড়ো হওয়ার পূর্ণঘাসের জায়গাটাই তাকে এ শহরের জৌলুস ভুলিয়েছে| তাই বাপ, মা, মায়ের হাতের চিকেন বিরিয়ানী, যে দাদাকে গলা জড়িয়ে ধরে রাখে সারারাত্তির —- সব ফেলে চলেই গেছে সে| তার অবশ্য বিশ্বাস– অততবড় মাঠের মধ্যে তার স্কুল নিশ্চয় বসবে যে কোনো দিন| সেখানে তার অনেক বন্ধু| তাদের তেজময় কণ্ঠ নিয়ত সরব করবে বন্ধ শিক্ষালয়ের ঘরদুয়োর|
নাহ! এই নিশিতে সে নেই আমার ধারেপাশে| ভোর উঠলেও থাকবে না| কেবল রেখে গেছে দু শব্দ–সবাই মিলে|
ছুটি হলে আসিস একবার| শোনাস দুশব্দে ছড়িয়ে থাকা তোর সুখগল্পটা|
সবুজ বিরাট মাঠ আর সবাই মিলের গল্পটা|
ডিসগাস্টিং কাউয়াটা অবশ্য চরকি কাটবে তখনো! —“দ্যাখ না সুন্দরী ময়ূর – খুঁচিয়ে দ্যাখ না একবার –সে গল্পে ঝগড়া আছে কিনা!”
থাকবে না– দেখিস!
সুন্দরের আরাধনা ।
ছেলেটির সুন্দর ভাবনার ছোঁয়া লাগুক আমার মনে , সুন্দর হই !
মেজকাকা একজন অতীত লেখার মানুষ। তার সামনে সবসময় ভবিষ্যৎ ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিশুর মন বোঝা যাচ্ছে সে প্রকৃতিকে যেভাবে চায় তা সে এখানে পাচ্ছে না। তার পছন্দের জায়গা সুন্দরবন। তার বর্ণনায় ফুটে উঠেছে ভালবাসার ছবি। ময়ূরীদেবী এখানে সার্থক। কি সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন একটা শিশুর চাওয়ার বা ভালবাসার পরিধি। যেখানে সে সবথেকে বেশি সাবলীল। দারুণ লেখা।
ওই ছোট ছেলেটার চাওয়া এখন আমাদের সকলের চাওয়া। বাস্তব হোক ওর স্বপ্ন। ভারি সুন্দর লেখা।