(পূর্বপ্রকাশিতের পর)
তাহলে এমন কেন হল? কী করে হতে পারল??
এ লেখায় প্রশ্নটা চিকিৎসকদের নিয়ে, কিন্তু কথাটা কি যেকোনো পেশার মানুষকে নিয়েই হতে পারত??
হয়ত পারত। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত, এই প্রশ্নটা আরো বিশেষভাবে চিকিৎসকদের জন্যেই। যেকোনো নাগরিকের সহনাগরিক বা প্রতিবেশীর কাছে বিপদের মুহূর্তে পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা থাকে – কিন্তু চিকিৎসকের কাছে প্রত্যাশাটা তার চাইতে অনেক বেশী। চিকিৎসকের জামা পরে যে মানুষটি আমার সামনে উপস্থিত, তাঁর কাছে আমার আশা উপশম – সেখানে বাড়তি যন্ত্রণা বা অত্যাচার অপ্রত্যাশিত তো বটেই, সেটা এমন একটা স্তরে বিশ্বাসভঙ্গ যাতে সামগ্রিকভাবে যাবতীয় সামাজিক সম্পর্কগুলোর উপরেই বিশ্বাস নড়ে যেতে পারে।
আর চিকিৎসক? তিনি কীভাবে দেখবেন ব্যাপারটাকে? দিনের শেষে তিনিও একজন মানুষ – না, বলা উচিত, সবার আগে তিনিও একজন রক্তমাংসের মানুষ – আপনার মতো তাঁরও “দেশপ্রেমিক” হতে ইচ্ছে করে, যে দেশপ্রেমের অর্থ রাষ্ট্রনেতার অন্ধ সহযাত্রী হওয়া – আপনার মতো তাঁরও “জাতীয়তাবাদী” হয়ে উঠতে সাধ হয় – লাইনে দাঁড়িয়ে নেতার ভাষণের সাথে সাথে রক্ত গরম করে নিতে তাঁরও সাধ হয়। এবং এই “দেশপ্রেম” প্রকল্পের বিরুদ্ধে যাঁরা থাকেন, আপনার মতোই একজন ব্যক্তি-চিকিৎসকও তাঁদের ঘৃণ্য শত্রু বলে বিবেচনা করেন। অস্বাভাবিক কি? সম্ভবত না।
প্রশ্নটা শুধুই স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিকের নয় – প্রশ্নটা উচিত নাকি অনুচিত, সেই নিয়ে।
একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা, হয়ত, আমাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। আপনার মতো চিকিৎসকও রক্তমাংসের মানুষ – বৌ-বাচ্চা নিয়ে তাঁকেও সংসার করতে হয়। স্বৈরাচারী শাসকের রাজত্বে হ্যাঁ-তে হ্যাঁ না মেলালে সেই প্রতিবাদীর পরিণতি অনুমান করা কঠিন কিছু নয়। সেই পরিণতির সম্ভাবনা, বা নিদেনপক্ষে হয়রানি সহ্য করার ক্ষমতা সবার থাকে না। ঠিক এভাবেই অধিকাংশ মানুষ রাষ্ট্রশক্তির সমর্থক হয়ে ওঠেন – আর যেহেতু মৌনতা সম্মতির লক্ষণ হিসেবে গ্রাহ্য, সেহেতু রাষ্ট্রশক্তি নিজের শক্তিপ্রদর্শনের খেলায় সেই বৃহত্তর অংশকে ক্ষমতার অংশ হিসেবেই দেখাতে থাকেন। চিকিৎসকরাও কি ঠিক এই পথেই “নাৎসি চিকিৎসক” হয়ে উঠলেন?
আমার মনে হয়, এরকমভাবে দেখতে চাওয়াটা ভুল হয়ে যাবে। ওপরের যুক্তিটি অ্যাক্টস-অফ-অমিশনের ক্ষেত্রে যদিও বা প্রযোজ্য হয় – অর্থাৎ যখন কিনা আপনি প্রত্যাশার উপযুক্ত কর্তব্যপালনে ব্যর্থ হলেন, যেমন ধরুন সামনের বাড়ির লোকটিকে যখন অকারণেই পুলিশ মারধর করছে, আপনি কিছুই আপত্তি করলেন না, ঘরের মধ্যেই ঘাপটি মেরে রইলেন – সেই একই যুক্তি অ্যাক্টস-অফ-কমিশনের ক্ষেত্রে, অর্থাৎ আগের উদাহরণে যখন আপনি স্বয়ং পুলিশের সাথে গিয়ে সেই অত্যাচারে অংশগ্রহণ করছেন, তখনও সেই যুক্তি একইভাবে প্রযোজ্য হবে কি?
আর বৃথাই আমরা এত সম্ভাবনার তত্ত্ব সাজিয়ে কথা বাড়াচ্ছি। ন্যুরেমবার্গ ডক্টর্স ট্রায়ালে একজন চিকিৎসকও স্রেফ বাধ্য হয়ে এইধরণের পরীক্ষানিরীক্ষার কাজ করেছিলেন, আত্মপক্ষ সমর্থনে এমন যুক্তি তোলেন নি।
একসাথে সাজালে তাঁদের যুক্তিগুলো দাঁড়ায় –
১. যে সময় তাঁরা পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন, সেই সময় মানুষের শরীরে গবেষণা চালানোর বিধিনিষেধ বিষয়ে কোনো সর্বজনমান্য নির্দেশিকা (ইউনিভার্সাল কোড বা ইউনিভার্সাল এথিকাল গাইডলাইনস অন হিউম্যান এক্সপেরিমেন্টেশন) ছিল না।
২. তাঁরা যা যা করেছেন, তার একটিও দেশের সমকালীন আইনের বিরুদ্ধ নয় বা দেশের আইনের চোখে অপরাধ নয়।
৩. বন্দীদের উপরে মেডিকেল পরীক্ষানিরীক্ষা চালানোর রীতি বহুদিন ধরেই চালু। আজ যাঁরা বিচারকের আসনে বসেছেন, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই জেলবন্দীদের উপর পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যাপারে পথিকৃৎ এবং বিচারের সময়েও পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে বলেই খবর।
৪. আজকের এই বিচারালয় গবেষণার যে পরিবেশটিকে অমানবিক বলে দাগিয়ে দিতে চাইলেন, সে পরিবেশ আকাশ থেকে পড়ে নি। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের বন্দীশালায় তার চাইতে উন্নত কোনো পরিবেশের ব্যবস্থা করা সম্ভবপর ছিল না।
ন্যুরেমবার্গের বিচারক যুক্তিগুলো মানেন নি। কিন্তু, তার চাইতেও বড় প্রশ্ন, যুক্তিগুলো কি বিভিন্ন ধাঁচে আমাদের সামনে আজও আসে না??
চিকিৎসকের দায়বদ্ধতা কার প্রতি? রাষ্ট্রের প্রতি? দেশপ্রেমের প্রতি? মহৎ আদর্শের প্রতি?
সামনের মানুষটিকে হাঁড়িকাঠে চড়ালে যদি “বৃহত্তর স্বার্থ” রক্ষা পায় – সে বৃহত্তর স্বার্থ যেভাবেই সংজ্ঞায়িত হোক না কেন – চিকিৎসক কি সেই স্বার্থরক্ষার কাজে হাত মেলাবেন?
নাকি চিকিৎসকের দায় মানবতার প্রতি? মাথায় রাখা দরকার, মানবতা ব্যাপারটা খুবই ভাসা ভাসা। আমরা যাদের চোখের সামনে দেখতে পাই না, তাদের প্রতি চট করে মানবিক সহমর্মিতার বোধ জাগিয়ে তোলা যায় না। কিন্তু, মানবতার অর্থটা যদি খুব ছোট করে আনা যায়, অর্থাৎ শুধুমাত্র আপনার সামনে যে মানুষটা বসে আছেন, সেই মানুষটার প্রতি সহমর্মিতা বা বাকি সবকিছু অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র তার যন্ত্রণার উপশমে উদ্যোগী হওয়া, সে কাজটা তো কঠিন নয়।
কিন্তু, বৃহত্তর প্রেক্ষিতটাও কি অগ্রাহ্য করা কাজের কথা? একটা একটা করে গাছ দেখতে থাকলে জঙ্গলের অস্তিত্ব বিষয়ে সচেতন হতে সময় লেগে যেতে পারে, সেও তো সমস্যা, তাই না? তাহলে??
প্রশ্নগুলো সহজ নয়। উত্তরও এককথায় দিতে পারা মুশকিল।
চিকিৎসককে বিশেষ ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হতেই হবে, এমন কিছু দায় তাঁর নেই। কিন্তু, আদর্শে উদবুদ্ধ তিনি হতে পারেন অবশ্যই – কিন্তু, চিকিৎসক পেশার আদর্শ, যাকে কিনা মানবসেবার আদর্শের সাথে এক করে দেখতে চান অনেকেই, সেই আদর্শের সাথে যদি দেশপ্রেম বা রাষ্ট্রানুগত্যের সঙ্ঘাত বাধে, তখন ঠিক কী করণীয়?
অথবা, যদি ‘বিজ্ঞানের স্বার্থ’ এই শব্দবন্ধ গুলিয়ে দিতে থাকে সবকিছু?
বিজ্ঞান আমাদের বর্তমানকে আরো বিশদে বুঝতে, অনুধাবন করতে শেখায়। হয়ত আমাদের অতীতকেও আরেকটু নিবিড় করে চিনতে শেখায়। কিন্তু, আমাদের ভবিষ্যৎ ঠিক কেমন হওয়া উচিত, সেও কি বিজ্ঞান নির্দিষ্ট করে দিতে পারে? বর্তমান বা অতীতকে খুব নিবিড় করে চেনার মধ্যে যদি খুঁত চোখে পড়ে, আর বিজ্ঞান যদি ভাবতে থাকে আরো বৃহত্তর গবেষণার মধ্যে দিয়ে সেই খুঁত মেরামত করে ফেলা সম্ভব, তাহলে? মেরামতির স্বার্থে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া উচিত?? ভেবে দেখুন, এ তো অন্যায্য কিছু দাবী নয়। যে মানুষটির ধ্যানজ্ঞান ওই গবেষণাগার, যাঁর ওই গবেষণাগারের বাইরে কোনো দৈনন্দিন জীবন নেই – তিনি কি ভাবতে পারেন না, যে, এক উন্নততর ভবিষ্যৎ পৃথিবীর দিশা দেখাতে পারবে তাঁর গবেষণা?
মানে, নাৎসি ডাক্তারদের যখন কাঠগড়ায় তোলা হল, তাঁরা তো নিজেদের গবেষণার মুহূর্তে তেমনটাই ভেবেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন।
উন্নত মনুষ্যসমাজ গড়ে তোলার মহান উদ্দেশে তাঁরা ছেঁটে ফেলতে চাইছিলেন তথাকথিত “আবর্জনা” বলে চিহ্নিত মানুষদের। পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছিলেন “অশুদ্ধ জিন”-এর অধিকারী মানুষদের।
তাঁদের বোঝার মধ্যে শুধু একটাই ফাঁক রয়ে গিয়েছিল। কে উন্নত, কার জিন বেশী শুদ্ধ, ঠিক কোন জিন-এর বাড়বাড়ন্ত কাঙ্খিত ও বাঞ্ছনীয়, সেই হিসেব বিজ্ঞানের পথ ধরে আসেনি। সে হিসেব কষে রেখেছিলেন রাষ্ট্র – রাষ্ট্রক্ষমতা – ক্ষমতার আদর্শ। একজন মানুষের থাকে আরেকজন মানুষ ভিন্ন – জাতিগত ভিন্নতাও বাস্তব – এবং সেখানে জেনেটিক ভিন্নতাও পরীক্ষিত। কিন্তু, জিনই একমাত্র নির্ধারক নয়। আর, ভিন্নতা মানেই মানদণ্ডে ফেলে ক্রমানুসারে সাজাতে পারা নয়।
শুধুমাত্র এইটুকু ফাঁকের সুবাদে তথাকথিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা, যা কিনা চিকিৎসক-বিজ্ঞানীদের ধারণানুসারে ছিল বৃহত্তর মানবসমাজ সৃজনের উদ্দেশে নিয়োজিত, সেই গবেষণা হয়ে দাঁড়ালো হিংস্র, অমানবিক।
বিজ্ঞানের গবেষণার অন্যতম সমস্যা এটাই। বিজ্ঞান আমাদের বর্তমান চিনতে শেখায়, হয়ত অতীতও। কিন্তু, ভবিষ্যতের পথ চিহ্নিত করে দেওয়ার নিরঙ্কুশ দায় বিজ্ঞানের হাতে ছেড়ে দিলে বিপদ – বড়ো বিপদ। সে বিজ্ঞান, ও সেই বিজ্ঞানে ব্রতী বিজ্ঞানী রাষ্ট্রের হাতের পুতুল – রাষ্ট্রশক্তির অংশ তো বটেই, রাষ্ট্রশক্তির হাতে বড় অস্ত্রও।
চিকিৎসক বিজ্ঞানের পথ ধরে এগোন অবশ্যই। কিন্তু, শুধুই বিজ্ঞান নিয়ে কি তাঁর রোজকার পথচলা? সমাজভাবনা, ইতিহাস, দর্শনের রাস্তা ছেড়ে শুধুই বিজ্ঞান আঁকড়ে থাকলে চিকিৎসকের কাজ চলে? চলতে পারে??
চিকিৎসকের কি বাকি সবকিছু ছেড়ে শুধুই বিজ্ঞান নিয়ে ভাবা দরকার? শুরুর প্রশ্নে আরো একবার ফিরে যাওয়া যাক। চিকিৎসকের লক্ষ্য বা দায়বদ্ধতা কার প্রতি? সামগ্রিকভাবেই, চিকিৎসাবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য কী??
নাৎসি ডাক্তাররা তৎকালীন মান্য বিজ্ঞানের পথ ধরে চলেছিলেন, এমন কথাই বলেছিলেন ন্যুরেমবার্গের আদালতে। সত্যি কথা বলেছিলেন কি? নাকি তাঁদের সেই তথাকথিত বিজ্ঞানের পথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল সমকালীন ইতিহাস এবং রাষ্ট্রশক্তির আদর্শ? এবং নাৎসি ডাক্তাররা অবোধ শিশুর মতো রাষ্ট্রশক্তির পথে চলেছিলেন, এমন নয় – তাঁদের পথনির্বাচন ছিল রীতিমতো সচেতন??
(চলবে)
সৈন্যদের অত্যাচার করা কি আমরা সমর্থন করবো ? কিম্বা বিরুদ্ধ রাজধানীর মানুষের বিরুদ্ধে পুলিশের অত্যাচার ? অথবা ধর্মের নামে রাষ্ট্রীয় অত্যাচার ?
শেষ হোক লেখা, তার পর না হয় আমার ভাবনা ভাগ করে নেওয়া যাবে। তবে তিনটি পর্বই এর মধ্যে অস্থির করে তুলেছে।