প্রেমিকা মার্গারেট হুপার মাহোনের সাথে বেস্ট, ১৯২১ সালে। |
রাতে অভিযান চালিয়ে, যেনতেন প্রকারে কুকুর তো জোগাড় হলো। কিন্তু আইলেটিন? হাতে আর সামান্য একটু আইলেটিন পড়ে আছে। আবার নতুন করে আইলেটিনও প্রস্তুত করতে হবে এখন তাঁদের। এবার একটু বেশি পরিমাণে আইলেটিন প্রস্তুত করতে চান তাঁরা। ভাবনা চিন্তা করে তাঁরা ঠিক করলেন এবার আর কুকুর নয়, একটু বড় আকৃতির প্রাণীর সাহায্য নেবেন তাঁরা। সেই অনুযায়ী, বাছুরের কথা ভাবলেন বান্টিঙ। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পশু খামার তো আছেই। সেই মতো একটা বাছুরের প্যানক্রিয়াসের সাহায্য নিলেন বান্টিঙ আর বেস্ট। বাছুরের সেই প্যানক্রিয়াস থেকে একই পদ্ধতিতে আবার তাঁরা প্রস্তুত করলেন তাঁদের স্বপ্নের প্যানক্রিয়াস নির্যাস- আইলেটিন। পাশাপাশি তাঁদের পরীক্ষা পদ্ধতি, পর্যবেক্ষণ এবং সমস্ত ফলাফল, প্রবন্ধ আকারে গুছিয়ে লিখে রেখেছেন বান্টিঙ এবং বেস্ট। ম্যাক্লাউডের তো সেই রকমই নির্দেশ। তাঁদের এই প্রবন্ধের খসড়া লিখতে সাহায্য করছেন বেস্টের প্রেমিকা মার্গারেট হুপার মাহোন।
১৪ই নভেম্বর ১৯২১, আজ বান্টিঙের ৩০তম জন্মদিন। ম্যাক্লাউডের ঘোষণা মতো আবার আজই বসতে চলেছে ‘ফিজিওলজিক্যাল জার্নাল ক্লাব অব দ্য ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো’র অধিবেশন। ম্যাক্লাউডের নেতৃত্বে সেই সভায় যোগদান করতে চলেছেন বান্টিঙ আর বেস্ট। বিকেল ৪টা, সেমিনার রুমে হাজির হলেন তাঁরা। এই প্রথম কোনো সভায় বক্তৃতা করতে চলেছেন বান্টিঙ। ভিতরে ভিতরে তাই বেশ নার্ভাস বোধ করছেন বান্টিঙ। নির্দিষ্ট সময়ে তাঁদের বক্তৃতা করতে আহ্বান করা হলো। ম্যাক্লাউডের যা খ্যাতি, প্রতিপত্তি, তাতে সভার প্রত্যেকেই তাঁকে চেনেন। বরং বান্টিঙ বা বেস্টকে চেনেন না প্রায় কেউই। বক্তৃতার শুরুতেই তাই অভ্যাগতদের সাথে বান্টিঙ ও বেস্টকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ম্যাক্লাউড। বান্টিঙ-বেস্টের গবেষণার বিষয়বস্তু নিয়ে দুচার কথা বললেন তিনি। ম্যাক্লাউড জানালেন, কোন লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছিলাম আর এখন কোন অবস্থায় এসে পৌঁছেছি আমরা। ম্যাক্লাউডের বক্তব্য শুনে তো হতবাক বান্টিঙ। ‘আমরা’ মানে? ‘আমরা’ মানে কারা? ম্যাক্লাউড কী ভাবে আমাদের গবেষণার শরিক হলেন? বান্টিঙের ক্ষোভ, ‘আমাদের’ বলবেন কেন ম্যাক্লাউড? যা করার, করেছি তো আমি আর বেস্ট। এর মধ্যে ম্যাক্লাউড কোথা থেকে এলেন? এই ‘আমাদের’ বলার জেরেই, অনুষ্ঠানের শেষে অনেকের মুখেই ‘অধ্যাপক ম্যাক্লাউডের নতুন অবিষ্কার’এর প্রশংসা শুনতে হয়েছে তাঁদের। ম্যাক্লাউডের নামের ধারে ও ভারে সেদিন হারিয়ে গিয়েছিল বান্টিঙ বা বেস্টের নাম। তাই পরিচয় জ্ঞাপক ভাষণে ম্যাক্লাউডের মুখে ‘আমাদের’ কথাটা মোটেও পছন্দ হয় নি বান্টিঙের।
ম্যাক্লাউডের পরিচয় জ্ঞাপক ভাষণের পর, বক্তব্য রাখতে উঠলেন বান্টিঙ এবং বেস্ট। বান্টিঙই মূল বক্তা, বান্টিঙের বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে চার্টের মাধ্যমে তাঁদের পরীক্ষার বিষয়বস্তুর সচিত্র বিশ্লেষণ করছিলেন বেস্ট। কিন্তু সমস্যা তৈরি হলো বান্টিঙ-এর বক্তৃতাকে ঘিরে। বান্টিঙ মোটেও সুবক্তা ছিলেন না। নিজের বক্তব্যকে অত্যন্ত অগোছালো ভাবে সুধীজনের সামনে পেশ করলেন বান্টিঙ। বান্টিঙের বক্তব্য এতটাই অবিন্যস্ত ছিল যে তার সারমর্ম উদ্ধার করতে সমস্যায় পড়েন অনেক বিজ্ঞজনই। ঠিক কী যে বোঝাতে চাইছেন বান্টিঙ, তা স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারছেন না কেউই। ফল বশত, অভ্যাগতদের ধারণা হলো, মূল গবেষণাটা ম্যাক্লাউডেরই, শিক্ষানবিশ বান্টিঙ আর বেস্ট ঠিক মতো ব্যাখ্যা করতে পারছেন না তা। ফলে প্রথমদিন থেকেই জনমানসে এই ধারণাই তৈরি হয়ে যায় যে ম্যাক্লাউডই নতুন ‘নির্যাস’এর আবিষ্কর্তা। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে ম্যাক্লাউডের সহযোগিতা ও ‘গাইডেন্স’ না থাকলে বান্টিঙ বা বেস্টের পক্ষে গবেষণা করা খুবই কঠিন হয়ে যেতো। আবার এও ঠিক, ইনসুলিনের মূল গবেষণার সময় ম্যাক্লাউড কিন্তু কানাডায় উপস্থিত ছিলেন না। তিনি তখন ছুটিতে স্কটল্যান্ডে ছিলেন। এছাড়াও, বান্টিঙের সাথে প্রথম সাক্ষাতের সময়ও, বান্টিঙের গবেষণা নিয়ে বিশেষ আশাবাদী ছিলেন না ম্যাক্লাউড। ফলে ইনসুলিন আবিষ্কারের পিছনে ম্যাক্লাউডের কৃতিত্ব নিয়ে বান্টিঙের ক্ষোভকে যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞই।
টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের কনট ল্যাবের ছাদে মার্জরি। পাশে বান্টিঙ? |
কোনো রকমে জোড়া তাপ্পি দিয়ে জার্নাল ক্লাবের সভায় তাঁর অতি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষ করলেন বান্টিঙ। পরদিন আবার হাজির হলেন ল্যাবে। ইতিপূর্বেই বাছুরের প্যানক্রিয়াস থেকে আইলেটিন প্রস্তুত করেই রেখেছিলেন বান্টিঙ এবং বেস্ট। জার্নাল ক্লাবের সভার ব্যস্ততার জন্য এখনও ব্যবহার করা হয় নি তা। ম্যাক্লাউডের নির্দেশ মতো পুরানো পরীক্ষার ফলাফলগুলোকে আর একবার ঝালিয়ে নিতে হবে তাঁদের এবার। সেই মতো ১৮ই নভেম্বর ১৯২১, কুকুর নম্বর ৩৩এর প্যানক্রিয়াস কেটে নেওয়া হলো। এই ৩৩ নম্বর কুকুরটা ইনসুলিনের ইতিহাসে ‘মার্জরি’ নামে পরিচিত। যদিও বান্টিঙ-বেস্টের নোট বইয়ে ‘মার্জরি’ বলে কোনো নামের উল্লেখ নেই। তাঁদের দিনিলিপিতে কিন্তু কুকুর নম্বর ৩৩এর উল্লেখ আছে। তাহলে কে দিল এই ‘মার্জরি’ নামটা? কেনই বা সংখ্যার বদলে নাম জুটলো কুকুর নম্বর ৩৩এর? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর অবশ্য পাওয়া যায় না। এর উত্তর অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। কিন্তু সংখ্যার বদলে নামের ব্যবহার দেখে বোঝাই যাচ্ছে, ইনসুলিনের ইতিহাসে কুকুর নম্বর ৩৩ ওরফে মার্জরির গুরুত্ব কতখানি।
দিন কুড়ির মধ্যেই ডায়াবিটিস ধরা পড়ল প্যানক্রিয়াসহীন মার্জরির। [প্যানক্রিয়াসহীন কুকুরের দু’চার দিনের মধ্যেই ডায়াবিটিস ধরা পড়ার কথা। অথচ মার্জরির ক্ষেত্রে সময় লাগল ১৮ দিন! প্রশ্ন থেকে যায়, মার্জরির পুরো প্যানক্রিয়াসটা কি আদৌ বাদ দিতে পেরেছিলেন বান্টিঙ?] ৬ই ডিসেম্বর ১৯২১, মার্জরির দেহে আইলেটিন ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করা হলো। ইঞ্জেকশন নেবার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মার্জরির মূত্রে সুগারের মাত্রা কমতে থাকে। আগের অভিজ্ঞতা মতোই, মার্জরিকে দিনে তিন-চারবার করে আইলেটিন ইঞ্জেকশন দিতে থাকলেন বান্টিঙ এবং বেস্ট। নিয়মিত আইলেটিন দেওয়ার ফলে স্বাভাবিক ছন্দেই জীবন ধারণ করতে লাগল মার্জরি। বান্টিঙ ও বেস্টের পরিচর্চার ফলে ৭০ দিন বেঁচে ছিল মার্জরি। ২৭শে জানুয়ারি ১৯২২ সালে, মারা যায় মার্জরি। প্রকৃতপক্ষে, প্যানক্রিয়াসহীন মার্জরির ৭০ দিন বেঁচে থাকাটাই ইনসুলিন গবেষণার প্রথম সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। তাই ইনসুলিনের ইতিহাসে মার্জরি নামটা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। অনেকেই মনে করেন, ডায়াবিটিস গবেষণার স্বার্থে নিজের জীবন উৎসর্গ করে, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে মার্জরি। তাই মার্জরি ও তার সাথী অন্যান্য কুকুরদের ‘মিষ্টি কুকুর’ বলে সম্বোধন করেন অনেকেই। সম্ভবত এই সমস্ত সারমেয় প্রেমীরাই কুকুর ৩৩কে মার্জরি নামে অভিহিত করেছিলেন। সেই থেকে ইনসুলিন সমাজে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে মার্জরি। আজও ডায়াবিটিস প্রতিরোধে অর্থ সংগ্রহের জন্য মার্জরির ছবি আঁকা টি-শার্ট বিক্রি করা হয়। ডায়াবিটিস প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে নীল রঙের রিঙ ব্যবহার শুরু হয় ২০০৬ সাল থেকে। সেই সূত্রে মার্জরির গলায়ও ঝোলানো হয়েছে নীল ফিতে। মার্জরি আজ ডায়াবিটিস প্রতিরোধের প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
শিল্পীর তুলিতে মার্জরি |
মার্জরির উপর আইলেটিনের সফল প্রয়োগ দেখে সন্তুষ্ট হলেন ম্যাক্লাউড। গবেষণার এই নতুন ফলাফলের সাথে পূর্বোক্ত সভায় প্রদত্ত বক্তৃতা মিশিয়ে, বান্টিঙ ও বেস্টকে নতুন করে একটা প্রবন্ধ লিখতে বললেন ম্যাক্লাউড। এবার আর বক্তৃতা নয়। তাঁদের গবেষণার সাফল্যের খবর ছাপানোর কথা ভাবলেন ম্যাক্লাউড। ম্যাক্লাউডের নির্দেশে, নতুন প্রবন্ধ লিখতে শুরু করলেন বান্টিঙ ও বেস্ট। ‘দ্য ইন্টারন্যাল সিক্রেশন অব দ্য প্যানক্রিয়াস’ শীর্ষক নতুন প্রবন্ধ লিখলেন বান্টিঙ। প্রবন্ধের লেখক হিসেবে অবশ্য ম্যাক্লাউড, বান্টিঙ ও বেস্ট- তিনজনের নামই উল্লেখ করেন তিনি। লেখাটা সম্পাদনার জন্য ম্যাক্লাউডের কাছে পাঠানো হলো। বান্টিঙের সেই প্রবন্ধ পড়ে, ছাপানোর অনুমতি দিলেন ম্যাক্লাউড। তবে ছাপানোর আগে ছোট্টো একটা সংশোধন করলেন তিনি। প্রবন্ধের সহ-লেখক হিসেবে নিজের নামটা কেটে দিলেন ম্যাক্লাউড। তিনি বললেন, প্রবন্ধ ছাপা হবে বান্টিঙ ও বেস্টের নামে। ডিসেম্বর ১৯২১, বান্টিঙ-বেস্টের লেখা এই প্রবন্ধ পাঠানো হলো ইউএসএর সেন্ট লুইস থেকে প্রকাশিত ‘জার্নাল অব ল্যাবরেটরি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল মেডিসিন’ পত্রিকার দপ্তরে। ফেব্রুয়ারি ১৯২২ সালে, ওই পত্রিকায় প্রকাশিত হয় প্রবন্ধটা।
বান্টিঙের প্রবন্ধে ম্যাক্লাউডের সম্পাদনা প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। বান্টিঙ-বেস্টের লেখা এই প্রবন্ধের সহলেখক হিসেবে নিজের নাম কেন কেটে দিয়েছিলেন ম্যাক্লাউড? তবে কি ইনসুলিন আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিতে চান না তিনি? বিষয়টা ঠিক স্পষ্ট নয় অনেকের কাছেই। অনেকেই এই ঘটনাটাকে ম্যাক্লাউডের বিচক্ষণতা বা উদারতার উদাহরণ হিসেবেই ব্যাখ্যা করেন। অনেকেই আবার একটু ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করেন বিষয়টাকে। তাঁরা বলেন, বান্টিঙ কখনই ম্যাক্লাউডের মতো দক্ষ প্রাবন্ধিক ছিলেন না। বান্টিঙের সেই প্রবন্ধ পড়ে, সেদিন আদৌ খুশি হন নি ম্যাক্লাউড। বান্টিঙের লেখা সেই প্রবন্ধের সামগ্রিক উপস্থাপনা খুব উঁচু মানের ছিল না বলেই মনে হয়েছিল ম্যাক্লাউডের। প্রবন্ধ পড়েই অভিজ্ঞ ম্যাক্লাউড বুঝেছিলেন, শিক্ষানবিশ হিসেবে বান্টিঙ ও বেস্ট এই প্রবন্ধ লিখতেই পারেন, কিন্তু তিনি নিজে এই প্রবন্ধের সাথে যুক্ত থাকতে চান না। এই প্রবন্ধ তাঁর পদমার্যাদা ও পরিচিতির উপযুক্ত নয়। তিনি মনে করেন এই প্রবন্ধ তাঁর সুনাম বজায় রাখতে ব্যর্থ হবে। প্রবন্ধের সহ-লেখক হিসেবে নিজের নামটা তাই কেটে দিয়েছিলেন তিনি।
বান্টিঙের লেখা প্রথম দু’টো প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল বান্টিঙ ও বেস্টের যুগ্ম নামে। সেই দুটো প্রবন্ধে ম্যাক্লাউডের নাম অনুপস্থিত ছিল। বান্টিঙের বুঝতে অসুবিধা হয় নি যে তাঁর লেখা প্রবন্ধের সহলেখক হিসেবে ম্যাক্লাউডের নাম না থাকায়, প্রবন্ধগুলো যেন যথোপযুক্ত গুরুত্ব পাচ্ছে না। তাঁর লেখা প্রবন্ধের সহলেখক হিসেবে ম্যাক্লাউডের নাম থাকা উচিৎ বলেই মনে করেন তিনি। সরাসরি ম্যাক্লাউডের কাছে এই মতামতই প্রকাশ করলেন বান্টিঙ। তাঁদের লেখা প্রবন্ধে ম্যাক্লাউডের নাম সংযোজন করতে অনুরোধ করেন তিনি ম্যাক্লাউডকে। ম্যাক্লাউড পরে বলেন, “বান্টিঙের অনুরোধে প্রবন্ধে আমার নাম উল্লেখের জন্য সম্মত হই আমি। বান্টিঙ বলেছেন তিনি এই রকম ইচ্ছা পোষণ করেন কারণ যেহেতু এক্সপেরিমেন্টাল ডায়াবিটিসে আমি একজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব, এতে প্রবন্ধগুলো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে”। বান্টিঙের অনুরোধক্রমেই পরবর্তীকালে বান্টিঙের লেখা প্রায় সব প্রবন্ধেই বান্টিঙ-বেস্টের পাশাপাশি সহলেখক হিসেবে ম্যাক্লাউডের নামও উল্লেখ করা থাকতো।
বান্টিঙের সহপাঠী ডা. গিলখ্রিস্ট[২৬] বেশ কয়েক বছর ধরেই ডায়াবিটিস আক্রান্ত। গিলখ্রিস্ট তখন ক্রিস্টি স্ট্রিট হাসপাতালে কর্মরত। বান্টিঙ নিজে ডায়াবিটিস নিয়ে এতদূর এগিয়েছেন আর গিলখ্রিস্টের জন্য কিছু করতে পারবেন না! বান্টিঙ ভেবে দেখলেন, গিলখ্রিস্টকে যদি প্যানক্রিয়াসের নির্যাস খাওয়ানো যায় তাহলে কেমন হয়? তাতে খাওয়ার ওষুধ হিসেবে আইলেটিন কতটা উপযোগী তাও পরীক্ষা করা যাবে। আর যদি কাজ হয় তাহলে গিলখ্রিস্টেরও উপকার হবে। সেই মতো গিলখ্রিস্টের সাথে পরামর্শ করলেন বান্টিঙ। বান্টিঙের প্রস্তাবে রাজি হলেন গিলখ্রিস্ট। ২০শে ডিসেম্বর ১৯২১, ওষুধ হিসেবে গিলখ্রিস্টকে খাওয়ানো হলো ষাঁড়ের প্যানক্রিয়াস থেকে প্রস্তুত করা নির্যাস। এই পরীক্ষার ফল অবশ্য আশানুরূপ হয় নি। নির্যাস সেবনের পর গিলখ্রিস্টের অবস্থার কোনো উন্নতিই পরিলক্ষিত হলো না। বিষয়টা নিয়ে আর বেশি দূর এগোতে রাজি হলেন না বান্টিঙ। খাওয়ার ওষুধ হিসেবে ইনসুলিনের পরীক্ষায় ইতি টানেন তিনি।
ডা. যোসেফ গিলখ্রিস্ট, ১৯২০ সালের ছবি। |
ডা. গিলখ্রিস্টই হলেন পৃথিবীর প্রথম মানুষ যাঁকে [অপরিশোধিত] প্যানক্রিয়াস নির্যাস তথা ইনসুলিন খাওয়ানো হয়েছিল। গিলখ্রিস্টের উপর বান্টিঙের এই পরীক্ষার মাস দুয়েক পর, ফেব্রুয়ারি ১৯২২ সালে, গিলখ্রিস্টের উপর ইনসুলিন ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করা হয়। তারপর থেকে নিয়মিত ইনসুলিন ইঞ্জেকশন গ্রহণ করতেন গিলখ্রিস্ট। আমরা দেখবো, পরবর্তীতে এই ক্রিস্টি স্ট্রিট হাসপাতালের ডায়াবিটিসের চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন বান্টিঙ। তখন তাঁর সহযোগী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন গিলখ্রিস্ট। বান্টিঙের সহযোগী হিসেবে একদিকে যেমন আউটডোরে ডায়াবিটিস রোগী দেখেছেন গিলখ্রিস্ট, অন্যদিকে নিজে রোগী হিসেবে নিজের দেহে ইনসুলিন সংক্রান্ত ছোটোখাটো পরীক্ষাও করে গেছেন তিনি। ইনসুলিনের আদি লগ্নে ডা. যোসেফ গিলখ্রিস্টের এই অসমসাহসিক আবদান মানব সমাজে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
(চলবে)
[২৬] অন্টারিয় প্রদেশের ব্রান্টফোর্ড শহরে জন্মগ্রহণ করেন যোসেফ এপেলেবে গিলখ্রিস্ট (১৮৯৩-১৯৫১)। ১৯১৬ সালে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক্তারি পাশ করেন এবং ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কানাডার সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে ক্রিস্টি স্ট্রিট হাসপাতালের চিকিৎসক পদে যোগ দেন তিনি।