(পূর্ব প্রকাশিতর পরে)
জার্মানির চিকিৎসকদের “নাৎসি ডাক্তার” হয়ে ওঠার শুরু কবে থেকে? রাতারাতি সবাই, বা অন্তত চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ, এমন নৃশংস নৈর্ব্যক্তিক “বিজ্ঞানী” হয়ে উঠলেন? দাবীটা আপাতদৃষ্টিতে অতিসরলীকৃত শোনালেও, ঠিক কোন পথে ব্যাপারটা সম্ভবপর হল, সেটাও তো খোঁজা জরুরী, তাই না??
সেই সময়ে চিকিৎসা ব্যাপারটা নাকি আপাত-বিজ্ঞানসম্মত হওয়ার আড়ালে নৈর্ব্যক্তিক এবং অমানবিক, অন্তত মানবতাবোধহীন, হয়ে উঠছে – এই অভিযোগটা তুলতে শুরু করেছিলেন চিকিৎসকদের একটা অংশ। আর, যেহেতু সেই সময়ের জার্মান বিজ্ঞানী ও প্রথিতযশা চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ ছিলেন ইহুদি, সেহেতু এই নৈর্ব্যক্তিকতার দায় ইহুদিদের ‘পরে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল সুকৌশলে। ইন ফ্যাক্ট, বিজ্ঞান ব্যাপারটাই আর্য জার্মান মহত্ত্বের বিপরীতে চলে যাচ্ছে, এই আশঙ্কা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং চিকিৎসকরা এই বিভ্রান্তির অংশ হয়েছিলেন বেশ আগেভাগেই। বিশ্বাস করানো সম্ভব হয়েছিল, বিজ্ঞানের তথাকথিত অগ্রগতি আদতে এক ছদ্ম-বামপন্থা, প্রচলিত মহত্ত্বের বিপরীতে গিয়ে বিপ্লব ঘটানোর প্রয়াস – এবং এর মূলে রয়েছে ইহুদিরা – এককথায়, জিউইশ বলশেভিজম।
এর বিপরীতে গিয়ে যে রক্ষণশীলতার বাড়বাড়ন্ত, তার শুরু ১৯২০-এর দশকের বিধ্বস্ত অর্থনীতির প্রেক্ষাপট থেকেই। তার আগে পর্যন্ত চিকিৎসকদের মধ্যে আধুনিক উদারবাদী ভাবনা ও উদার বাম ভাবাদর্শের জনপ্রিয়তা ছিল রীতিমতো। কিন্তু, অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রেক্ষিতে উগ্র রক্ষণশীলতার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এবং যাঁরা ছিলেন মধ্যপন্থী, তথাকথিত নিরপেক্ষ, তাঁরাও সরে যেতে থাকেন দুটি মেরুর দিকে – অল্প কিছু অংশ বাম ভাবাদর্শের দিকে, বেশীর ভাগই আকৃষ্ট হন উগ্র দক্ষিণপন্থায়।
১৯২৯ সালেই তৈরী হয় ন্যাশনাল সোশালিস্ট ফিজিশিয়ানস লিগ, হিটলার ক্ষমতায় আসার ঢের আগেই। এবং চিকিৎসকদের মধ্যে সেই সংগঠন জনপ্রিয়তা লাভ করে দ্রুত। কিছুদিনের মধ্যেই সদস্যসংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় তিন হাজারে, জার্মানির মোট ডাক্তারের সংখ্যার প্রায় ছয় শতাংশ। উদার বাম ভাবাদর্শের চিকিৎসক সংগঠনের সদস্যসংখ্যা ছিল এর অর্ধেক। যে রাইখস্ট্যাগ নির্বাচনে জিতে হিটলার ক্ষমতায় আসেন, সেই নির্বাচনে হিটলারের দলের হয়ে ভোটে জেতেন নয় জন চিকিৎসক – বিপরীত সোশ্যালিস্ট পার্টির হয়ে জেতেন মাত্র একজন।
১৯৪২ সাল নাগাদ জার্মানির মোট চিকিৎসকদের মধ্যে অর্ধেকই ছিলেন নাৎসি দলের সদস্য – হ্যাঁ, স্রেফ সমর্থক নয়, সক্রিয় সদস্য। ১৯৩৭ সালে নাৎসি প্যারামিলিটারি সংগঠন এসএস-এ (Schutzstaffel) চাকুরিরত অন্য পেশায় যুক্ত পুরুষ জার্মান নাগরিকের তুলনায় চিকিৎসকের এসএস-এ যোগদানের হার ছিল সাতগুণ বেশী!!
এখানে পুরুষ নাগরিক শব্দবন্ধটি গুরুত্বপূর্ণ – কেননা, নাৎসি ব্যবস্থায় মহিলাদের কাজ বলতে ঘরে বসে সন্তান উৎপাদন করা, বাইরের জগতে তাঁদের দায়দায়িত্ব তেমন থাকার ব্যাপার নেই। নাৎসি মুখপত্রের ভাষায়, বহু শতাব্দীর মধ্যে ন্যাশনাল সোশালিজমের তুল্য পৌরুষ-সম্পন্ন আদর্শের কথা কেউ ভাবেন নি। জার্মান জেনেটিক গবেষক, তথা রেসিয়াল হাইজিন তত্ত্বের অন্যতম অগ্রপথিক ফ্রিৎস লেনজ মনে করতেন, যে নারী, অর্থাৎ জিনগতভাবে শুদ্ধ নারী তাঁর সন্তানধারণে সক্ষম জীবনে অন্তত পনেরোটি সন্তানের জন্ম না দিচ্ছেন, তিনি অন্যায় করছে (লেনজের ব্যবহৃত শব্দটি ছিল আরো কড়া – লেনজ বলেছিলেন, তেমন নারীকে বলা উচিত প্যাথলজিকাল)!!! নাৎসি সরকার অবশ্য অনেক কমেই সন্তুষ্ট ছিলেন – তাঁরা নারীপিছু চারটি সন্তানের ফরমান দিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন। কাজেই, রাজনীতির প্রকাশ্য পরিসরে নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল নামমাত্র – নাৎসি রমরমার বাজারেও, যেমন ১৯৩৫ সালে, নাৎসি পার্টির পঁচিশ লক্ষ সদস্যের মধ্যে মাত্র পাঁচ শতাংশ ছিলেন নারী। কিন্তু, কথায় কথায় অনেক দূরে সরে যাচ্ছি। মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক।
ডাক্তারদের মধ্যে নাৎসি ভাবধারায় আকৃষ্ট হওয়ার কারণগুলো একবার ফিরে দেখা যাক।
মানুষ থেকে মানুষের জাতিগত ফারাকের (Race) বিষয়টি যে চিকিৎসার ক্ষেত্রে অন্যতম মুখ্য বিচার্য, এ ধারণা সেই সময়ে বেশ জনপ্রিয় ছিল। শুধু জার্মানিতেই নয়, প্রথম বিশ্বের প্রায় সর্বত্র। অসুখবিসুখের প্রকৃতিগত ভেদ এবং চিকিৎসায় সাড়া দেওয়ার প্রকারভেদের ক্ষেত্রেও জাতির গুরুত্ব নিয়ে বিজ্ঞানীরা ভাবছিলেন – পরিবেশ বা অন্যান্য নির্ণায়ক বিষয়ের চাইতেও জেনেটিক ফারাকের কথাটাই আগে ভাবার প্রবণতা শুরু হয়েছিল। এবং মনে করিয়ে দেওয়া যাক, এ এমন সময়ের কথা, যে সময় জিনের গঠন বা তার ভূমিকা বিষয়ে মানুষের ধারণা ছিল অনেকটাই কম – একশ বছর আগের বিজ্ঞানে জেনেটিক্স এখনকার তুলনায় অনেকখানি প্রাথমিক পর্যায়ে – অতএব, মানুষে মানুষে বহিরঙ্গের আপাত ফারাকের অর্থ যে মূলগত জেনেটিক গঠনের বিপুল ফারাক নয়, এমনটি যাচাই করে দেখার সুযোগ ছিল না। কাজেই, এই ধারার বিজ্ঞানের যে চর্চাটি চালু ছিল, তার মূলগত হাইপোথিসিসটিই ছিল ভ্রান্ত। কিন্তু, চর্চাটা ছিল – জার্মানিই প্রাণকেন্দ্র হলেও, বাকি বিশ্ব বিপরীতে হাঁটছিল, এমন নয়।
দ্বিতীয়ত, গত শতকের শুরুর চিকিৎসাবিজ্ঞানের, বিশেষত আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্মেষকাল বললে অন্যায় হয় না। বিশেষত, আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা বা মডার্ন মেডিসিন বলতে আমরা যা বুঝি, আমরা যাকে চিনি, তার শুরু ওই সময় থেকেই। তার আগের শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জার্ম থিওরি এসে চিকিৎসাবিজ্ঞানের মূলগত কাঠামোয় একখানা বড় ঝাঁকুনি দিয়েছিল এবং সেখান থেকেই ধীরে ধীরে অসুখবিসুখকে শরীরের অপর বলে দাগিয়ে দিয়ে চিকিৎসাকে যুদ্ধের অনুষঙ্গে অভিহিত করার শুরু। এরই অনিবার্য পরিণতি হিসেবে চিকিৎসা হলে উঠছিল উত্তরোত্তর “বিশেষজ্ঞ”-নির্ভর এবং অংশত পুরোনো আন্তরিকতার অনুভূতির বিপ্রতীপ। মনে রাখা যাক, মার্কিন দেশেও এই সময়েই ফ্লেক্সনার রিপোর্টের সুবাদে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা ও গবেষণার খোলনলচে বদলে যায় – চিকিৎসার গবেষণা এবং হাতেকলমে চিকিৎসা, দুটির মধ্যে ফারাক করে দেওয়া হয় – এবং ব্যাপারটা এমন দাঁড়াতে থাকে, যে, যিনি ওষুধ আবিষ্কারের গবেষণা করছেন, তিনি সাধারণ পরিস্থিতিতে রোগীর শরীরে ওষুধটির গুণাগুণ চাক্ষুষ করতে পারবেন না এবং যিনি সেই ওষুধের ভালোমন্দ সরাসরি দেখছেন, তিনি সেই দেখার অভিজ্ঞতা সরাসরি ওষুধটিকে শুধরানোর কাজে ব্যবহার করতে পারবেন না। এই ভাবনার মধ্যে যুক্তি অবশ্যই ছিল, বিশেষত রসায়নের চমকপ্রদ অগ্রগতির পরে রাসায়নিক-নির্ভর ওষুধ-প্রস্তুতিতে ক্লিনিকাল ডাক্তারের ভূমিকা কমে আসাটা অনিবার্যই ছিল – কিন্তু, এত শতক ধরে চিকিৎসাবিজ্ঞান যে পথে এগিয়েছিল, এই চিন্তাধারা ছিল তার থেকে ভিন্ন পথের অনুসারী। এবং, অনিবার্যভাবেই, চিকিৎসা ও গবেষণার এমন আড়াআড়ি বিভাজন গবেষণাকে করে তুলল অনেকাংশে সরাসরি সংস্পর্শহীন – আরেকদিকে বিশেষজ্ঞের উপর নির্ভরশীলতা ভেঙে দিতে থাকল পুরোনো আন্তরিকতার উপরে দাঁড়িয়ে থাকা রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক। এই পথ ধরে এগিয়েই আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞান ও রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক বর্তমান পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে – এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে বৃহৎ পুঁজির অনুপ্রবেশও সেই সময় থেকেই। কিন্তু, সে নিয়ে বিশদ আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। তবু মাথায় রাখা জরুরী, রোগী-চিকিৎসকের সনাতন সম্পর্কের অধোগতির পিছনে চিকিৎসাশাস্ত্রের ক্রমশ কেবলই বিজ্ঞান হয়ে ওঠাকে দায়ী করার প্রক্রিয়াটি সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা নয় – এবং ইতিহাস সাক্ষী, আধুনিকতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিরক্ত হয়ে আধুনিক গবেষণাকে অস্বীকার করতে চাওয়ার ফল সবসময় কল্যাণকর নয়। আপাতত মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক।
মোদ্দা কথা, চিকিৎসার এই যে ধারাবদল, প্রথাগত চিকিৎসাভাবনা থেকে এমন করে সরে আসা সবাই সেভাবে মেনে নিতে পারেন নি – এবং চিকিৎসকদের একটা বড় অংশের মধ্যেই এ নিয়ে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভ জমা হচ্ছিল। জার্মানিতে সেই মুহূর্তে আধুনিক চিকিৎসাভাবনার যে কটি পীঠস্থান, অর্থাৎ কিনা ইউনিভার্সিটি ও মেডিকেল কলেজগুলি, সেখানে যাঁরা পড়াতেন, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন ইহুদি। ব্যাপারটা আশ্চর্যের নয়, কেননা আধুনিক বিজ্ঞানের সবকটি ধারাতেই তৎকালীন জার্মানিতে ইহুদিদের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল অনস্বীকার্য – বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের মধ্যে ষাট শতাংশই ছিলেন ইহুদি – জনসংখ্যায় ইহুদিদের অনুপাতের চাইতে বহুগুণে বেশী।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মানবিক মুখ হারিয়ে ফেলার অভিযোগের সুবাদে চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই হতে থাকলেন আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান যে পদ্ধতিতে এগোতে চাইছে, তার বিরোধী – আর যেহেতু সেই আধুনিক পদ্ধতিতে ইহুদি চিকিৎসক তথা বিজ্ঞানীদের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল অনস্বীকার্য, চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই নব্য পথের বিরোধতার সাথে সহজেই মিলিয়ে দেওয়া গেল ইহুদি জাতিবিদ্বেষকেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নাৎসি জমানার আগে বার্লিন শহরের ডাক্তারদের ষাট শতাংশই ছিলেন ইহুদি। অতএব, জার্মান চিকিৎসাবিদ্যার হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে হলে ইহুদিদের হাত থেকে ডাক্তারিটা সরিয়ে আনা জরুরী, এই তত্ত্ব খাড়া করতে অসুবিধে হয়নি।
অর্থাৎ একদিকে অন্ধভাবে বিজ্ঞানের অনুসারী হতে গিয়ে চিকিৎসা হারাচ্ছে তার মানবিক মুখ, এই অভিযোগ – আবার আরেকদিকে বিজ্ঞানের যথোচিত গবেষণাই পারে আমাদের সামনে উন্নততর ও খুঁতহীন আর্য জার্মান জাতি সৃষ্টির দরজাটি খুলে দিতে – নাৎসি ভাবাদর্শ এই বৈপরীত্যের মিশ্রণ ঘটিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল।
এককথায়, একটি বিশেষ পথ অনুসরণ করে বিজ্ঞান-গবেষণা এগিয়ে নিয়ে যাওয়াকে উৎসাহ দেওয়া গিয়েছিল, যা শেষমেশ গিয়ে দাঁড়িয়েছিল কনসেনট্রেশান ক্যাম্প ও ডাঃ মেনগেলের পরীক্ষাগারে – ঠিক একইসময়ে বলা হচ্ছিল, আমরা এমন চিকিৎসাবিজ্ঞান চাই, যা হবে আরো মানবিক আরো বেশী করে আন্তরিক, নাৎসি লব্জ অনুযায়ী “আমাদের আরো বেশী করে গ্যেটে-র প্রয়োজন, এবং একটু কম নিউটন” – দুই আপাত-বিপরীতমুখী ও বিপ্রতীপ ভাবনাকে একই প্যাকেজে ভরে উদ্দেশ্যসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছিল।
(চলবে)