ট্রিয়াজ একটি পদ্ধতির নাম
এক গুলঞ্চসন্ধ্যায় আমাদের হাতুড়ে ফটাশের বোতলে চুমুক দিচ্ছিলেন। ফটাশ দক্ষিণ বঙ্গের ট্রেনে বিক্রি হতো। এটায় শুধুমাত্র সোডা থাকে। এখন পেটের দায়ে বেচারি ফটাশ ব্যবসায়ীরা রাস্তায় ঘুরছে। গুণব্রত নামক এক মস্তো দাদামানুষের জন্য নিরীহ হাতুড়ে কোহল বাদ দিয়ে আজকাল শুধু সোডা পান করছেন।
এ্যামন সময়ে বিমলবাবুর চা দোকানে গৌরবাবু এসে বসলেন। বৃদ্ধমানুষ। দেখেই বোঝা যায় আজ মনটা বড়ো খারাপ।
বিমলবাবু বললেন “গৌরদা চা খাবা না?”
গৌরবাবু নিস্তব্ধে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
“কী হয়েছে গৌরদা ক’দিন দেখি নি? কারো অসুখ?”
“ছেলেটাকে সিনহার নার্সিং হোমে ভত্তি করে এলাম”
এটা একটা পাঁচ শয্যার ছোট্ট ডে কেয়ার সেন্টার জাতীয় জায়গা, কেবল স্ত্রীরোগের চিকিৎসা হয়।
“কী হলো আবার?”
“করোনা ..… কোত্থাও বেড নেই…. এদিকে পেশেন্ট খারাপ হয়ে যাচ্ছে…..”
“এ বাবা …. সেকি কথা… সিনহার নার্সিং হোমে ব্যবস্থা আছে?”
গৌরবাবু কথা না বাড়িয়ে চায়ের ভাঁড়ে ঠোঁট ঠ্যাকান।
হাতুড়ে ফটাশের বোতলটা রেখে প্রশ্ন করেন “গৌরবাবু, আপনি ভ্যাক্সিন নিয়েছেন?”
গৌরবাবু ঘাড় কাৎ করে সায় দ্যান।
“ছেলে তো পায়নি… তাহলে ছেলের কী হবে?”
“জানি না গো, অবস্থা তো বলছে ভালো নয় … এখন ওপরওয়ালা ভরসা”
বিমলবাবু বলেন, “আপনার পাশের বাড়ির রায়কাকু শুনলাম ভর্তি রয়েছে?”
“হ্যাঁ। বিরাশী বছর বয়স। খুব খারাপ….যায় যায়… দুসপ্তাহ ধরে যমে মানুষে টানাটানি….. ভেন্টিলেশন চলছে….. আমার ছেলেকেও ভেন্টিলেটরে দিতে বলেছিলো…. সবই অদৃষ্ট …..”
“আপনাদের মনে হয়নি এটা অন্যায়?” হাতুড়ে আনমনে বলেন।
বিমলবাবু সাড়া দ্যান “কোনটা আবার অন্যায় হাতুড়েদাদা?”
“দুটো জিনিস। প্রথমটা হলো এক বছর সময় পেয়েও মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য তৈরি না হওয়া। দ্বিতীয়তঃ এমন একটা ব্যবস্থা চলছে যাতে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শেষ হতে চলেছে। এটা থামাতে হবে।”
গৌরবাবু আগ্রহ দ্যাখালেন “সেটা কী ভাবে?”
“ট্রিয়াজ চালু করতে হবে” (এর কোনও যুৎসই বাংলা প্রতিশব্দ পাওয়া যায়নি, বলা যায় নির্বাচনমূলক চিকিৎসা-সুবিধা)।
ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন এসে সান্ধ্যকালীন আড্ডায় যোগ দিয়েছে। ফটাশের পর বিমলবাবুর চা হাতে নিয়ে হাতুড়ে বললেন “ডাক্তার যাকে মনে করবে তাকেই চিকিৎসা দেবে। বেড থাকলেও বাকিরা বাড়িতে ফেরৎ যাবে।”
“ইল্লি আর কি! আমরা ট্যাক্স দিই, আমরা চিকিৎসা পাবো না? এটা কি মগের মুল্লুক নাকি?” শ্যামবাবু আপত্তি করেন।
বলাইবাবু বলেন “এটা অমানবিকে – এটা হওয়া অসম্ভব – একটা মরণাপন্ন মানুষ হাসপাতালে যাবে আর….”
বিনয়ের আর ভাষা আসে না। ও কমবয়সী- একটু বেশী আবেগপ্রবণ।
হাতুড়ে নিরুদ্বিগ্ন বলতে থাকেন “এটা তো যে কোনও দুর্ঘটনায় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগেই করা হয়। যে খুব খারাপ অবস্থায় আছে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয় আর বাকিরা ফেরৎ যায়। এটাকে প্রাইমারি ট্রিয়াজ বলে”
বিনয়, শ্যামবাবু, বলাইবাবু সবাই একযোগে প্রতিবাদ করেন “এটা আর ওটা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। এখানে চিকিৎসা পাচ্ছে কিন্তু প্রায়রিটি হলো সিরিয়াসনেস আর আপনি মশাই যা বলছেন সেটা একদম উল্টো ব্যাপার।”
মোদ্দা কথায় সবাই বোঝাতে চাইলেন হাতুড়ে একজন উন্মাদ পাগল।
হাতুড়ে হাসলেন “বিনয়বাবু আপনি ভ্যাক্সিন পেয়েছেন?”
বিনয় নেতিবাচক ঘাড় নাড়ে।
“ক্যানো? পাননি ক্যানো? আগামীকাল গিয়ে নিয়ে আসুন”
“আর্রে মশাই, আপনি তো আচ্ছা পাগল! আমার তো বয়সই হয়নি ….”
“সেকি আপনি একজন ট্যাক্সপেয়ার …. আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার আছে ভ্যাক্সিন নেওয়ার… তাই না?”
সবাই নিশ্চুপ।
“এবেলা আপনাদের ট্যাক্স- গণতান্ত্রিক অধিকার সব ভ্যানিশ? এটাও এক ধরনের অবৈজ্ঞানিক ট্রিয়াজ।”
বিমলবাবু চিন্তিতভাবে আর এক কাপ ক্যামেলিয়া সিনেনসিস বা দুগ্ধ শর্করামিশ্রিত চা হাতুড়ের হাতবদল করে দ্যান। বিনয় এবং বাকিরা ভাবতে থাকেন।
হাতুড়ে চা হাতে বলে চলেন “উত্তর ইটালি। হাসপাতালে আর বেড নেই। বারান্দা ভর্তি করোনা রোগী। প্রত্যেকের অবস্থা বেশ খারাপ। কোনও নার্স নেই। নেই মানে থাকা সম্ভব নয়। ডাক্তার নেই। সব রোগী বারান্দায় পড়ে আছে। আইসিইউতে একটা বেড ফাঁকা হলো। ডাক্তার বেরিয়ে এসে প্রথমেই বেশী বয়স্কদের বাদ দিলো….”
গৌরবাবু, বলাইবাবু, বিমলবাবু, বিনয় আঁৎকে ওঠে। গৌরবাবুর হাতের চা চলকে যায়।
“তারপর বাদ গেল যাদের বাঁচার আশা প্রায় নেই তারা….”
দুধ টগবগ করে ফুটছে উথলে যায় যায়, বিমলবাবুর হুঁশ নেই “ক্যানো হাতুড়েদা?”
“কেননা একজন বৃদ্ধ এমনিতেই ভেন্টিলেটর ইত্যাদি নেওয়ার পর অনেক সময় আর বেরিয়ে আসে না- অথবা বড্ড দীর্ঘ সময় হাসপাতালে থেকে যায়। সেই সময়ের মধ্যে অনেক অনেক পেশেন্ট বঞ্চিত হবে”
দুধ উথলে পড়ে। বিনয় জিজ্ঞেস করে “আর খুব খারাপ পেশেন্ট …. তাকেও নেবে না?”
“না অকারণে একটা বেড আটকে রাখা যাবে না। যাকে বাঁচানোর সম্ভাবনা কম তার জন্য প্রয়োজনীয় বেড আটকে রাখা যাবে না। (*ট্রিয়াজ, ইটালি, ডাক্তার বার্টেলমিও, উত্তর ইটালি, লোদা হাসপাতাল)।
বিনয় বললো “সত্যি?”
হাতুড়ে হাসলেন। “আমাদের দেশে ট্রিয়াজ চালু না হলে দেশের তরুণ প্রজন্ম বা জেন নেকস্ট শেষ হয়ে যাবে।”
বিমলবাবু প্রশ্ন করেন “ক্যানো?”
“য্যামন গৌরবাবুর সন্তান খারাপ অবস্থায় পাড়ার নার্সিং হোমে মৃত্যু প্রতীক্ষা করছে সেই রকম। আরও গরীব মানুষের তো ছোটো নার্সিং হোমে ভর্তি করার পয়সাটুকুও নেই … ”
“সরকারি হাসপাতাল?”
“একটা কাগজে পড়ছিলাম ভারতবর্ষে মোট সরকারি হাসপাতালে বেডের সংখ্যা সাত লক্ষ তেরো হাজার নশো ছিয়াশি, মানে এক হাজার মানুষের জন্য শূন্য দশমিক পাঁচটি বেড। কঠিন লাগছে? তাহলে শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য শূন্য পাঁচ (0.0005) জনের জন্য একটা বেড”
বিমলবাবু বললেন “বাবাগো….. দোকান বন্ধ করলে না খেয়ে মরবো আর খোলা রাখলে করোনায় ….. ”
“কমবয়সী বলে ভ্যাক্সিন পাবো না আর করোনা হলে বেড পাবো না” বিনয় কপাল চাপড়ায়।
বলাইবাবু বলেন “আমি এখনো ভ্যাক্সিন পাইনি – শুনছি বেডও নেই”
হাতুড়ে ক্যানো জানি বলেন “চমৎকার। এক বছরে না হলো লড়াইয়ের প্রস্তুতি- না হলো প্রতিরোধের ব্যবস্থা। চলো করোনা তরঙ্গে ভেসে যাই।”
Darun