এই পোস্ট করেছিলাম বছর চারেক আগে। আজকের দিনে। করোনা তখনো পয়দা হয়নি। কিন্তু টিবি নামক বেমারি ছিল। সেই বেমারি আরো জাঁকিয়ে বসেছে দুনিয়াতে। প্রতি কুড়ি সেকেন্ডে একজন করে মারা যাচ্ছে টিবিতে, পৃথিবী জুড়ে। এবং ভারতবর্ষ সেই মৃত্যুর সিংহভাগ বহন করে চলেছে। এ চিত্র বদলাচ্ছে না। এ চিত্র ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। এবং তবুও এ রোগ নিয়ে কেউ কিছু বলছে না। তাই, রিপোস্ট।
পড়ে দেখতে পারেন। একটাই অনুরোধ, আমি সব কমেন্টের উত্তর দিতে সমর্থ নাও হতে পারি। সেটা আমার উন্নাসিকতা নয়, সেটা আমার অপারগতা। ক্ষমা করবেন। পারলে, নিম্নলিখিত নিয়মগুলো মেনে চলবেন। নয়ত , মাক্কালি বলছি, করোনাতে মরুন বা বাঁচুন, টিবিতে মরে যাবেন একদিন। চিত্রটা ভালো না। একদমই না।
ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ
————————
আপনাকে কিঞ্চিৎ বাস্তবের পৃথিবীটা দেখাই।
**********
গতকাল ছিলো—২৪ শে মার্চ।
গতকাল ছিলো— ওয়ার্ল্ড “টি বি” ডে।
আ-মরি বাংলা ভাষায় যাকে বলে–
বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস।
অবশ্য আ-মরি ভাষাটির অবস্থা, আজকাল ক্রমশঃ পড়তির দিকে।
বাঙালি বরাবরই অতিথি পরায়ন।
ভালোবেসে আপন করে নেয় প্রায় সক্কলকে।
আর তাই করে করে, এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, যে, লোকে আ- মরি পড়তে গিয়ে অনেক সময় ভুল করে,আমরি (AMRI) পড়ে ফ্যালে ।
অবশ্য সেই ভাবে ভাবতে গেলে,
“আমরি”রও কিছুটা ভূমিকা আছে বই কি বিশ্ব যক্ষা দিবসে!
অন্তত আমার জীবনে তো আছেই।
ব্যাপারটা তাহলে খুলে বলি।
গতবছর,
যক্ষ্মা দিবসের ঠিক আগের রাত্তিরে আমার দাঁতে ব্যথা শুরু হলো। প্রথম দিকটায়, কান কটকট, মাড়ি দপদপ ব্যথা…তারপর ক্রমে ক্রমে ক্রমে, বাড়তে বাড়তে একসময় সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে, কেবলমাত্র একটি অনুভূতিই প্রকট হয়ে রইলো—-
আমার মুখের বাম দিকটা অসহ্য যন্ত্রনায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।
ভীষন, ভীষন, ভীষন রকমের যখন যন্ত্রণা হয়, তখন কিরকম জানি একটা ঘোরের মতো লাগে।
মনে হয়, ব্যথার স্থলটুকু ছাড়া, বাদবাকি শরীরটা মরে টরে গ্যাছে নিশ্চিত।
আমি চোখ বন্ধ করে, বিছানায় বাঁ পাশ হয়ে, একটু একটু করে সেই ব্যথার ঘোরে ডুবে যাচ্ছিলাম।
ভোরের দিকটায়, চোখটা সামান্য –লেগেছিলো।
ফটাস করে ভেঙে গ্যালো সাতটা দশের অ্যালার্মে।
আর ঘুম ভেঙে উঠেই, প্রথম যে অনুভূতিটা ফিরে এলো, সেটা যন্ত্রণার। সেটা দপদপানির।
পাত্তা দিলাম না। হুড়মুড়িয়ে জামা প্যান্ট পরে, স্কুটি চালিয়ে রওনা দিলাম, সদর হাসপাতালের দিকে।
সাড়ে আটটায়, ওখান থেকেই শুরুয়াৎ হবে , পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য এবং জনকল্যাণ দপ্তরের উদ্যোগে– যক্ষ্মা দিবস পথ যাত্রা।
এই পথ যাত্রা প্রদক্ষিন করবে সমস্ত জলপাইগুড়ি শহর।
অংশগ্রহন করবেন চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, ক্লাব এবং যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত রুগীরা। মিছিল থেকে ছুঁড়ে দেওয়া হবে লিফলেট—
” হাঁচি বা কাশির সময় বাহু ঢেকে হাঁচুন কাশুন।
যেখানে সেখানে কফ থুথু ফেলবেন না।
দু’সপ্তাহের বেশি নাগাড়ে কাশি হলে, নিকটবর্তী সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কফ পরীক্ষা করান।
টিবি রোগের চিকিৎসা হাসপাতালে বিনামূল্যে করা হয়”।
বছর কয়েক আগে তো এমন কি, স্লোগান পত্তর লেখা, টি শার্ট অবধি বিতরন করা হয়েছিলো পথচারীদের।
কে বললো? ঠিক কেএএএ বললো বলুন তো,
” সরকার কিছু করে না!”??
এই পথযাত্রা, তাই আমার বেজায় প্রিয়।
স্বাস্থ্য দপ্তরে যোগদান করেছি আজ এগারো বছর হলো।
স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করা ক্রমশঃ কঠিন থেকে কঠিনতরো হয়ে উঠেছে এই এগারো বছরে। প্রতিনিয়ত… প্রতিমুহূর্তে মারমুখী সবজান্তা জনতা, চামড়া খুলে ডুগডুগি বাজাতে উদ্যত।
তবুও আমি হাল ছাড়ি নি।
তবুও, আমরা যারা, সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাথে যুক্ত,
তারা কেউই হাল ছাড়ি নি।
আর কে কি মনে করে জানি না,
আর কে কোথায় ” গভীর ষড়যন্ত্র” এর সন্ধান পায় জানতে চাই না,
শুধু এটুকু জানি, আমি শেষ মুহূর্ত প্রযন্ত কায়মনোবাক্যে — পরিষেবা দিয়ে যেতে প্রস্তুত।
এবং, আমি এটাও জানি যে,
সরকার, এখনও, আজও, প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে চলেছে, প্রতিটি মানুষকে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার।
” সরকার শালা কিছুই করে না” দেগে দিয়ে,
ভেগে যাওয়ার চাইতে,
আমি চাইবো,
নিজে এগিয়ে এসে সমাধান সূত্র খুঁজতে।
যাক গে যাক।
জ্ঞান ফ্যান মারিয়ে লাভ নেই!
সব্বাই মিলে এইবারে আমাকে সবুজ না লাল না গেরুয়া কোন রঙে রাঙাবেন , সেটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়ার আগে, মূল গল্পে ফিরি।
পথযাত্রার গল্প।
দাঁতব্যথার গল্প।
আ-মরি এবং আমরির গল্প।
একটু ডি ট্যুর করবো?
প্লিস প্লিস। একটু করি? এ- ক- টু-উউ।
করি ক্যামোন।
আ-মরি/আমরি বলতে গিয়ে আসলে মনে পড়ে গ্যালো,
‘যক্ষ্মা’ কথাটার মানে কেউ বোঝেই না। বোঝে “টি.বি”।
মাক্কালি।
আমি দেখেছি।
রোগীকে গম্ভীর মুখ করে–
” আপনার যক্ষ্মা হয়েছে” বললে,
রোগী একগাল হেসে জবাব দেয়–
” যাক্, তাইলে টিবি নাই”।
এরকম ঘটনা অবশ্য আরো অনেক আছে।
কিন্তু এটা কিনা ডিট্যুর,
মূল গল্পটা কিনা অনেকক্ষন অপেক্ষা করছে…
তাই সেরা উদাহরণটাই এক ঝটকায় দিয়ে দিই।
আমি এগারো বছর ধরে মোটামুটি ভাবে যা বুঝলাম সেটা হলো এই যে–” আপনি যদি প্রেশার মাপেন, আপনি তবে ভালো ডাক্তার… আর যদি না মাপেন, তবে আপনি ফালতু”
রুগীর পেটখারাপ হোক বা খোস পাঁচড়া, প্রেশার মাপাতে চায় সব্বাই ।
প্রেশার মাপার যন্তরটার প্রতি, মানবসমাজের এক অমোঘ আকর্ষণ। মাথাফাটা,খাটে ওঠা রোগীর আত্মীয়স্বজনকেও আমি বলতে শুনেছি দাঁত কেলিয়ে–” ডাক্তারবাবু, আমার প্রেশারটাও একবার একটু…”।
প্রথম প্রথম বিরক্তি আসতো।
তারপর উষ্মা।
তারপর ক্রমে হতাশা।
আর এখন?
এখন কিছুই আসে না।
এখন এটা মেনে নিতে শিখেছি যে,
চুল্লিতে ঢোকার ঠিক আগটাতে,
ঘাটের এবং খাটের মড়াও তড়াক করে উঠে বলতে পারে–
” মরতে পারি…কিন্তু ক্যানো মরবো? আগে প্রেশার মাপা হোক”
তো এই প্রেশার টেসার মেপে ঝুপে, আমি যখন ঠোঁটে চুকচুক করে বলি–
” প্রেশারটা বেশি গো..লবণ খেও না পাতে..”
তখন অবধারিত ভাবে একটিই কথা শুনি–
” বেশি? মানে হাই না লো?”
লে হালুয়া।
বললাম না– ” আ-মরি”?
আরেকটা ছোট্ট ডি ট্যুর যদি করি, আপনারা কি খুউউব ক্যালাবেন?
মানে ক্যালাতেই পারেন,
স্বরাজের পর এই একটি মাত্র জিনিষই আপনাদের জন্মগত অধিকার,
এবং সেটি
” ডাক্তার ক্যালানো”।
তা ক্যালান।
ক্যালানির ভয়ে ডাক্তারি ছাড়ি নি যখন, ডিট্যুর তো কভি নেহি।
বেশ কিছু বুড়ো বুড়ি আসে আমার আউটডোরে মাথা ঘোরার উপসর্গ নিয়ে, যাঁদের প্রেশার মেপে যখন বলি ” হাই”, তেনাদের মুখ ঝুলে যায়।
চোখেমুখে স্পষ্টত হতাশা।
” সে কি গো…আমি দুব্বল মানুষ…দু’বেলা ভালো করে খেতে দ্যায় না বউমা..তাও হাই?”
বোঝো!
আসলে, নিপীড়িত মানুষের ট্রেডমার্ক বোধহয় লো প্রেশার এবং হরলিক্স না খেতে পাওয়ার হতাশা।
অঞ্জন চৌধুরীর ” ছোটোবউ” মনে আছে?
কালি ব্যানার্জ্জি এবং হরলিক্স সোহম?
ডিট্যুর শেষ।
মূল গল্প শুরু।
যক্ষাদিবস পদযাত্রা।
হাঁটতে হাঁটতেই টের পাচ্ছিলাম দপদপানি ব্যথাটা, আবার ঘিরে ধরছে আমাকে।
কেমন জানি একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে হাঁটছিলাম আমি মিছিল পায়ে পা ফেলে ফেলে।
পথযাত্রার পরেই আউটডোর।
সেখানে ছুটতে হবে একটুবাদেই।
পারলে এখনই।
কিন্তু….আমি আর পারছিলাম না।
একটু একটু করে এবার হার স্বীকার করছিলাম, যন্ত্রণার দংশনে।
আমার পরিচিত এক ডেন্টিস্ট ভদ্রলোক আছেন। আমার চাইতে বছর খানিকের বড়ো।
হুড়মুড়িয়ে গেলাম তাঁরই চেম্বারে।
এবং সবকিছু দেখে শুনে তিনি নিদান দিলেন–
” সমূলে উৎপাটন”।
শুনে তো আমার মাথায় বাজ।
কলেজে যখন পড়তাম, তখন একটা বিচ্ছিরি অ্যাক্সিডেন্টে, আমার চোয়াল ভেঙে গিছ্লো খড়াৎ।
রাম শ্যাম যদু এবং মধুর মতো সহজে দ্ন্ত উৎপাটন পদ্ধতি, তাই আমার ক্ষেত্রে অচল। আমার দাঁত যদি একান্তই তুলতে হয়, তবে সেটা তুলতে হবে এক্কেবারে অজ্ঞান করে।
এখানকার ডাক্তাররা রিস্ক নিতে চাইলেন না।
অগত্যা– কোলকাতা।
অগত্যা আমরি।
আজ্ঞে হ্যাঁ, আমরি।
আ-মরি নয়।
এবং সেই ‘আমরি’তে,
ছয় ঘন্টার ঘোরতর অপারেশনের পর, ছয়খানি দন্ত উৎপাটন — সফল।
দাঁত প্রতি, একঘন্টা। জ্জিও।
না,না, সব কটি দাঁত ফেলনা ছিলো না মোটেও।
কিন্তু, বারবার অজ্ঞান করে, দাঁত তোলার বিপদ অনেক, তাই সামান্যতম দাগী দাঁতও– দূর হঠো।
অপারেশনের পর পরেই খেতে পারতাম না কিচ্ছুটি।
একলা রাতে, বালিশ ভিজিয়ে কাঁদতাম রোজ রোজ–
আমার বুঝি খেতে ইচ্ছে করে না?
আমাকে বুঝি ছত্তিরিশেই দিন গুজরান করতে হবে–হবিষ্যান্ন খেয়ে?
তারপর একটা সময়,
ক্রমে ক্রমে সয়ে গ্যালো সবটাই।
নাহ্,
এখনো আমি সব কিছু খেতে পারি না আয়েশ করে এক চোখ বুজে….
কিন্তু খুশি থাকতে শিখেছি এইটা ভেবে,
যে, কিছু তো অন্তত খেতে পারছি গপাগপ … অনেকে তো সেটাও…..
মোটমাট কথা এইইই যে, এইবারের বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসে, আমি পথে হাঁটলাম ফির সে।
পথে হাঁটলাম দৃঢ় প্রত্যয়ে।
পথে হাঁটলাম,বিশ্বকে যক্ষ্মা মুক্ত করার প্রয়াসে।
লেখাটা এখানেই শেষ করে দিতে পারতাম।
বেশ একটা “মহান সেনানী-সেনানী” মার্কা ইমেজ তৈরি হয়ে গেছে শেষ কয়েকটা লাইনে।
এখানেই যদি শেষ করি, নির্ঘাত গোটা বিশেক কমেন্ট পাবো—
” ডাক্তারবাবু আপনি কি ভালোওওও”, ” সব্বাই যদি আপনার মতো হতো…”
এসব কমেন্টের উত্তরে বিনয় দেখিয়েও, কলার তোলার সুযোগ থাকে বিন্দাস–
” দ্যাখো আমি বিনয়ী..ইয়াম্মি”।
কিন্তু সেসব বোকা বোকা কলার তোলার পরিতৃপ্তি দূর হঠুক।
আমার কাঁধে,
ফেসবুক লেখক হিসাবে, বাংলার চিকিৎসক হিসাবে, পৃথিবীর নাগরিক হিসাবে,
আরো ঢের ঢের ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ন্যস্ত।
এ বিশ্বকে যক্ষ্মা মুক্ত করবো আমি।
নিজেরই কাছে, এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
কিন্তু গুপি গাইন সেই যে বলে গিছ্লো–
” এক হাতে তো তালি বাজে না”,
সেই যে শিখিয়ে গিছ্লো,
যাদুজুতো পরে, আশমানে উড়াল দিতে হলে, নিকটজনের হাতটি ধরা, বড্ডো প্রয়োজনীয়….
তবেই বাজবে তালি…
তবেই উড়বো, আমরা সবাই,
কাঁধে কাঁধ, গলাগলি…
তাই,
এ লেখা,
এখানে শেষ করবো না।
শেষ করবো না ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না, আপনিও হাতটা বাড়িয়ে দ্যান,
আমার হাতের দিকে।
এ লেখার শেষটুকু তাই, আপনার ঘুমন্ত মননকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা মাত্র।
দিনকয়েক আগে, আমারই এক চিকিৎসক বন্ধু, একটি ফেসবুক পোস্টে, আতঙ্কিত হয়ে, লিখেছিলেন একটি প্রবন্ধ। যার সারমর্ম–
” আমার( বন্ধুটির) হাসপাতালে, চারজন স্বাস্থ্যকর্মী একের পর এক টিবি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন… এবার যদি আমারও ( বন্ধুটির) টিবি হয়?”
সেই পোস্টে লাইক পড়েছে হুড়মুড়িয়ে…. কান্নার, হতাশার…..ভালোবাসার সব ইমোজি।
কমেন্টের পর কমেন্ট–
” ডাক্তারবাবু, আপনার কিচ্ছু হবে না…ডাক্তার বাবু, ভগবানের রোগ হয় না…”
এসব কমেন্ট দেখে, আমি হেসেছি মনে মনে।
এসব মন্তব্য পড়ে, আমি কেঁদেছি সঙ্গোপনে।
মাসখানিক আগে, আমি “বেয়াড়া ব্যাকটেরিয়া” নামে একখানা, লেখা দিয়েছিলাম এই ফেসবুকে।
লেখাটা টিবির ওপরেই।
এবং সেই লেখার এক এবং একমাত্র উপজীব্য ছিলো এইইইই যে–
” দাদারা এবং দিদিরা,
যদি ভেবে থাকেন, যে, এই পোস্টে লাইক মেরে, এবং ” বাহবা সব্যসাচী” বলে, আপনি আপনার দায়িত্ব সারবেন, তবে বেজায় ভুল করছেন।
সচেতন হন।
সময় থাকতে থাকতে, সচেষ্ট হন লড়াইয়ে। নইলে শিগগিরই একদিন সভয়ে আবিষ্কার করবেন, আপনি নিজেও টিবি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন”
আমার বন্ধুটির, সাম্প্রতিক ফেসবুক পোস্টটি, আমার মাস খানেক আগে করা পোস্টের স্বপক্ষেই, হাতে গরম প্রমাণ।
প্রতি, আড়াই মিনিটে, একজন করে, টিবি রুগি মরে যায় এ দেশে।
বুঝলেন?
মানে,
এই যে, এইইই লেখাটি, আপনি যখন পড়ে শেষ করে উঠলেন, তখন, তারই মধ্যে, গোটা দশেক মানুষ মৃত্যু বরণ করেছেন যক্ষ্মায়।
এবং শুধু মৃত্যুই বরণ করেন নি, ছড়িয়ে গ্যাছেন, আসপাশের মানুষকে, শমন ব্যাকটেরিয়া।
একজন টিবি রোগী, প্রতি বছরে, দশ থেকে পনেরো জন মানুষকে টিবি রোগে সংক্রামিত করে থাকে, যদি, তার চিকিৎসা না করা হয়।
বীজ গণিতের ‘ জি পি’ বা ‘ জিওমেট্রিক প্রগ্রেশন’ মনে আছে তো?
হিসাবটা, তাহলে এবার কষে নিন।
আপকা নম্বর ভি, জল্দ হি আয়ে গা।
এই ভাবে চললে—” পরের যক্ষা রুগী আপনিই”
অতএব, সাবধান হওয়া জরুরী।
তা, কিভাবে হবেন সাবধান?
ঠিক কি কি করলে আপনার টিবি রোগ হবে না?
শুনলে হয়তো হতাশই হবেন যে, এমন একটিও উপায় নেই, যা আপনাকে ” টিবিপ্রুফ” করে তুলতে পারে।
উঁহু।
সাধে কি আর আমি, সব্যসাচী সেনগুপ্ত , এদের নাম দিয়েছি, বেয়াড়া ব্যাকটেরিয়া?
এই শ্লা, কেমন কায়দা করে নিজের নামটা ঢুকিয়ে দিয়েছি খেয়াল করলেন?
কপি পেস্ট মালগুলো, চুরি করতে পারবে না আর!
যাক গে যাক,
অতোটা মুষড়ে পড়ারও কিছু নেই।
চাইলে, পেস্ট করার পূর্বে, এই অংশটুকু মুছে নেবেন…
মাল আপনার।
কিন্তু ফায়দা আমার।
কারণ , এতে করে,আরোওওও কিছু লোক আপনার ওয়ালে এ লেখা পড়বার সুযোগ পাবেন।
এবং,
অতোটা মুষড়ে পড়ার কিছুই নেই, তার আরো একটা কারণ হলো এই যে,
ক্ষীণ হলেও, টিবি এড়িয়ে চলার কিছু উপায় আছে।
প্রথমত–
জন্মের পর বিসিজি ভ্যাকসিন।
না, এতে টিবি রোগ আটকাবে না, কিন্তু রোগটিকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বাড়বে ( এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে)।
নাম্বার টু–
যেখানে সেখানে কফ থুতু ফেলবেন না। নিজেও ফেলবেন না, অন্যকেও ফেলতে দেখলে বারণ করবেন।
বুঝিয়ে বলবেন, কফের মধ্যে থাকে জীবাণু।
তিন–
হাঁচি বা কাশির সময় এই নিচে বর্ণিত ছবিটির মতো করে নাক মুখ চাপা দিন।
হাত দিয়ে নয়…
বাহু বা রুমাল দিয়ে।
নইলে, হাতে লেগে থাকা কফ, হ্যান্ডশেকের সময় বা কাজ করতে গিয়ে, চালান হয়ে যাবে অন্যত্র।
পারলে হ্যান্ডশেক বর্জন করে ষোলোআনা বাঙালিয়ানা ফিরিয়ে আনুন।
” নমস্কার ” করুন।
বিনা প্রয়োজনে,হ্যান্ড-রেলিং ছুঁয়ে ছুঁয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার অভ্যাস ত্যাগ করুন।
এবং হ্যাঁ, নিজের ছেলে মেয়ে বউ বাপ মা মাসি পিসি বনগাঁ বাসী, সক্কলকে এই হাঁচি কাশির বিষয়টি শেখান।
চার–
কর্মস্থল, এবং বাসস্থল,
সর্বত্র জানলা দরজা খোলামেলা রাখবেন ( রাতে নয়, রাতে তো ডাকাইতের ভয়)।
তথ্য বলছে, কোনো একটি রুমের সমস্ত হাওয়া, যদি এক ঘন্টায় দশ থেকে পনেরো বার রিপ্লেসড হয় তাজা হাওয়া দিয়ে,
তবে টিবি রোগ ছড়াবার সম্ভাবনা কম।
মানে,
সোজা কথায় বলতে গেলে,
ঘরের ভিতরের হাওয়া আর বাইরের হাওয়া, যদি স্থান পরিবর্তন করে, ঘন্টাপ্রতি দশ পনেরো বার,
তাহলেই কেল্লাফতে।
তাই, ঘরদোর খোলামেলা রাখুন।
আমার চিকিৎসক বন্ধুদের বলি,
রাউন্ডে গিয়েই, নির্দেশ দেবেন, সব জানালা দরজা খুলে দিতে।
এতে প্রাথমিক,–” হাউ মাউ.. জানালা খুললে বেড়াল ঢোকে..” এসব হবে,
কিন্তু বায়ুঘটিত সংক্রমণজনিত রোগ থেকে পেশেন্টরা এবং আপনারা, বাঁচবেন।
পাঁচ–
খামোখা মুখে হাত দেওয়া, নাক খোঁটা, দাঁতে নখ কাটা, এসব পরিত্যাগ করুন। এভাবেও টিবি ছড়ায়।
” দ্যাখো বস… আমার অতো টাইম নেই.. আমি হাত ফাত না ধুয়েই খাই, তারপর আবার কাজে লেগে যাই”
এসব পেঁয়াজি বন্ধ করুন।
দুপুরে বা রাতের খাবারের আগে হয়তো প্রায় সবাইই হাত ধুয়ে থাকেন, কিন্তু সেই একই অভ্যাস বজায় রাখুন , বিস্কুট খাওয়ার ক্ষেত্রেও।
“কি করে ধোবো, জল কোথায়, কাজের যা চাপ… ”
এসব প্লিস, মাইরি প্লিজ, বলতে আসবেন না।
ছয়–
বছরে একবার করে সুগার টেস্ট করান। ডায়াবেটিস হলে, টিবি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় দড়াম করে।
সাত–
নিজের বা ওই মাসি পিসি বনগাঁবাসীর দু’সপ্তাহের বেশি নাগাড়ে কাশি হলে, নিকটবর্তী,
সরকারী
সরকারী
সরকারী
এবং সঅঅঅঅরকাআআরিইইই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনা পয়সায় কফ পরীক্ষা করান।
বেসরকারি ল্যাবেগুলোর,
সিংহ বা বাঘ বা ডাইনোসর ভাগেরই, টিবি রোগ ধরবার মান্যতা নেই।
ইউনিভার্সাল অ্যাকসেস বলছে–
” আপনি চাইলে, সরাসরি হাসপাতালে গিয়ে বলতে পারেন, আমি কফ পরীক্ষা করাতে চাই”
আট–
আমার চিকিৎসক বন্ধুগণ, প্লিজ, যে সমস্ত অ্যান্টিবায়োটিক টিবি জীবাণু মারতে সাহায্য করে, সেগুলো, নিতান্ত অনন্যোপায় না হলে, অন্যত্র ব্যবহার করবেন না।
মাথায় রাখবেন, এতে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি বাড়ছে। এবং সেটা, আপনার নিজেরও হতে পারে। তখন কেঁদে লাভ নেই।
নয়–
দাদা দিদি ভাই বোন চুন্নু মুন্নু টুন্নু,
শুনে রাখুন, আপনি বা ওষুধের দোকানদার , ডাক্তার নয়। তাই যদি হতো, তবে বইয়ের দোকানের মালিক হতেন শিক্ষক। ” একটা কাশির অ্যান্টিবায়োটিক দিন তো দাদা, একটা পেটখারাপের বড়ি দেখি..” বলাটা বন্ধ করুন। শেষটায় আপনার যদি টিবি হয়, তবে টিবির ওষুধ কাজ নাও করতে পারে কিন্তু।
নয়টা পয়েন্ট হলেই যথেষ্ট ছিলো।
কিন্তু কথায় আছে –” দেশে ও দশে”
কবিতায় আছে –” হারাধনের দশটি ছেলে”
সিরিয়ালে আছে–” দশ কা দম”
এমনকি, সদ্য নির্মিত ঝাঁ চকচকে মাল্টি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল গুলিও–” দশতলা”
তাই,
পয়েন্ট নাম্বার
দশ– এই পোস্ট যদি কেউ, আদপেও শেষ অবধি পড়ে থাকেন, তবে উপরিউক্ত নয়টি বিষয় মনে প্রাণে মেনে চলুন। অন্যকেও শেখান। এবং হ্যাঁ, শিশুদের শেখান। শিশুরা ছোটো থেকেই হাঁচি কাশির এটিকেট শিখুক..
ভবিষ্যতটা, ওরাই গড়বে।
আজ এ পর্যন্তই থাক।
পরে যদি কোনোদিন এ বিষয়ে কলম ধরি, তবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেব, সরকার কতকিছু করে চিকিৎসা খাতে।
শেয়ার করতে চাইলে করুন।
অনুমতি চাইবার প্রয়োজন নেই।
( ছবিটি,
আমার আঁকা,
নেট ঘেঁটে, এবং আউটডোরের শেষে…..)