প্রথম: আজকের দিনে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং মহকুমা, স্টেট জেনারেল, জেলা ও সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল যেখানে অভিজ্ঞ স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ, Anaesthetists, অন্যান্য বিশেষজ্ঞ, প্রশিক্ষিত দক্ষ নার্সিং স্টাফ এবং যাবতীয় ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে গুরুতর কোন অসুখ না থাকলে এবং সময়মত এলে একজনও প্রসূতির মৃত্যু হওয়ার কথা নয়। অথচ রোজই দেখছি আমাদের রাজ্যের কোথাও না কোথাও এই মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটেই চলেছে।
দ্বিতীয়: ঠিকই। অমার্জনীয় অপরাধ। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার এখানে সরকার, স্বাস্থ্য দপ্তর, সেই মেডিকেল কলেজ বা হাসপাতাল, সেখানকার চিকিৎসক ও নার্সিং স্টাফ কারও যেন কোন দায়দায়িত্ব নেই। এ ওর দিকে দেখিয়ে দায় এড়াছেন। তদন্ত কমিটি যদিওবা হয় তার ফল কি হয় আমরা জানতে পারিনা। মিডিয়াতে কিছুদিন হৈ চৈ হয় তারপর যে কে সেই।
প্রথম: আগে হয়তো কিছু ছিল, কিন্তু এখনকার মত স্বাস্থ্যে সর্বব্যাপী দুর্নীতি কখনও গ্রাস করেনি। এখন প্রভাবশালী মন্ত্রী, রাজনীতিক নেতা, আমলা, স্বাস্থ্য আধিকারিকরা শুনি উৎকোচ গ্রহণ করে অত্যন্ত নিম্ন মানের এমনকি ক্ষতিকর সব ওষুধ, ইনফিউশন, সরঞ্জাম ইত্যাদি মানুষের করের টাকায় খরিদ করেন এবং সেগুলি সাধারণ ও গরীব রোগীদের উপর দিনের পর দিন প্রয়োগ করা হয়। চিকিৎসকরা অসহায় এবং নীল সাদা উচ্চকিত প্রচারের মধ্যে সাধারণ মানুষ খুব বিপদের মধ্যে থাকেন।
দ্বিতীয়: আবার কিছু চিকিৎসক ও নার্সিং স্টাফের দেখি বেপরোয়া মনোভাব। যখন যে দল ক্ষমতায় তার প্রভাবশালী কোন নেতার সঙ্গে লাইন আপ করে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। রোগীকে ঠিকমত পর্যবেক্ষণ তো দূরের কথা দেখেনই না, প্রসূতির প্রসবের সময় উপযুক্ত যত্ন নেন না। অনেক চিকিৎসকই রয়েছেন সারাদিন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে বেড়ান, হাসপাতাল থেকে পুরো মাইনে নিলেও সেখানকার কাজ তাদের কাছে গৌণ। কেউ কেউ তাড়াহুড়ো করে সিজার করে নার্সিং স্টাফ, জুনিয়র ডাক্তারদের উপর সব ছেড়ে চলে যান, আর রুগীকে খেয়াল করেন না। অথচ এই সময়টাই প্রসূতি ও নবজাতকদের কাছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। আর এই সময়েই অঘটনগুলি বেশি ঘটে। প্রায় ৩৫ বছর স্বাস্থ্য প্রশাসনে থেকে এরকম কয়েকজন অপরাধীর বিরূদ্ধে তদন্ত করে দোষ প্রমাণ করে রিপোর্ট ডিএইচএস, ডিএম, সিএমওএইচ দের কাছে দিয়ে এসেছি। কারো কিছু হয়নি, বহাল তবিয়তে একইরকম কাজ করে গেছে।
প্রথম: গতকালের মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিষয়টি দেখুন। এতদিন অন্যত্র লুকোছাপা ও ধামাচাপা দিতে পারলেও প্রকাশ্যে চলে এলো এগিয়ে বাংলা কোম্পানির তৈরি বাতিল হওয়া ও নিম্ন মানেরই শুধু নয় সংক্রমিত ও বিষাক্ত Ringer’s Lactate Infusion প্রয়োগ এর ফলে এক তরুণী প্রসূতির মৃত্যু এবং চারজন প্রসূতির আশঙ্কাজনক অবস্থা়।
দ্বিতীয়: আপাদমস্তক দুর্নীতিতে মুড়িয়ে ফেলা এই এগিয়ে বাংলায় তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়ার নামে কি হবে আমরা জানি। কিন্তু এই অমূল্য প্রাণগুলো আর ফিরে আসবেনা, নবজাতকরা তাদের মায়েদের কোনদিন কাছে পাবে না। গরীব রুইদাস চর্মকার দলিত পরিবার। নানাভাবে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপ দিয়ে কিছু অর্থের বিনিময়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হবে।
প্রথম: কিন্তু আর কতদিন, কত বছর চলবে সরকার ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এইরকম সংগঠিত দুর্নীতি, নির্মম অবহেলা এবং প্রাতিষ্ঠানিক হত্যাকান্ড? আর কতদিন স্বাস্থ্যের মত গুরুত্বপূর্ণ, টেকনিকাল ও স্পর্শকাতর বিষয়ের দায়িত্বে থাকবেন স্বাস্থ্য বিষয়ে অজ্ঞ, দুর্নীতির প্রশ্রয় দাত্রী, অপদার্থ ও সম্পূর্ণ ব্যর্থ এক স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং তার তৈরি করে দেওয়া অপদার্থ ও দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাদের ঘোট?
ভুলে যাবেন না শহীদ তিলোত্তমা কাজ না হওয়া, উল্টে রোগীদের ক্ষতি করা, এই ভেজাল ওষুধ ব্যবহারের প্রতিবাদ করেছিলেন খোদ চরম অনুপ্রেরণাপ্রাপ্ত সন্দীপ মাফিয়া কে। তাঁকে হত্যা করা হয়, তাঁর প্রতিবাদকে হত্যা করা করা হয়, তাঁর বিচারকেও হত্যা করা হয়।হত্যা করা হয় তাঁর হত্যার প্রতিবাদে চলমান আন্দোলনকেও।
দ্বিতীয়: ব্যবস্থা টাকে এমন পচিয়ে দিয়েছে যে আমাদের চমৎকৃত করে স্যাম্পল টেস্টেও এই প্রাণহারক বিষগুলির কোনও ত্রুটি ধরা পড়ে না।
প্রথম: প্রচলিত সিষ্টেম এ এই ব্যবস্থাটাই নেই যে যে স্যাম্পল গুলো নেওয়া হয়েছে সেগুলোই পাঠানো হয়েছে কিনা, সেগুলোরই পরীক্ষা হয়েছে কিনা এবং সেগুলোরই রিপোর্ট আসছে কিনা সেটা নিশ্চিত করার। নেই এই তিনটি ক্ষেত্রে অভিযোগকারীর উপস্থিতি বা নজরদারির কোন ব্যবস্থা। আর ফাইল ঠেলা আমলা – আধিকারিকরা শীততাপনিয়ন্ত্রিত অফিস ঘরে বসে সবটা দেখেন বোঝেন, মাঠে নেমে কাজ করা এবং একটা কাজ টানা লেগে পড়ে থেকে করাও ধাতে নেই। সুতরাং সততার চরম প্রতীক এই এগিয়ে বাংলায় যেকোন পর্বে কারসাজি করার সুযোগ থাকে।
একটি জেলার একটি গ্রামীণ হাসপাতালের দায়িত্বে এবং কলকাতা সহ চারটি জেলার চারটি বড় ও ব্যস্ত হাসপাতালের সুপার ছিলাম অনেক বছর। সিএমওএইচ সহ অন্যান্য প্রশাসনিক দায়িত্বও সামলেছি অনেক বছর। এই ধরনের স্যালাইন এ ছত্রাক পড়া ইত্যাদির মত বহুবার বহু সমস্যা এসেছে। সমস্ত ধরনের স্বাস্থ্য কর্মীদের নিয়ে এমন টিম তৈরি হয়ে গেছিল যে সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি বাতিল করে সাপ্লায়ার কে ফেরত নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হত। এর অন্যথা হত না। সাপ্লায়ার এবং তাদের মদদদাতা স্বাস্থ্য মাফিয়ারা খোঁজ খবর রাখতো, এসব নিয়ে ঘাটাতে আসতো না কারণ তাদের কালো টাকায় আমাদের সংসার বা বিলাসিতা চলত না।
স্যাম্পল দিয়ে অফিসিয়ালি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিত জানানো হত এটা জেনেই যে এর কোন সদুত্তর কোনদিন আসবে না। প্রয়োজনে লোকাল পার্চেজ করে কেনা হত, টাকা না থাকলে রোগীর বাড়ির লোকদের বুঝিয়ে কেনানো হত। কোন সমঝোতা করা হত না।
রোগীর বাড়ির মানুষ, স্থানীয় মানুষ, এলাকার জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা, রোগী কল্যাণ সমিতি কখনই এর জন্য আমাদের প্রতি বিরূপ হয়নি। এসব বাতিল মাল চালানোর জন্য রাইটার্স, স্বাস্থ্য ভবন বা সিএমওএইচ অফিস কখনই আমাদের চাপ দেওয়ার সাহস দেখায় নি কারণ তারা জানতেন এতে কোন লাভ হবেনা। একের পর এক এই ধরনের ঔদ্ধত্য দেখে তারা অবশ্য নীরবে কিছুদিন পরে অন্য কোন প্রান্তে ট্রান্সফার করে দিত। আমাদের আরও নতুন নতুন জায়গা দেখার ও সেখানকার মানুষজন সংস্কৃতিকে জানার সুযোগ হত।
সুতরাং সামান্য ইচ্ছে থাকলেই এগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আটকানো যায়, এত কিছু বাধা বিপত্তির মধ্যেও সব জমানায় কাজ করা ও মানুষকে পরিষেবা দেওয়া যায়। যত ডিগ্রি ও নামডাক থাকুকনা কেন জেগে ঘুমিয়ে থাকলে, হাসপাতালের কাজ ফেলে অলিতে গলিতে দিনরাত প্র্যাকটিস করে গেলে কিংবা টেন্ডার থেকে ট্রান্সফার, সার্টিফিকেট থেকে নার্সিং হোম – ল্যাব, নানা জায়গা থেকে নানা কায়দায় সারাদিন অর্থ উপার্জনের ফিকির খুঁজলে কিংবা মরার আগে মরে গেলে কোনদিনই কিছু সম্ভব নয়।
১১.০১.২০২৫