জ্ঞানচক্ষু জেগেছে আমার যে কমবখত লহমায়, সেই মুহূর্ত থেকে আজ এই বেয়াল্লিশ বছর বয়স অবধি আমি ইউটোপিয়াতে বসবাস করতাম। করে যাচ্ছিলাম। করেই…যাচ্ছিলাম। নাগাড়ে।
ইউটোপিয়াতে, অর্থাৎ– আকাশকুসুম স্বপ্নতে। যে স্বপ্নের এক এবং একমাত্র বাণী ছিল– নিজের কাজটা সুষ্ঠু ভাবে করে যাও, পালন করে যাও নিজের তামাম দায়িত্ব। সৎ মানুষ হয়ে। আর ব্যাস। তাহলেই সমাজ হয়ে যাবে সুষম হরলিক্স।
এতদিনে, এই বেয়াল্লিশে এসে বুঝলাম আদত সারকথা-টা। নাঃ, স্রেফ নিজের কাজটুকু করে গেলেই হবে না মুখ বুজে। স্পর্ধা থাকতে হবে। থাকতে হবে শিরদাঁড়া। থাকতে হবে… সাহস। সাহস, নিজের গণ্ডীকে অতিক্রম করার। সাহস, প্রত্যুদস্পর্ধার। নতুবা সবটা হয়ে যাবে বেকার।
এই প্রকার। কোন সে প্রকার? বলি শুনুন।
আমি অফিসে যাই। আমি খাই না ঘুষ।
আমি করিনা কামাই। আমি সৎ, আমার এই একটাই মাত্র ল্যাবেঞ্চুস।
অতএব অফিস ফেরতা যখন দেখি অপরাধ হচ্ছে কোথাও, গিলে নিই সেই গ্লানি বেমালুম। আর পরের দিন আবারও অফিস যাই। সৎ ভাবে কাজ করি। আর ঘরের মানুষকে ডেকে বলি, আমি আজও কর্তব্যবিমুখ হইনি জানো! গলায় যদিও টুকটাক লেগে থাকে বেয়াদপ খচখচ। আর আমি নিজেকে বোঝাই– আরে আমি তো কাজ করছি, আমি তো সৎ। এটুকু করে যাই। কণ্ঠস্বর তোলার প্রয়োজনই বা কী?
বেমক্কা আমার কণ্ঠের স্বরক্ষেপণ যদি হয় চিৎকৃত, তাহলে এই যে আমি যাদের এতদিন সেবা দিয়ে আসছি, তারাই বঞ্চিত হবে বেকার বেকার। আর মনে মনে সংগোপনে প্রার্থনা করি, – এই তো আমারও কমফোর্ট জোন/ সুবিধাজনক সুবিধা; এই খান থেকে উপড়ে ফেলো না ঠাকুর। আমিও থাকি দুধে ভাতে, আর আমার কর্তব্যও থাক আমার নিজেরই হাতে।
আদতে আমরা নিজেকে ঠকাই। সেসব মুহূর্তে। নিজের তাবৎ গুছিয়ে ‘সখী সখী’ সৈনিক সাজি। পপুলারিটি কুড়াই, আখেরও গুছাই।
সেসব ফেলে এসে আমি বুঝতে পারছি আজ… এ আমার কনফেশন… এ আমার সাহসী স্বীকারোক্তি, –আজকে দাঁড়িয়েও যাঁরা স্রেফ ন্যস্ত কর্তব্যটুকুই করে যাচ্ছেন অথচ মুখরিত হচ্ছেন না প্রতিবাদে, তাঁরা সমাজের সবচাইতে বিপজ্জনক বস্তু। তাঁরা গাছেরও খান, তলারও কুড়িয়ে নেন দুধে ভাতে। আর রাতে ঘুমান এই আপাত স্বস্তি নিয়ে যে– আমি তো হাজিরা দিয়েছি অফিসে/ হাসপাতালে/চেম্বারে/ বিদ্যালয়ে– হিসাব মাফিক। এতএব আমি ব্যাপক। আমি বিশাল। আমি বিখ্যাত।
তেতাল্লিশ বছরে পরিণত হওয়ার পূর্বে এই আমার আত্ম-উপলব্ধি যে, স্রেফ সৎ হয়ে কাজ করলেই হবে না। মুখর হতে হবে প্রতিটি মিথ্যা, প্রতিটি অপকর্মের প্রতি।
হতে হবে মুখর।
জাস্টিস ফর আর জি কর। চাই–
উৎপাটিত হোক শিকড়।
সমূলে।
আমি বিক্ষুদ্ধ। আর এইটাই লেখা থাকুক আমার দেওয়ালে।
( প্লিজ কমেন্ট করবেন না এমত যে আপনি জেগে আছেন এত রাতে! আপনি কি ইমারজেন্সি ডিউটি করছেন?
আমি কিছুই করিনি।
আমার স্রেফ শিরায় শিরায় টগবগিয়ে ফোটে শোণিত।
আসলে আমি স্রেফ কর্তব্যরত।
আসলে, আমি নিজেই দোষী তো।
সংসারী। স্বগত।)
আমার ঘুম আসছে না।
আমাকে ডাকছে উষ্মা। অবিরত