নিশীথের গাঢ় তমিস্রা ধীরে ধীরে ধূসর হইয়া আসিল — হর্ষবর্ধন ও দুর্গাবতীর প্রথম দাম্পত্য রাত্রির অবসান হইয়া প্রভাতের প্রথম আলোককিরণ বাতায়নপথে প্রবেশ করিয়া তাঁহাদের যুগ্মশয্যায় আসিয়া স্থিত হইল।
দুর্গাবতী শয্যার উপর উপবিষ্ট হইলেন। এই অতি প্রতীক্ষিত রাত্রি তাঁহার জীবনে দুঃসহ আনন্দ এবং দুর্বহ বেদনা উভয়ই লইয়া আসিয়াছিল। তিনি কি এই মুহূর্তটিকে উদযাপন করিবেন? নাকি অপমান ও লাঞ্ছনায় মর্মাহত হইয়া পিতৃগৃহে গমন করিবেন? বিংশতিবর্ষীয়া সংসার অনভিজ্ঞা রাণী যেন বিভ্রান্ত বোধ করিতেছিলেন।
অবশেষে যখন চিন্তা অসহনীয় হইল, দুর্গাবতী শয্যা হইতে অবতরণ করিয়া ধীরপদে কক্ষের দ্বারের দিকে চলিলেন। শারীরিক প্রেমের প্রথম অভিঘাত এবং রাত্রিজাগরণ তাঁহার চলনকে কিঞ্চিৎ মন্থর করিয়াছিল। দ্বারের প্রান্তে পৌঁছাইয়া দুর্গাবতী স্বামীর আহ্বান শুনিতে পাইলেন — “যাইও না রাণী। আমার কিছু বক্তব্য রহিয়াছে — তোমাকে শুনাইতে চাহি। তুমি শুনিবে কি?”
হর্ষের কণ্ঠস্বর অপরাধবোধ এবং অনুনয়ের সংমিশ্রণে অতীব ম্রিয়মাণ শুনাইল।
দুর্গাবতী বিস্মিত হইয়া ফিরিয়া দেখিলেন, হর্ষ গাত্রোত্থান করিয়াছেন এবং ইঙ্গিতে তাঁহার শয্যাপার্শ্বে দুর্গাবতীকে উপবেশনের অনুরোধ করিতেছেন। দুর্গাবতী ইতস্তত করিয়া স্বামীর পার্শ্বে উপস্থিত হইয়া শয্যার উপর উপবিষ্ট হইলেন।
তাহার পরে শুষ্কস্বরে কহিলেন — “বলুন আর্য। আমি শুনিতেছি।”
কিন্তু তাঁহার এমত উক্তির পরও হর্ষের দীর্ঘ নীরবতায় দুর্গাবতী কিছু অধীর হইয়া স্বামীর মুখের প্রতি তির্যক দৃষ্টিপাত করিলেন।
একটি রাত্রিতেই সম্রাট হর্ষবর্ধনের বয়ঃক্রম যেন দ্বিগুণ হইয়া গিয়াছে। তাঁহার স্নিগ্ধ কমকান্তি মুখশ্রী বেদনা ও অনুশোচনার অগ্নিতে দগ্ধ হইয়া মলিন রুক্ষভাব ধারণ করিয়াছে। যুবক রাজাকে জীবনযুদ্ধে আহত, পরাজিত এক প্রৌঢ় বলিয়া ভ্রম হইতেছে।
করুণায় দুর্গাবতীর অন্তর আর্দ্র হইয়া উঠিল, নয়নও শুষ্ক রহিল না। তিনি হস্ত প্রসারিত করিয়া হর্ষের বাহু স্পর্শ করিলেন। তাহার পরে অতি মৃদু কণ্ঠে কহিলেন –“মহারাজ, কোনও দ্বিপ্রহরে রাজকর্মের অবসরে আপনার পুঁথির কাহিনীটি আমাকে শুনাইবেন? সেই রাজা উদয়ন আর রাণী বাসবদত্তার কাহিনী? শুনিতে বড় ইচ্ছা হয় রাজন। শুনাইবেন কি?”
হর্ষের সযত্নরচিত ধৈর্য্যপ্রাচীর দুর্গাবতীর এই সামান্য কয়টি কোমল বাক্যে ধূলিসাৎ হইয়া ভাঙিয়া পড়িল। তিনি কিয়ৎকাল দীনচক্ষে রাণীর মুখপানে চাহিয়া তাঁহার সম্মুখে নতজানু হইয়া ভূমিতলে বসিয়া পড়িলেন। রাণীর ক্রোড়ে আপনার ক্লান্ত মস্তক স্থাপন করিয়া রুদ্ধকণ্ঠে বলিয়া চলিলেন — “ক্ষমা করিও। আমি ব্যর্থ স্বামী, কর্তব্যভ্রষ্ট রাজা, আদর্শভ্রষ্ট উপাসক — বুদ্ধ আমাকে কদাচ ক্ষমা করিবেন না জানি, তুমি আমাকে ক্ষমা করিও।”
দুর্গাবতীর অনবধানেই তাঁহার দুই গণ্ড বাহিয়া অঝোরে অশ্রু ঝরিয়া পড়িতেছিল। তিনি আপন ক্রোড়ে ন্যস্ত স্বামীর মস্তকে, ললাটে, দীর্ঘ কেশরাশির মধ্যে লঘুভাবে স্বীয় কোমল করাঙ্গুলি চালনা করিয়া মধুরস্বরে রাজাকে বহু সান্ত্বনাবাক্য শুনাইলেন। তথাপি হর্ষের অনুতাপদীর্ণ অন্তর শান্ত হইতেছে না দেখিয়া দুর্গাবতী বলপূর্বক স্বামীর বেদনাহত মুখ আপন ক্রোড় হইতে তুলিয়া ধরিয়া তাঁহার প্রতি প্রেমপূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিলেন।
হর্ষ শুনিলেন, রাণী কহিতেছেন — “জগতের সমস্ত মনুষ্য প্রেয় এবং শ্রেয়, সকলই একত্রে লাভ করে না রাজন। আমি আপনার হৃদয় পাই নাই, তাহাতে আমার দুঃখ অবশ্য রহিয়াছে। কিন্তু স্বামীর কর্তব্যে আপনি অবিচল আছেন, আমাকে চিরবঞ্চিত করিয়া রাখেন নাই — ইহাতে আমার মনোবেদনা বহুগুণ লাঘব হইয়াছে। আপনাকে হেয়জ্ঞান করিবেন না মহারাজ, এই আমার অনুরোধ। সংসার হউক অথবা রাজসভা, আপনি কদাপি কর্তব্যভ্রষ্ট হইতে পারেন না – ইহা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।” কিছুকাল নিশ্চুপ থাকিয়া রাণী পুনরায় কহিলেন — “কোনও এক শুভক্ষণে আপনার হৃদয়মধ্যে আমি নিশ্চিতরূপে স্থান পাইব। কতকাল পরে আমার জীবনে সেই পরমক্ষণের আগমন হইবে, আমি সম্যক জ্ঞাত নহি। কিন্তু আমার কোনও ত্বরা নাই আর্য। দুর্গাবতী তাহার প্রাণাধিক স্বামীর জন্য সমস্ত জীবন প্রতীক্ষা করিতে প্রস্তুত আছে।”
হর্ষ আর সহিতে পারিলেন না। সবলে দুর্গাবতীর কটি বেষ্টন করিয়া নতজানু স্বামী তাঁহার ক্রোড়স্থিত অঞ্চলমধ্যে পুনরায় আপন মস্তক দৃঢ়ভাবে রক্ষিত করিলেন। প্রাসাদকাননের বৃক্ষশাখে মত্ত পাপিয়া তখন সুমিষ্ট কূজনে দশদিক মথিত করিয়া তুলিতেছিল।
শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে আচার্য মণিপদ্মের নিকট প্রব্রজ্যা গ্রহণের পরে বুদ্ধনির্দেশিত অষ্টাঙ্গিক মার্গে ভিক্ষুণী দীপান্বিতার যাত্রারম্ভ হইয়াছিল। তাহার নূতন নামকরণ হইল সুদত্তা। কিন্তু কঠিন ব্রহ্মচর্য্য পালন তথা বিনয় পিটকে উল্লিখিত কঠোর নিয়মনীতির শৃঙ্খলে নিত্যযাপনে অভ্যস্ত হইয়া, গৌতমের সকল বাণী ও উপদেশ কণ্ঠস্থ করিয়াও দীপান্বিতার মানসপট হইতে সেই করুণনয়ন, অগ্নিসম্ভব পুরুষের মূর্তি মুছিল না — উপরন্তু শুক্লপক্ষের চন্দ্রকলার ন্যায় তাহার গোপন অনুরাগ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাইতে লাগিল।
সে দিনমানে কঠোর পরিশ্রম করে। আচার্য মণিপদ্ম তাহার পূর্বের অভিজ্ঞতা স্মরণে রাখিয়া আর্ত ও মুমূর্ষুর সেবায় তাহাকে নিয়োজিত করিয়াছিলেন। সেই সকল সেবাস্থলে সে পরম মমতায় মৃত্যুপথযাত্রীর শুশ্রূষা করে, দুরারোগ্য রোগীর যথাসাধ্য সেবা করে, গর্ভবতী রমণীর প্রসবে সাহায্য করে — কিন্তু তাহার অন্তর কান্যকুব্জের রাজ-অবরোধের সেই নিভৃতকক্ষেই পড়িয়া থাকে।
গভীর রাত্রে নিজ পরিবেণে কঠিন ভূমিশয্যায় শুইয়া হর্ষের সহিত তাহার তীব্র মিলনেচ্ছার আর্তি যখন অসহনীয় হইয়া উঠিত, দীপান্বিতা আপন স্তনপট্ট ও নিম্নাঙ্গের অঙ্গাবরণ সমুদয় উন্মোচিত করিয়া অনাবৃত দেহে ভূমিতে পড়িয়া নীরবে অশ্রুবিসর্জন করিত। হর্ষের প্রণয় অগ্রাহ্য করিয়া তাঁহাকে অযাচিত বিবাহশৃঙ্খলে আবদ্ধ হইবার প্ররোচনা দিবার কথা স্মরণে আনিয়া অক্ষম বেদনায়, আত্মধিক্কারে তাহার অন্তর বিদীর্ণ হইবার উপক্রম হইত। কামনার জ্বালায় অতিষ্ঠ দিগভ্রষ্ট ভিক্ষুণীর অসহায় ক্রন্দনে বুদ্ধনামাঙ্কিত বিহারভূমির মৃত্তিকা সিক্ত হইয়া যাইত।
প্রত্যহ প্রিয়সন্দর্শনে অভ্যস্ত যে চিত্তকে সে পূর্বাশ্রমে হেলায় পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছে বলে মনে করিয়াছিল, সেই অবাধ্য হৃদয় তাহার সহিত প্রতারণা করিয়াছে। স্বীয় মানসপটে তথাগতের যে চিত্র সে নিত্য কল্পনা করিত, সেই স্থলে সম্রাট হর্ষবর্ধনের মূর্তি স্থায়ীভাবে খোদিত হইয়া গিয়াছে — ইহা অনুভব করিয়া তাহার মনস্তাপের সীমা রহিল না।
যদ্যাপি সে আপনার মনোবেদনা সঙ্গোপনে লালন করিতে শিখিয়াছে, তথাপি তাহার অন্তঃকরণ তাহাকে ‘অশুচি, অসৎ’ বলিয়া প্রত্যহ তিরস্কার করিতে লাগিল। অন্যান্য শ্রমণদিগের সহিত সে যখন স্নিগ্ধ, শান্তমুখে আচার্য মণিপদ্মের বাণী শ্রবণ করিত, তাহার বিক্ষুব্ধ চিত্ত তাহাকে উচাটন করিয়া ফিরিত। তাহার কেবলই মনে হইত, তাহার শিক্ষককে নহে, সে আপনাকেই প্রবঞ্চনা করিয়া ফিরিতেছে।
আচার্য মণিপদ্মের অজ্ঞাত থাকিলেও, অন্তর্যামী সুগতের চক্ষে তাহার আত্মপ্রতারণা যে গোপন রহিবে না, ইহা সম্যকরূপে অনুভব করিয়া গ্লানিতে তাহার অন্তর পরিপূর্ণ হইয়া যাইত।
অনুতাপ অসহ্য হইয়া উঠিলে, সে কর্ম হইতে ক্ষণিক অব্যাহতি লইয়া বিহারের মহাগন্ধকুটির স্তূপের নিকটে গিয়া বসিত। কখনও বা শ্যামল বিহারভূমির প্রাচীরের বাহিরে প্রবহমানা অচিরাবতী নদীতীরে অস্থিরভাবে পাদচারণা করিত।
এক বিষণ্ণ প্রদোষে তাহার মনে অকস্মাৎ বাল্যসখা চন্দ্রবর্মার স্মৃতি উদিত হইল। বহু আয়াসেও দীপান্বিতা চন্দ্রবর্মার মুখচ্ছবি স্মরণ করিতে সফল হইল না। তাহার অবয়ব এখন আর মনে পড়ে না। প্রত্যাখ্যানের অবরুদ্ধ অভিমানে চন্দ্রবর্মার আপন ধর্মত্যাগ করিয়া বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করিবার বালসুলভ অভিলাষটি কেবল দীপান্বিতার স্মৃতিপত্রে সঞ্চিত রহিয়াছে।
চন্দ্রের সেই বালকোচিত প্রতিজ্ঞা শ্রবণ করিয়া সে যে কৌতুক বোধ করিয়াছিল, ইহা স্মরণ করিয়া দীপান্বিতা লজ্জাবোধ করিল। চন্দ্রবর্মা অপরিণতমনস্ক হইলে সে নিজে কেমন?
স্বেচ্ছায়, অহংকারের বশে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিয়া সে কাহাকে প্রবঞ্চনা করিল? আপনাকে? রাজা হর্ষকে? দেবী রাজ্যশ্রীকে? নাকি সেই মহাজ্ঞানী শাক্যসিংহ গোতম ভগবানকে?
বহু আয়াসেও দুর্ভাগিনী দীপান্বিতা তাহার অন্তর্যামীর নিকট আপনার অনুচ্চারিত প্রশ্নের উত্তর পাইল না।
দীপান্বিতার কান্যকুব্জ ত্যাগের পরে এক যুগ অতিক্রান্ত হইয়াছে। সম্রাট হর্ষবর্ধন বল্লভীরাজ্যের কিয়দংশ আপন রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত করিতে সক্ষম হইয়াছেন। উত্তর পশ্চিমে গান্ধার প্রদেশ হইতে পূর্বে মগধ এবং দক্ষিণে মালব অবধি তাঁহার সাম্রাজ্য বিস্তারলাভ করিয়াছে। কামরূপ নরেশ ভাস্করবর্মার সহিত তাঁহার মধুর মিত্রতার সম্বন্ধ অটুট রহিয়াছে। কেবল পুষ্যভূতিরাজ্যের দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থিত চালুক্য সাম্রাজ্যের মহাবিক্রমশালী সম্রাট দ্বিতীয় পুলকেশী হর্ষকে সম্মুখসমরে পর্যুদস্ত করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। হর্ষবর্ধন নর্মদা নদীতীর হইতে শূন্যহস্তে কান্যকুব্জে ফিরিয়া আসিয়াছিলেন। কোনও অজ্ঞাত কারণে সম্রাট পুলকেশী নর্মদা পার হইয়া পুষ্যভূতিসাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে পদার্পণ করেন নাই, তাই অদ্যাপি হর্ষের সাম্রাজ্যের বিস্তার অক্ষুণ্ণ আছে।
জ্যেষ্ঠপুত্র ভাগ্যবর্ধন এবং কনিষ্ঠপুত্র কল্যাণবর্ধনের জন্মের পরে রাণী দুর্গাবতী পুনরায় অন্তঃসত্ত্বা হইয়াছেন।
দেবী রাজ্যশ্রী স্বমর্যাদায় পূর্ণ গরিমায় প্রতিষ্ঠিত আছেন এবং বুদ্ধপাদপদ্মে তাঁহার মতি পূর্ববৎ স্থির রহিয়াছে।
জেতবন বিহারে অধিষ্ঠানকালে তীব্র মনঃপীড়ায় দীপান্বিতার স্বাস্থ্য ধীরে ধীরে ভাঙিয়া পড়িতে লাগিল। পূর্বে যে সকল পরিশ্রমসাপেক্ষ কার্য সে অনায়াসে সম্পন্ন করিতে পারিত, অধুনা আর তাহার দ্বারা সেই কার্য নির্বাহ করা সম্ভব হয় না।
আচার্য মণিপদ্ম ইহা লক্ষ্য করিয়া একদিন তাহাকে আহ্বান করিলেন।
দীপান্বিতা মহাস্থবিরের সমীপে উপস্থিত হইয়া তাঁহার নির্দেশে উপবেশন করিল।
মণিপদ্ম স্বস্তিবাচন করিয়া তাহাকে সম্ভাষণপূর্বক কহিলেন — ‘সুদত্তা, তোমাকে কিছু দুর্বল দেখিতেছি। তুমি কি সম্প্রতি অসুস্থ বোধ করিতেছ?’
ক্ষীণ কণ্ঠে দীপান্বিতা উত্তর করিল – ‘না ভদন্ত। আমি অসুস্থ নহি। তবে বয়সজনিত ক্লান্তি অবশ্য আসিয়াছে।’
মণিপদ্ম স্মিতমুখে কহিলেন – ‘তুমি দিন দিন শীর্ণ হইতেছ — সম্ভবত উচিত পরিমাণে আহার গ্রহণও করো না। আয়ুকে দোষ দিয়া লাভ কি?’
দীপান্বিতা অধোমুখে নীরবে বসিয়া রহিল।
মণিপদ্ম ধীরস্বরে কহিলেন — ‘সুদত্তা, বৎস, যেদিন তুমি ভগবান বুদ্ধের নামে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিয়াছ, সেইদিনই তোমার পূর্বাশ্রমের সকল স্মৃতি জীর্ণ বস্ত্রের ন্যায় ত্যাগ করিয়া আসিয়াছ। তথাপি যদি তুমি নিত্য স্মৃতিভারে পীড়িত থাকিয়া অষ্টাঙ্গিক মার্গ নির্দেশিত সদ্ধর্মাচরণ বিস্মৃত হও, সে ব্যর্থতা আমার’ — বলিয়া একটি সুদীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিলেন।
দীপান্বিতা কশাহতের ন্যায় ক্লিষ্ট মুখটি তুলিয়া আচার্যের প্রতি বারেক মাত্র দৃষ্টিপাত করিয়া চক্ষু নামাইয়া লইল — হায় হায়, তাহার এতদিনের তপস্যা তবে বিফল হইল! তাহার আত্মপ্রবঞ্চনা আপন শিক্ষকের অন্তর্দৃষ্টির নিকট পরাভূত হইল! এই লজ্জা সে রাখিবে কোথায়?
কিয়ৎকাল পরে আচার্য মণিপদ্ম স্নিগ্ধস্বরে কহিলেন –‘উপস্থিত কিছুকাল সম্পূর্ণ বিশ্রাম গ্রহণ করো। প্রজ্ঞাকর ভিক্ষুর নেতৃত্বে চৈনিক পরিব্রাজকের একটি দল পক্ষকাল পরে পূর্বদিকে গৌড়াভিমুখে যাত্রা করিবেন। কৌশাম্বি, বুদ্ধগয়া, রাজগৃহ দর্শন করিয়া রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণান্তে তাঁহারা পুনরায় শ্রাবস্তী ফিরিয়া আসিবেন। তুমি
তাঁহাদের সঙ্গ লইও। ভ্রমণে তোমার মনের ক্লান্তি দূরীভূত হইবে, বৎস। বুদ্ধ তোমার সহায় হউন।”
পক্ষকাল পরে তথাগতকে স্মরণ করিয়া, দীপান্বিতা প্রজ্ঞাকর ভিক্ষু এবং অন্যান্য শ্রমণদিগের সহিত রাজগৃহ অভিমুখে যাত্রারম্ভ করিল।
মূঢ় মানবী জানিত না যে পার্থিব সকল স্থান হইতে দূরে যাওয়া সম্ভবপর হইলেও আপন অন্তর হইতে পলায়ন সম্ভব নহে। স্বীয় কৃতকর্মের ভার আমৃত্যু আপন স্কন্ধেই বহন করিয়া চলিতে হয়, তাহাকে গলিত চীবরের তুল্য অবহেলায় পথিপার্শ্বে ত্যাগ করিয়া যাওয়া অসম্ভব।
(ক্রমশ)