প্রতিবার করোনা নিয়ে লেখার পর ভাবি এই বিষয় নিয়ে এটাই আমার শেষ পোস্ট। কারণ এই বিষয় নিয়ে লিখে কোনো লাভ নেই অথবা পরের পোস্ট দেবার আগেই ফুটে যাবো। মানুষ ফুটলে কারো কিছুই যায় আসে না, ফুল ফুটলেই হলো। আবার লিখতে বসি, কিছুটা দুঃখে, কিছুটা রাগে আর অনেকটা ভয়ে।
সকাল থেকে মন একদম ভালো নেই। গতকাল মেডিকেল কলেজের মাত্র তিন বছরের সিনিয়র দাদার (ডাঃ সুব্রত মিত্র, আমাদের সবার প্রিয় স্যাবিদা) মৃত্যুর খবরের মন খারাপের মধ্যেই আজ আবার একজন বছর ৩৫ এর চিকিৎসকের (ছোটো ভাই ডাঃ অনিকেত, যার মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকত) পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার সংবাদ পেলাম। দুজনেই পোস্ট কোভিড কমপ্লিকেশনের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু মন খারাপ থাকলেও বাড়ি থাকার উপায় নেই। চেম্বারে রুগিদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া আছে। বেরিয়ে পড়তে হল। কোভিড পরিস্থিতিতে কিছু সাবধানতা মেনেই এখন চেম্বার করছি। চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব সবাইকে সুস্থ রাখতে। কারণ একজন সিস্টার বা রিসেপশনিস্ট সংক্রমিত হলে তার থেকে আরও সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার বিপুল আশঙ্কা। তাই দিনে নির্দিষ্ট পরিমাণ রুগীকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিই। যাতে রুগীর ভিড় বেশি না হয়। কিন্তু প্রায়শই অনেক বেশি রুগী অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই চেম্বারে চলে আসছে। আজও একই ঘটনা। ২০ জনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল প্রায় ৪০ জন হাজির। তাঁদের ফেরাতেও পারছি না। আগে দূর থেকে আসার আগে অনেকে রুগীই কনফার্ম করে নিত। যাতে গাড়ি ভাড়া নষ্ট না হয়। এখন ট্রেন চলছে। কম খরচে যাতায়াত করার সুযোগ থাকায় অনেকেই চান্স নিতে পিছপা হচ্ছেন না। কিন্তু এতে যে অন্যেরা সমস্যায় পড়তে পারে সে চিন্তা কেউ করছেন না।
নিয়ম অনুযায়ী কোনও রুগীর অপারেশনের আগে আমাদের কোভিড টেস্ট মাস্ট। পজিটিভ ধরা পড়লে ১৭ দিন পর অপারেশন করা হয়,যদি না তার মধ্যে কোনো ইমার্জেন্সী হয়। সেদিন এরকমই এক রুগীর পজিটিভ ধরা পড়ার পর তার আবদার শুনে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। তার দাবি, এই পজিটিভ রিপোর্ট চেপে রেখে ১৭ দিনের আগেই অপারেশন করা হোক। আমার মনে হয়, এর একটা কারণ অনেকেরই এই রোগ সম্পর্কে আর আগের মতো ভীতি নেই, অন্যটা হলো পাতি স্বার্থপরতা।
ওদিকে প্রচারমাধ্যমে দেখানো হচ্ছে দৈনিক সংক্রমণ কমছে। সবাই সেরে উঠছে, মৃত্যু সংখ্যা কমছে। ফলে রাস্তাঘাটে ঢিলেমির ছবি পরিষ্কার। মাস্ক ছাড়া, শারীরিক দূরত্ব ছাড়াই সবাই চলাফেরা করছে। করোনা গায়েব। কিন্তু একটু চোখ কান খোলা রাখলেই দেখা যাবে আশেপাশের কতো লোক পজিটিভ আর চেনাজানা কতোজনকে আমরা হারিয়েছি। বড়লোকেরা ভাবছে এটা গরীবের রোগ, তারা কাজের লোক, ড্রাইভার নিয়ে সাবধান, কিন্তু নিজেরা পার্টি করছে। গরিবরা ভাবছে এটা বড়োলোকের অসুখ, তাদের মাস্ক পরা, হাত ধোয়ার দরকার নেই। হিন্দুরা ভাবে এটা মুসলমানদের জন্য ছড়াচ্ছে, রাজাবাজার, খিদিরপুরে কেউ নিয়ম মানে না, অন্য ধর্মের লোকেরা ভাবছে দুর্গাপূজা, কালীপূজার জন্য রোগ ছড়াচ্ছে। একদল ভাবছে ভোট আসছে সব চেপে যাই, অন্য দল ভাবছে পাবলিক আর এটা খাচ্ছে না, টিআরপি বাড়বে না।
আমাদের মতো স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে জড়িত সবাই এই ছবি দেখে রীতিমতো দুশ্চিন্তায় আছি।বাইরের দেশের মতো কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়লে সামাল দেওয়ার মতো পরিকাঠামো আমাদের নেই। তাতে যে মৃত্যুহার কোন পর্যায়ে পৌছবে তা ভাবলেও শিউড়ে উঠতে হয়। তাছাড়া পোস্ট কোভিড কমপ্লিকেশন অর্থাৎ কোভিড থেকে সেরে ওঠার পরেও এমন সব জটিলতা দেখা দিচ্ছে যার থেকে সেরে ওঠা মুশকিল। আমাদের দুজন সহকর্মী চিকিৎসকের প্রাণ কেড়ে নিল কোভিড পরবর্তী জটিলতা। একদিকে কোভিড সামলানো, অন্যদিকে সহকর্মীদের হারানো আর সবচেয়ে বড় কথা আগামী দিনে কী ঘটতে চলেছে তা ভেবে আমরা সত্যি খুব আতঙ্কিত। যা দেখছি তাই লিখলাম। আপনারাও ভাবুন, ভাবা প্র্যাক্টিস করুন।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আর সবাই মিলে রবীন্দ্র সরোবরের মঙ্গল কামনা করি।