বিকেলে মিটিং সেরে বেরিয়ে আসার সময় শুনতে পেলাম কোনো এক গাড়ির ড্রাইভারের মিউজিক সিস্টেম বাজছে এই গানটা। মনটা চলে গেল হায়দ্রাবাদের বশিরবাগে গানের সেই জলসায়। মঞ্চে বসে আছেন উস্তাদ। কাছেই নামপল্লী স্টেশন। রাতের ট্রেন তীব্র একটা সিটি মেরে যাত্রা শুরু করলো। উস্তাদ চট করে পিচটা ধরে নিলেন। পাল্লা দিয়ে তীব্র অক্টেভে শুরু হল তাঁর নোট। ক্রমে মধ্য ও মন্দ্র অক্টেভ। হলভর্তি শ্রোতাদের হাততালি ফেটে পড়লো। পন্ডিত ভীমসেন জোশি এযুগের এই “তানসেন” সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমরা ওসব করতে গেলে আমাদের ল্যারিনক্স স্রেফ চোকড হয়ে যেত, ধর্মঘট ডাকতো আমাদের স্বরযন্ত্র”।
এই উস্তাদের গান শোনার সৌভাগ্য কিন্তু ভারতের মানুষের আর হতো না যদি না সেই সময়ের বোম্বের মুখ্যমন্ত্রী মোরারজি দেশাই হস্তক্ষেপ করতেন।।ভারত পার্টিশনের সময় এই উস্তাদ চলে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তান। দেশটা দু’টুকরা হওয়ার পরে ওনার জন্মভূমি যে ওই পাঞ্জাবের ভাগে।
দশটা বছর কেটে গেল ওই দেশে। মন টিঁকিয়ে রাখা মুশকিল হল উস্তাদের পক্ষে। সারাটা জীবন হিন্দুস্তানী ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিককে জনপ্রিয় করার সুবাদে তাঁকে শুনতে হয়েছে সমালোচকদের বাক্যবাণ। তিনি নাকি ধ্রুপদী নন। তাঁর গানে বড্ড বেশি ইমোশন। সেই মানুষটি ফিরে আসতে চাইলেন ভারতে। জন্মভূমি ছেড়ে কর্মভূমি। নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ নয়। বোম্বে এসে মুখ্যমন্ত্রী মোরারজির শরণাপন্ন। আপাত রসকষ বিহীন এই মুখ্যমন্ত্রী ব্যবস্থা করে দিলেন ভিসার ১৯৫৭ আর ১৯৫৮ সালে। তার পরে উস্তাদ আবার ভারতের নাগরিক।
ভারতের সেক্যুলার ফেব্রিক চিনতে বুঝতে অসুবিধে হয় নি ওই ইমোশনাল গানপাগল মানুষটির। বিশাল দেহ, এই বড় পাকানো গোঁফওয়ালা কুস্তিগীরের মতো চেহারার এই উস্তাদকে কদর করতে পিছপা হয় নি সেক্যুলার ভারত। ঝুলিতে ভরে দিয়েছে সন্মান, অর্থ, খ্যাতি আর ভালোবাসা। পদ্মভূষণ প্রাপ্তির পাশাপাশি এটাও মাথায় রাখতে হবে তাঁর গান পিছু পারিশ্রমিক ছিল ২৫০০ টাকা যখন লতা-রফি পাচ্ছেন ৫০০ টাকা।
ভারতের সেক্যুলার ফেব্রিককে অন্যতম সেরা সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন এই উস্তাদ যিনি স্রেফ এদেশের মানুষের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর প্রকৃত সমঝদার। জন্মভূমির টান ছেড়ে বেছে নিয়ে ছিলেন তাঁর কর্মভূমিকে। সেই সেক্যুলার ফেব্রিককে আজ দিল্লির বুকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে দেখলে মানুষটা কি বলতেন জানি না। হয়তো বলতেন, এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না।
এক মুগ্ধ শ্রোতার আঁকা সেই ছবিটা আরেকবার দেখা যাবে কি না জানা নেই। আমাদের দেশের সেক্যুলার ফেব্রিক ছিঁড়ে তো খান খান। বোম্বের সেই রাত। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সাগরের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে গেয়ে চলেছেন উস্তাদ। মলহার রাগের গমক তান সপাট আছড়ে পড়ছে। বজ্র বিদ্যুৎ এর গর্জনের সাথে পাল্লা দিচ্ছে উস্তাদের কন্ঠের তারা উদারা মুদারার অনায়াস যাতায়াত। মা সরস্বতীর আশীর্বাদ অবিরাম বর্ষা ধারায় ঝরে পড়ছে উস্তাদের ওপর।
ভারত নামের এই দেশটাকে ভালোবেসে এই দেশে থেকে যাওয়া, ফিরে আসা কোনও উস্তাদ যেন কোনোদিন সেই আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত না হয়। দেশটা যেন মৃত্যু উপত্যকা না হয়। নইলে আর কোনো বড়ে গোলাম আলী খান কোনোদিন পাবে না এই ভারত, নইলে হেমন্তের মরা বিকেলে স্টিয়ারিং এ তাল ঠুকে কেউ আর শুনবেন না সেই গান, “আয়ে না বালম”।