জীবনের শুরুতে অনেক স্বপ্ন থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্বপ্ন গুলো অলীক মনে হয়। সেগুলো স্বপ্নের দোষ না বয়সের দোষ বলা মুশকিল।
মধ্যমগ্রাম স্কুলে ক্লাস ফাইভে যখন ভর্তি হলাম তখন একমাত্র স্বপ্ন ছিল স্কুলের সুব্রত-কাপ টিমে খেলব। হাফইয়ার্লিতে রেজাল্ট একটু ভালোর দিকে হওয়ায় এক বন্ধু বলল, ‘রেজাল্ট ভালো হলে স্কুলের ফুটবল টিমে চান্স পাওয়া যায় না। কোনো রকমে পাস করলেই হবে।’ অ্যানোয়াল পরীক্ষায় ভালোই ছড়ালাম। কিন্তু আমার আর সুব্রত-কাপে খেলা ফুটবলার হওয়া হলো না। কাদা মাঠেই খালি পায়ের সেভেন সাইড ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলে ক্ষান্ত দিতে হলো।
ডাক্তারি পাশ করে গ্রামে সরকারি চাকরি করতে গেলাম, তখনও দুর্দান্ত দুর্দান্ত স্বপ্ন দেখতাম। নর্মান বেথুনের জীবন কাহিনী মহাচীনের পথিক পড়েছি – ভাবতাম আমি একাই গোটা ব্লকের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পালটে দেব। তবে কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম এই পালটে দেওয়া ব্যাপারটা বেশ জটিল। কে যে কাকে, কিভাবে পালটে দেবে সেটা কঠিন ত্রৈরাশিক অঙ্ক। সাপ, ধেড়ে ইঁদুর, কাঁকড়া বিছের সাথে এক কোয়ার্টারে জায়গা ভাগ করে থাকতে হতো। কোনোদিনই রাতে কারেন্ট থাকে না। থাকলেও লো ভোল্টেজ। মাঠের শ্যালোই সব বিদ্যুৎ টেনে নেয়। ছিটেফোঁটা যা আমাদের ভাগ্যে জোটে তাতে পাখা ঘুরলেও পাখার ব্লেড গোনা যায়। সারারাত গরমে না ঘুমিয়ে পরের দিন আউটডোরে বসে খালি হাই উঠতো।
তাছাড়া মাথার উপরে যেসব স্বাস্থ্য প্রশাসকেরা বসে আছেন, তাঁদের অনেকেই কাজ কর্মে তুলনাহীন। একদিন আউটডোরের শেষে হাসপাতালের জিপ নিয়ে স্থানীয় একটি গ্রাম পঞ্চায়েতে ক্যাম্প করতে গেছি, খানিকক্ষণ বাদে জিপের ড্রাইভার প্রফুল্লদা এসে বললেন, বড়ো ম্যাডাম এখুনি জিপ নিয়ে ফিরে যেতে বলেছেন। বলেছেন, আজ ক্যাম্প করার দরকার নেই।
বললাম, মানে?
প্রফুল্লদা বললেন, বড়ো ম্যাডাম তাই বললেন। বললেন ক্যাম্প করতে হবে না। ডাক্তারবাবুকে নিয়ে ফিরে আসতে। জামাইবাবুর এম্বাসেডর খারাপ হয়ে গেছে। ওনার কোথায় মিটিঙে যাওয়ার আছে। আমি অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম। উনি শুনছেন না।
সামনে তখন থিক থিক করছে রোগী। যারা কেউ ধারাবাহিক প্রেশারের ওষুধ নিতে এসেছেন। কেউ কোমরের ব্যথার ওষুধ। কেউ জ্বরে কোঁকাচ্ছেন। উপর মহলের দয়া দাক্ষিণ্যে এঁদের চিকিৎসা জোটে। বাংলা ভাষার মতো এই মানুষগুলিও এলিটদের কাছে ভার্নাকুলার। চিকিৎসক না দেখে চলে গেলেও সম্ভবত কেউ প্রতিবাদ করবেন না।
প্রফুল্লদাকে গম্ভীর গলায় বললাম, আপনি চলে যান। আমি রোগী দেখেই যাব।
সেদিন ধু ধু ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে লাল মোরামের রাস্তায় ফার্স্ট এ.এন.এম ডালিয়াদির মোপেডের পেছনে বসে ফ্রিতে আবীর মেখে ফিরতে ফিরতে ঠিক করেছিলাম, এ চাকরি আমি ছেড়ে দেব। যে চাকরিতে শ’দেড়েক সাধারণ মানুষের চিকিৎসার থেকে একটা ঝিমানো মিটিংকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, সে চাকরি না করাই ভালো।
হাতে ইস্তফা পত্র নিয়ে পরের দিন এ. সি. এম. ও. এইচ অফিসে চলে গেছিলাম। কিন্তু সেবার পীযূষদা ও ডা. পাত্র স্যার অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে আমাকে নিরস্ত করলেন।
এরকম আরেকদিন খিঁচড়ানো মন নিয়ে আউটডোর করছি। বড়ো ম্যাডামের সাথে আবার ঝামেলা লেগেছে। ঠিক করে রেখেছি আউটডোর শেষ হওয়া মাত্র এ. সি. এম. ও. এইচ অফিসে গিয়ে ইস্তফা পত্র দেব। পকেটে একটা চিঠি লিখেও এনেছি।
রোগী দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম, একটা ছেলে অনেকক্ষণ ধরে দূরে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে। বয়স সতেরো- আঠারো হবে। পরনে আধ ময়লা হাফ শার্ট আর পাজামা। পায়ে মলিন হাওয়াই চপ্পল। জিজ্ঞাসা করলাম, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কিছু বলবি?
ছেলেটি হেসে বলল, আজ্ঞে না। আমি শুধু দেখতে এসেছি।
কী দেখতে এসেছিস?
ডাক্তারদের দেখতে এসেছি। তাঁরা কী রকম পোশাক পরেন। তাঁরা কী ভাবে কথা বলেন।
অবাক হয়ে বললাম, কেন? দেখে কী হবে?
ছেলেটি লাজুক ভাবে বলল, আজ্ঞে আমার কলগ্রামে বাড়ি। এবছর আমি জয়েন্টে মেডিক্যালে চান্স পেয়েছি। জেনারেলে চব্বিশ র্যাঙ্ক হয়েছে। কাল মেডিক্যাল কলেজে যাব ফর্ম তুলতে। আমি তো আগে কাছ থেকে ডাক্তার দেখিনি। তাই দেখতে এলুম।
সে যাত্রা আমার আর চাকরি ছাড়া হলো না। তারপর কতদিন চলে গেছে। লরেটো কলেজে ভর্তির জন্য কুখ্যাত বিজ্ঞপ্তিটি দেখে আবার সে কথা মনে পড়লো। আঞ্চলিক ভাষায় পড়াশোনা করলে লরেটোতে ভর্তি হওয়া যাবে না। কারণ সেখানে পড়াশোনার একমাত্র মাধ্যম ইংরাজি। মেডিকেল কলেজেও যদি কোনোদিন এরকম বিজ্ঞপ্তি বেরোয়। মেডিকেল কলেজেও তো ইংরাজিতেই লেকচার হয়। ইংরাজিতেই পরীক্ষায় উত্তর দিতে হয়। কলেজ লাইব্রেরিতেও তো ইংরাজি ছাড়া বাংলা ভাষায় কোনো বই দেখিনি। কলগ্রামের ওই ছেলেটির তাহলে ডাক্তারি পড়া হতো না। শুধু সেই ছেলেটির কেন, আমারও পড়া হতো না। আমিও তো ভার্নাকুলার ল্যাংগুয়েজেই পড়াশোনা করেছি। যদিও সেই ভার্নাকুলার ভাষাটাও ঠিকঠাক শিখে উঠতে পারিনি।
অবশ্য লরেটো কর্তৃপক্ষ সমালোচনার চাপে দুঃখ প্রকাশ করে বিজ্ঞপ্তিটি তুলে নিয়েছে। তবে সেটা লোক দেখানো। লরেটোর মতো কলেজে সাধারণ ঘরের বাংলা মাধ্যমের মেধাবী ছাত্রীর প্রবেশ অধিকার নেই।
তেমনি মেডিক্যাল কলেজেও আস্তে আস্তে এই সব প্রান্তিক মেধাবী ছাত্ররা দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে। নিট পরীক্ষার নামে একগাদা নামকরা কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। যেখানে ভর্তি হওয়ার সামর্থ্য এই সব প্রান্তিক ছেলে মেয়েদের নেই। নিটে কোনরকমে চান্স পেলেও প্রাইভেট কলেজে লাখ লাখ টাকা দিয়ে ডাক্তারি পড়ার ক্ষমতাও কোনো চাষির ছেলের নেই। আর কোনোদিনও গ্রামীণ হাসপাতালে কোনো সদ্য কিশোর এক বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে ডাক্তার কেমন হয় দেখতে আসবে না।
আমরা ভাষাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মেধাকে আঞ্চলিক করে ফেলেছি। আমরা ঠাটবাটকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে স্বপ্নকে আঞ্চলিক করে ফেলেছি।
লরেটোর দায়সারা দুঃখ প্রকাশে আনন্দিত হওয়ার কিছু দেখতে পাচ্ছি না। যুদ্ধ জয়ের অনুভূতিও হচ্ছে না। যুদ্ধ এতো সহজে জেতা যায় না।