সব মৃতেরাই তাদের শবযাত্রায় উপস্থিত থাকে। তাদের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে উপস্থিত থাকে। আপনি যদি সেই দৃষ্টির অধিকারী হোন তাদের দেখতে পাবেন। তবে তাদের মুখ করুণ নয়। তারা যে জগতে গেছে সেখানে শুধুই আনন্দ। মৃত্যুর পরের জীবনে পুর্গাতোরি বলে কিছু নেই। নরক বলে কিছু হয় না। আত্মা সেখানে অপেক্ষা করেন কোনো গভীর আত্মার দ্বারা শাপমুক্ত হতে। পূর্বের জীবনের প্রতি তার অনুশোচনা হয়। নিজের জীবন নষ্ট করে দেবার জন্য, অন্য মানুষের কাছে ভয়াবহ হয়ে ওঠার জন্য তার আত্মা লজ্জায় সিঁটিয়ে থাকে।
জুলিয়াস সিজারের আত্মা তার সারা জীবনের পাপের অনুশোচনায় জর্জরিত হয়েছিল। অন্ধকারে ডুবে ছিল বহুদিন। তার মেয়ে জুলিয়ার আত্মা এসে তাকে উদ্ধার করে। যদিও তার একমাত্র মেয়ে জুলিয়া সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে সিজারের মৃত্যুর অনেক আগেই মারা যান। পৃথিবীতে যেমন আমাদের গুরু থাকেন যারা আমাদের পথ দেখান, মৃত্যুর পরেও কোনো আলোকিত আত্মা আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করে ক্রমশ উন্নত স্তরের দিকে নিয়ে যান।
ব্যারি তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুতে অসম্ভব ভেঙে পড়েন। তাঁর শবযাত্রায় কিছু বলার জন্য যখন অল্টারে উঠেছেন শোক ও বেদনায় তাঁর গলা রুদ্ধ হয়ে আসছে। কী বলবেন তিনি? বলার শক্তিই যে হারিয়ে ফেলেছেন। এমন সময় হঠাৎ তাঁর মধ্যে যেন কিসের শক্তি এসে গেল। এত সুন্দর করে তিনি বললেন যে উপস্থিত মানুষেরা মুগ্ধ হয়ে গেল। তাঁর বন্ধু জুডি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন ব্যারি যখন ব্যকুল হয়ে উঠেছে তখন তাঁর মৃতা স্ত্রী এসে তাঁর কাঁধে হাত রাখলেন। জুডি পরলোক নিয়ে চর্চা করতেন। পরে ব্যারিও বলেছেন এর পরে যতবার তিনি অন্যের শবযাত্রায় গেছেন খুব ভিড়ভাট্টা না থাকলে প্রতিবার মৃত আত্মার উপস্থিতি স্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন।
মৃতেরা তাঁদের শবযাত্রায় উপস্থিত থাকেন।
মৃতেরা আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকেন। তাঁরা অন্য একটা জগতে থাকেন। যেটা আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই থাকে, আমাদের পাশে পাশে থাকে কিন্তু আমাদের দৃষ্টির বাইরে। এমন এক জগত যার ডায়মেনশন আলাদা। যাঁরা বাস্তবে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছেন তাঁরা সকলে একরকম ‘টানেল ভিসনের’ কথা বলেছেন। যেন একটা ওয়ার্ম হোল। যার মাধ্যমে তাঁরা এই জগত থেকে অন্য জগতে যাত্রা শুরু করেছিলেন মাত্র। এই মহাবিশ্ব ছাড়াও এমন অনেক মহাবিশ্ব থাকতে পারে বা আছে। আমরা কেবল তাকে দেখতে পাচ্ছি না। আমরা হয়ত তেমনই কোনো বিশ্বের এক সাইমুলেশন। আমাদের আবার সেখানে ফিরে যেতে হবে। ওখানে কোনো শিশু তার ভিডিও গেমটি চালিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে কখন সে আবার জেগে উঠে তার কম্পিউটারটা বন্ধ করে। ততক্ষণ আমার আপনার আয়ু। তার রাতটুকু। রাতের নিদ্রাটুকু।
আপনি ঘরে ঢুকলেন, কোথাও বেড়াতে গেলেন, কারোর সাথে হঠাৎ দেখা হল- আপনার মনে হল আরে আমি তো আগে কখনও এই ঘটনা দেখেছি! আমি যেন… যেন জানতাম এমনটা হতে পারে! আপনি বিভ্রান্ত, বিমুঢ় কিন্তু এমন ঘটনা আমাদের সকলের জীবনেই হয়। আমরা বলি দেজাভু। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের মস্তিষ্কের কোনো পুরনো স্মৃতি হঠাৎ করেই নতুনের সাথে আংশিক মিল খুঁজে পায় এবং জেগে ওঠে।
কোয়ান্টাম ফিজিসিস্ট বলবেন কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলমেন্টের কথা। আ গ্লিচ্ ইন টাইম। আপনার আমার বেডরুমেই অনেক প্যারালাল ইউনিভার্স আছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি না কারণ তারা অন্য ফ্রিকোয়েন্সিতে আছে। মিশিও কাকু যেমন বলেছেন। মনে করুন আপনার রেডিও। একই সাথে অনেক ফ্রিকোয়েন্সি বা স্টেশন যাই বলুন না কেন তাতে টিউনড হতে পারে। আপনি শুধু সেটাই শুনবেন যেটা আপনি টিউন করেছেন। তাই অন্য জগত আমাদের কাছে অদৃশ্য। কিন্তু সময় মাঝে মাঝে কিছু সেই বিভিন্ন জগতের বিভিন্ন তরঙ্গে আবর্তিত হবার শৃঙ্খলাকে ভেঙে দেয়। তাই সেই মুহূর্তের মধ্যে আমি আপনি এই জগতে অন্য জগতের সেই ফ্ল্যাশব্যাক স্মৃতি দেখতে পাচ্ছি। গ্লিচ বা বলুন একটা সামান্যতম বিচলন আমাদের সেই অন্য জগতের ইঙ্গিত বয়ে আনতে পারে।
আত্মাও তার মৃত্যুর পরে এমন বিভিন্ন স্তরের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ উচ্চ ‘চেতনার’ দিকে পৌঁছে যায়। কখনও সে অবয়ব কখনও শুধুই আলো। আলোর দন্ড। সাদা আলো তার উজ্জলতায় ভাসিয়ে দিচ্ছে সবকিছু। আপনি কখনও আপনার আরাধনায় আপনার সাধনায় তার দেখা পেতেও পারেন। কেউ কেউ তো পায়। আপনি তাকে ঈশ্বরও বলতে পারেন। কে বলতে পারে ঈশ্বরও হয়ত তেমনই কোনো পবিত্রতম আত্মা সোওল। যদিও এসব ভাবনা আমার পক্ষে অন্যায্য। আমি আমার জীবনকে তাঁর অন্বেষণে সমর্পন করি নি। যাঁরা করেছেন তারা হয়ত কেউ কেউ সেই আলোকবর্তিকা প্রত্যক্ষ করেন।
আপনি আমার এই প্রলাপে কান দেবেন না। আমরা যারা লিখি, যারা কবি তারা এই মায়ার জগতে বাস করি। একটা ট্রান্স বা ঘোর যেন। যেন সৃষ্টির এক চিরকালীন পাগল কোনো ঘোর আমাদের ঘিরে থাকে। কথকতা, কাব্য, স্মৃতি, অনুষঙ্গ সবকিছু মাঝেমাঝে ঘিরে থাকে। আমি-আমরা চলি, বসি, ভাবি, সহবাস করি সব যেন একটা ঘোর। ইচ্ছে করে এই ঘোরের মধ্যে ডুবে থেকে নিজেদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা। এও যেন একরকম আত্মহত্যা। আত্মরতি। ফরিদ মিঞা নমাজ পড়ার ভঙ্গিমায় হাঁটু মুড়ে বসে যেমন বলেছেন- ‘কিস্যা লিখলে বড় একা হয়ে যেতে হয় জনাব। আল্লা যাকে কিস্যা লেখার হুকুম করেন, তার জীবন জাহান্নম হয়ে যায় জি’।
এই একার জগতে ডুবে থাকা, একার অন্ধকারে ডুবে থাকা, একার আলোতে ভেসে ওঠা এই সব কিছুর মধ্যেই আমাদের যাপন। আমরা যারা কিস্যাওলা কিস্যার ফিরি করি তারা অনেকেই এইসব জগতে বিশ্বাস করি। আপনি হয়ত বলবেন এগুলো ই এস পি বা এক্সট্রা সেনসরি পার্সেপশন, হতে পারে কিন্তু আমি তাদের ঘিরে ধরি। তাদের জন্য অপেক্ষা করি। এমনই নানা বিশ্বাস নানা সংস্কার তাদের ঘেরাটোপে নিজেকে ভাসিয়ে দেবার মধ্যে একটা ‘সেলফ অ্যালাইনেশন’ আছে। যারা আমার মত মুরাকামির ভক্ত তারা জানেন এই সেলফ্ অ্যালাইনেশন কী। তার উপন্যাস জুড়ে শুধুই স্বপ্ন, বিড়াল, অবাস্তব যৌনতা আর সেলফ্ অ্যালাইনেশন।
কিস্যার এই পৃথিবী কেজো লোকের পৃথিবী নয়। কবিতা লেখার থেকে সামাজিকতা করা অনেক ভালো কাজ। কবিতা লিখে কারো ভাত যেমন জোটে না তেমনি সে কাউকে ভাত জুটিয়েও দিতে পারে না। মানিকের দিবারাত্রির কাব্য নিশ্চই পড়েছেন। যদিও উপন্যাসের পরতে পরতে ফ্রয়েডিয়ান প্রভাব তবু ওটা একটা পৃথিবীর আশ্চর্যতম উপন্যাস। উপন্যাস না কবিতা। তার কবিতা কোনো কবি একবারেই লিখতে পারেন, একটা মোক্ষম সময়ে যে সময় তার ঘোর লেগে গেছে। সেই ঘোরে। তাকে তিনি কখনও পুনর্বার লিখতে পারবেন না। ওটা একবারই লেখা যায়। মানিক চাইলে হয়ত আরেকটা ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ বা ‘পদ্মানদীর মাঝি’ লিখলেও লিখতে পারতেন কিন্তু ‘দিবারাত্রির কাব্য’ উনি হাজার চেষ্টা করলেও দ্বিতীয়বার লিখতে পারতেন না। ওটা একবারই সম্ভব।
তাই এই স্বপ্ন, এই অন্য ভুবন, আত্মা এরা জাগতিক নয়। এই দৃষ্টি এই বোধ কখনও আসে। হঠাৎই। সময়ের তরঙ্গে একটু বিচলন, কেউ হয়ত তার পালকের মত নরম হাত রেখেছে সময়ের শরীরে, তার ওই কেঁপে ওঠাটুকুর মধ্যে আপনার সামনে অন্য জগত এসে হাজির হতে পারে। অন্য জগতের কেউ এসে হাজির হতে পারে। আমি তো বিশ্বাস করি। এমন হতে পারে। একে বিশ্বাস করায় কোনো লাভ নেই কিন্তু অবিশ্বাস করায় লাভ আছে। তাই মেহের আলি বলে বেড়াচ্ছেন, সব ঝুটা হ্যাঁয়। আপনি ভেবে দেখুন আপনি আমার মত সেই পিশাচপ্রাসাদে প্রবেশ করবেন কিনা!
অনেক রাত হয়েছে। মালদায় আছি। আবার একা। ইউরোপিয়ান কাপ চলছে। রাতের খেলা। ওখানে দেখা যায় না। সাবস্ক্রিপশন নেই। তাই মোবাইলে রেজাল্ট জেনে গান শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। জানালা খোলা। বাইরে বৃষ্টি। জোলো হাওয়া ঢুকছে ঘরে। হঠাৎ বোধ হল কোনো এক কঙ্কালসার হাত যেন পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। ভালোবাসায়। যেভাবে আমার মেয়ে আমাকে ঘুমে জড়িয়ে ধরে। আমার স্ত্রী ধরে। ছোটবেলায় আমার মা ধরতেন। তেমন করে। আমি পাশ ফিরে আছি। ‘সে’ পেছনে। আমি যেন তার ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে প্রাচীন হাত অনুভব করলাম। আমি সারাজীবন যত স্বপ্ন দেখেছি তা চোখের দেখা। সেই প্রথম কোনো স্বপ্নকে যেন আমি অনুভব করলাম। স্পর্শ করলাম। আমার ভয় পাওয়া উচিত ছিল না কিন্তু কোথা থেকে যেন সেই আদিম ভয় আমাকে গ্রাস করল। কিন্তু আমি অচল, অনড়। রেম স্লিপের প্রভাবে আমার নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই।
ঝটকা মেরে উঠে পড়লাম। চারিদিকে শুনশান। গভীর রাত। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। এ আমি কী দেখলাম? এত স্পষ্ট, এত ট্যাঞ্জিবল। এও কি সময়ের তরঙ্গে কোনো গ্লিচ? এও কি আমি? আমার অন্য সেলফ? সেই শিশুটির মত দেখা করতে এসেছে আমার সাথে? তার নিজের সাথে? (শেষ)
কিছু সময় নিজের জন্য থাক
কিছুটা সময়
তরঙ্গিত সময়ের ঢেউয়ের ত্বকের নীচে
ধাপচাষের আবাদি
বেগ্নি অর্কিড আপেল গুরাস
মুর্গি চড়ে বেড়ায়
বিকেল নামে
সরলরেখায় আলো চকিতে সরে যায়
হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি
দুহাত তুলে দিয়েছে
ভিটেবাড়ি কামড়ে ধরার লোভে
হয়েও উঠতে পারে
সাদাকালো তৃণভূমি
ফাটলের অবয়ব
তরমুজ বিক্রেতার মুখ
আনারস ক্ষেতে ঝুঁকে থাকা নারী
পাকা পার্সিমম ফলের রক্তিম আভা
পাথুরে নদীটির গর্ভে
স্বেদ বীজ রেখে গেছে
বধ্য রাখা ভালোবাসা
শুকিয়ে আসা
ফাল্গুনের অনুভূতিমালা আমার
মুছে ফেলতে হল আয়নায় ধুলো
বেদনা কেন দুর্লভ হল
কেন দুর্লভ হল একটানা বৃষ্টির দিন রাত
কিছু কিছু লেখা নিজের জন্য থাক
শুধু নিজের জন্য