ডাক্তারি জগতে আমার কাজটা খানিকটা ব্যাকস্টেজে অর্থাৎ মূল স্টেজে কলাকুশলী যারা তাদের ওপর আলো প্রক্ষেপণ। রোগের কারণ খুঁজে বের করাই আমার প্রধান কাজ। প্রত্যেকদিন বাড়িতে ল্যাবরেটরীতে কাজ করতে গিয়ে আমাকে ভিটামিন ডি রিপোর্ট করতে হয়। বেশ কিছুদিন ধরেই যে কটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ভিটামিন ডি রিপোর্টের জন্য এসেছে সবকটি আমি স্বাভাবিকের থেকে কম পেয়েছি।
প্রথমে ব্যাপারটা নিয়ে বিশেষ গা না করলেও পরে কি মনে হয় সারা বছরে যত ভিটামিন ডি হয়েছে তার পরিসংখ্যানটা জোগাড় করি এবং তা থেকে যে তথ্য আমার সামনে সামনে উঠে এসেছে তা ভয়াবহ। বস্তুত যতগুলি ভিটামিন ডি রিপোর্ট করবার জন্য আমার কাছে এসেছে তার ৬০ থেকে ৭০% রিপোর্টে ভিটামিন ডি এর মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে কম। বিষয়টি বুঝবার জন্য আমি ইতিমধ্যে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কিছু প্রবন্ধ পাঠ করি এবং তাতে দেখি আমার পাওয়া পরিসংখ্যান মোটামুটি ভাবে প্রকাশিত পরিসংখ্যানগুলির সঙ্গে একই রকমের। ভিটামিন ডি রক্তে ন্যূনতম 30 ng/ml থাকার কথা, সেখানে বেশিরভাগ রোগীর ভিটামিন ডি 20ng/ml থেকে কম অর্থাৎ প্রত্যেকেই ভিটামিন ডি অভাবে ভুগছেন। এদের মধ্যে কুড়ি শতাংশ রোগীর ভিটামিন ডি মাত্রা 10 ng/ml এর কম। আমার এক বন্ধু চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, সে আমাকে বলল তারাও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। আপাতভাবে সুস্থ কিন্তু সামান্য গা হাত পা ব্যথা, পেশিতে টান এই জাতীয় সমস্যা নিয়ে যে সমস্ত রোগীর আসছেন তাঁদের ভিটামিন ডি করাতে দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগেরই ভিটামিন ডি এর মাত্রা বেশ কম। কেন এরকমটা হচ্ছে তা একটু বুঝে নেওয়া যাক।
ভিটামিন ডি র গল্প আমরা সবাই জানি। সেই যে চামড়ার তলায় সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি দ্বারা 7-dehydrocholesterol থেকে cholecalciferol বা Vitamin D3 তৈরী হয় এবং সেই Vitamin D3 লিভারে গিয়ে 25-hydroxycholecaciferol, তারপর কিডনি তে 1,25-dihydroxycholecaciferol হয়ে সেটা অ্যাকটিভ ফর্মে আসে এবং রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বজায় রাখে। ক্যালসিয়াম হাড়ের গঠন, পেশী সংকোচন, স্নায়ু সংবেদন মতো কাজগুলো করে থাকে। এই গল্প অল্পবিস্তর সবার জানা। ভিটামিন ডি র অভাবে ছোটদের রিকেট আর বড়দের অস্টিওম্যালাসিয়া হয় এও আমরা জানি।
কিন্তু এই যে বিশাল সংখ্যক মানুষ ভিটামিন ডি র অভাবে ভুগছেন তাদের কি কি সমস্যা দেখা দিচ্ছে?
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটি ব্যাপক হারে দেখা যায় এবং রিকেট-এর কথা তো আমরা জানি কিন্তু আপাতভাবে প্রাপ্ত বয়স্ক সাধারণ মানুষ তার একটু গা কটকট করা, পিঠে কামড়ানো ব্যাথা তাদের ভিটামিন ডি-র অভাব আছে। কেস স্টাডি বলছে অনেকের কোন উপসর্গ না থাকলেও ভিটামিন ডি-র অভাব পাকস্থলী বা অগ্ন্যাশয় ক্যান্সারের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে। কেস স্টাডি এও বলছে শুধু তাই নয় অবসাদ, ঘনঘন সর্দি কাশি, পারকিনসন অসুখ সবেই গিয়ে এই ভিটামিন নাক গলায়। এমন কি নাকি আত্মহত্যা প্রবণতাও বাড়ায়।
কিন্তু কেন এই দশা?
আসলে ভিটামিন ডি র নব্বই ভাগ তৈরী হয় চামড়ার তলায় সূর্যালোক থেকে। আর দশ শতাংশ আসে মাছ বা অন্য আমিষ খাবার থেকে। খাবার থেকে আরেকটা ফর্ম আসে তাকে বলে ergocalcipherol। সেটা প্রয়োজন থেকে অনেক কম। এখন ঘটনা হল শহরের সবাই গৃহবন্দী প্রাণী। সূর্যের দিকে চেও না চোখে ঝিলমিল লেগে যাবে বলে ঘরে থাকি। ছেলেপিলে ঠ্যাঙালেও বাড়িতে থাকবে। ক্রিকেটও মোবাইলে খেলবে। আগের মতো মা-ঠাকুমারা আর বাচ্চাকে রোদে শুকোতে দেয় না। আমাদের কাজ অফিস ঘরে, প্রেম ও সিনেমা হল আর রেস্টুরেন্ট-এ। তাও মাছে ভাতে বাঙালি খাবার দিয়ে একটু পূরণ করে। কিন্তু স্যালমন সার্ডিন মাছে রুই কাতলা অপেক্ষা ভিটামিন ডি বেশী। বাঙালি সেই সমস্ত মাছ পাবে কোথায়? আর উত্তর ভারতে একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মানুষ কোন মাছ খায় না।
নিরামিষাশীর ভরসা দুধ। দুধে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ডি থাকলেও দুধ প্রক্রিয়াকরণের সময় সেই ভিটামিন ডি নষ্ট হয়ে যায়। ভেগানদের কপালে কিছুই নেই। এ ছাড়াও পরিবেশ দূষণের ফলে অতিবেগুনি রশ্মির তারতম্য, সানস্ক্রিন লোশনের ব্যবহার, গ্রামীণ মহিলাদের অল্প বয়সে গর্ভবতী হয়ে পড়া, খাবারে অত্যধিক ফাইবারের মাত্রা– অন্যান্য কারণ ভিটামিন ডি র অভাবের। বিদেশে অফিস গুলোতে নাকি কৃত্রিম আলো যা সূর্যালোকের মাত্রায় অতিবেগুনি রশ্মি তৈরী করে তা ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন রকম UV ল্যাম্পের বিভিন্ন রকম exposure time. তার বিশদে যাচ্ছি না। কিন্তু তারও ব্যর্থতা ইতিমধ্যেই প্রকাশিত।
তাহলে আমাদের হাতে উপায় কি কি?
সূর্যালোকে সময় কাটানো। শহরের কতজন সেটা পারবেন? সারাবছরে সূর্যের রশ্মি দরকার এক হাজার ঘন্টা। তার মানে দিনে তিন থেকে চার ঘন্টা। নাগরিক ব্যাস্ততায় সম্ভব না। আধ পাগল আর আমার মত ভবঘুরে ছাড়া এতক্ষণ সূর্যালোক পাওয়া অসম্ভব।
বর্তমানে আরেকটি উপায় র কথা ভাবা হচ্ছে সেটি হল ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবারের কথা। বিদেশে ইতিমধ্যেই এই নিয়ে বিস্তর প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু ভারতবর্ষের মতো এরকম একটা ভিন্ন খাবার খাওয়ার অভ্যাস আছে এমন দেশবাসীর কোন খাবারে ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ করা হবে সেটিও একটি খুব বড় দুশ্চিন্তার কারণ। 2018 সালে ভারতের সংস্থা FSSAI দুধ এবং দুগ্ধজাত সমস্ত খাবারে ভিটামিন ডি সমৃদ্ধিকরণের প্রস্তাব দেয়। এবং তার সাথে সাথে বিশ্বে তৃতীয় দেশ হিসেবে স্থান নেয় যারা দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবারে ভিটামিন ডি সমৃদ্ধিকরণ করছে। কিন্তু সমস্যা হল এই দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবার সকলের কাছে তো পৌঁছাচ্ছে না। তাহলে উপায় কি? ইদানীংকালে সাধারণ দানাশস্য মূলত গম এবং চালে ভিটামিন ডি সমৃদ্ধকরণের কথা ভাবা হয়েছে। এছাড়াও FSSAI র উদ্যোগে Mission Dhoop অর্থাৎ স্কুলের বাচ্চাদের বেলা এগারোটা থেকে একটা যাবতীয় কাজকর্ম পড়াশোনা ঘরের বাইরে খোলা আকাশের নিচে করবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রত্যেক দিনের ভিটামিন ডি প্রয়োজন 400 থেকে 800 IU। দুধ এবং দুগ্ধজাত প্রোডাক্টগুলিতে FSSAI 550 IU ভিটামিন ডি সমৃদ্ধিকরণের কথা বলেছে। এছাড়াও ভোজ্য তেল, তাতেও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধিকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অথচ এত কিছুর পরেও ভিটামিন ডি ঘাটতি যেমন ছিলো তেমন থেকেই যাচ্ছে। আশা করি আগামী দিনে এই খাবারের মাধ্যমে ভিটামিন ডি সমৃদ্ধিকরণ সার্বিকভাবে এই নিঃশব্দ মহামারীকে রুখতে সক্ষম হবে। ফিনল্যান্ডের মত একটি দেশ যেখানে সূর্যালোক বড়ই কম তারা শুধুমাত্র এই ভিটামিন ডি সমৃদ্ধিকরণের মাধ্যমে তাদের সমস্যা অনেকটাই দূর করেছে। আশা করি আমরাও তা পারবো। ততদিন পর্যন্ত আমাদের কাজ হবে ক্লিনিকে আসা রোগীদের সামান্যতম সন্দেহজনক উপসর্গ পেলে ভিটামিন ডি মাত্রা পরীক্ষা করা এবং তার চিকিৎসা করা।
আর সম্ভব হলে কখনো কখনো ঘরের বাইরে বেরিয়ে একটু রৌদ্রস্নান করেই নিন না, তাতে যদি কিছুটা অভাব মেটে।
Very good information, thank you Dr. Anirban Dutta Sir(Dada)
দাদা, আবারও ধন্যবাদ । খুব ভালো ইনফরমেশন।
আমি চোখের ব্যাপারে কিছু লিখতে চাই, কিভাবে যোগাযোগ করবো বা কোথায় লেখা টা পাঠাবো ?
একটু জানাবেন
Osudh kheye vitamin D er ghatti metano jayna ?