২০১৭ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পড়ছিলাম। জাপানে বৃদ্ধদের নিঃসঙ্গ মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে। জাপানে পরিবার ব্যাপারটা অতি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু পশ্চিমা ঢেউ এসে পরিস্থিতি বদলেছে। অতএব জাপানে বৃদ্ধদের একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গ মৃত্যু বিরল নয়। প্রতিবেদন অনুসারে, সেদেশে প্রতি সপ্তাহে এমন মৃত্যুর সংখ্যা গড়ে প্রায় চার হাজার।
উল্লেখিত প্রতিবেদন টোকিওর উপকণ্ঠে অতিকায় এক হাউজিং কমপ্লেক্সের জীবন নিয়ে। আক্ষরিক অর্থেই অতিকায় হাউজিং। কয়েক হাজার ফ্ল্যাট সেখানে। ১৯৬০-এর দশকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, জাপানের অর্থনীতি যখন তরতর করে এগোচ্ছিল, তখন তৈরি হয় এমন হাউজিং। একাধিক। আর্থিকভাবে উচ্চবিত্ত কিংবা উচ্চ-মধ্যবিত্তরাই থাকতে পারতেন শুধু। ভাড়ার অন্তত সাড়ে পাঁচগুণ মাইনে না পেলে ফ্ল্যাটের আবেদনই করা যেত না। উজ্জ্বল ও বিত্তবান তরুণ-তরুণীদের প্রজন্ম, যারা ভাঙাচোরা এক দেশকে পৌঁছে দেবে অর্থনৈতিক সাফল্যের শিখরে, তাঁদের জন্যই এমন আবাসন। প্রতি ফ্ল্যাটে ফ্রিজ-টিভি-ওয়াশিং মেশিন, রান্নাঘর প্রথাগত জাপানি বাড়ির মতো পেছনে না থেকে ফ্ল্যাটের মাঝখানে, সেখানে ঝকঝকে স্টেনলেস স্টিলের সিঙ্ক – সে এক ঝলমলে জীবন। যথাসময়ে আবাসনের চকচকে বাসিন্দাদের জীবনে সন্তান-সন্ততি আসে – মাঠ সুইমিং পুল ভরে ওঠে ফুটফুটে বাচ্চাদের হাসি-আনন্দ-দুষ্টুমিতে। প্রাণোচ্ছল ও রঙীন এক জীবনের ছবি। শুধু যদি ছবিটা এরকমই থেকে যেত!
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘আর্থিক বৃদ্ধি’ শ্লথগতি হয়। আর যেহেতু সবকিছু ছেড়ে অর্থনৈতিক উন্নতি আর পশ্চিমানুসারী জীবনযাপনকেই সাফল্যের চূড়ান্ত মাপকাঠি ধরা হয়েছিল, সেই বৃদ্ধির হার হ্রাস পেতে থাকলে আর কিছুই হাতে থাকে না। সাফল্যের পিছনে বন্ধুহীন দৌড় যখন ব্যর্থ হয়, পড়ে থাকে শুধু একাকিত্ব, থাকে শুধু নিঃসঙ্গতা…
আবাসনের ঘরে মরে পড়ে থাকেন নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা। মরাপচা দুর্গন্ধ নিকটবর্তী ফ্ল্যাটে না পৌঁছানো অব্দি কেউই খবর পায় না। অনেকসময় তো তাহলেও পায় না। একটি ঘটনায় যেমন, মৃতদেহ আবিষ্কার হয় যখন, তখন তা আর দেহ নেই, কঙ্কাল মাত্র। রান্নাঘরে বেসিনের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা এক কঙ্কাল, আর তার সঙ্গে মিলেমিশে থাকা কিছু পোকামাকড়। জানা যায়, মানুষটা মারা গিয়েছেন প্রায় বছরতিনেক আগেই। ব্যাঙ্কের আমানত থেকে বিভিন্ন বিল মেটানো হতো অটো-পে পদ্ধতিতে। সেই আমানত শূন্য হয়ে বিল বকেয়া না হলে, কে জানে, কবে কেউ খবর পেত মানুষটার! আরও আশ্চর্য, কয়েক দশক সেই আবাসনের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও কেউই চিনতেন না তাঁকে।
যাঁরা বেঁচে আছেন – বেঁচে থেকে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুণছেন – বা, নিঃসঙ্গ মৃত্যুর আতঙ্কে ভুগছেন – তাঁদের বেঁচে থাকাটাও অকল্পনীয়। যেমন, নব্বইয়ের কোঠায় পৌঁছে যাওয়া এক ভদ্রমহিলা আরেক ফ্ল্যাটের বাসিন্দাকে দায়িত্ব দিয়েছেন শুধু তাঁর ফ্ল্যাটের জানালাটুকুর দিকে লক্ষ রাখার। কেননা, তিনি রোজ রাত্তিরে জানালার পর্দা টেনে দেন আর সকালে উঠেই সেই পর্দা সরিয়ে দেন – যদি কোনও সকালে দেখা যায় যে পর্দা টানা রয়েছে, তার অর্থ…। নিয়মিত নিঃসঙ্গ মৃত্যুর ঘটনায় উৎকণ্ঠিত হয়ে কয়েকজন মিলে অসুস্থ ও আশঙ্কাজনক অবস্থার বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বেঁচে আছেন কিনা তার খেয়াল রাখেন। না, ভালো আছেন কিনা, তার খেয়াল রাখা নয় – স্রেফ বাসিন্দা বেঁচে আছেন নাকি মরে গেছেন, তাঁদের কাজ সেটুকু জানা। ফ্ল্যাটের দরজা দিয়ে মল-মূত্র-জমে থাকা আবর্জনার দুর্গন্ধ এলে তাঁরা স্বস্তিবোধ করেন, কেননা এসবই প্রাণের চিহ্ন। অন্তত মরা পচার দুর্গন্ধ তো নয়…
পড়তে পড়তেই কেমন একটা আতঙ্ক বোধ করছিলাম। আমাদের শহরের আবাসনগুলোর ভবিষ্যতও কি এইরকম নয়? অন্তত আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তাহলে? সাফল্য ও স্বাচ্ছন্দ্যের মাপকাঠিগুলো এতখানিই পশ্চিমের তারে বাঁধা হয়ে গিয়েছে, আমাদের সাবেকি সামাজিক জীবন আপাতত শুধুই স্মৃতি আর নস্ট্যালজিয়া। উদয়াস্ত অর্থোপার্জনের পেছনে দৌড়ানোর শেষে মদ-মোচ্ছবে উইকএন্ড আনওয়াইন্ডিং হতে পারে, হাতে হাত রাখার বন্ধু মেলা দুষ্কর। একমুখী উন্নতির স্বপ্নে বড় হওয়া পরবর্তী প্রজন্ম ইঁদুর-দৌড়ে সামিল – কতটুকু সুযোগ বাকিদের খবর রাখার!! রাখতে চাইলেও কতটুকু সম্ভব, যখন উচ্চশিক্ষান্তে কাজের সুযোগ এই রাজ্যে অমিল, ক্রমশ দেশেও?
আমাদের বার্ধক্য ক্রমশ অতি সঙ্কটময়। আমাদের বলতে সবারই। সমাজের বিপুল অংশের মানুষের ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষার বন্দোবস্ত নেই। যাঁরা শারীরিক শ্রম দিয়ে আয় করেন, বার্ধক্যে তাঁরা কী করবেন? তাঁদের চাইতে আরেকটু ভালো অবস্থায় যাঁরা, অর্থাৎ যাঁদের ব্যাঙ্ক কিছু আমানত রয়েছে, ক্রমহ্রসমান সুদ ও ক্রমবর্ধমান মূল্যের বাজারে তাঁরাই বা কেমন রয়েছেন? বা থাকবেন? আর মধ্যবিত্ত? এমনকি উচ্চ-মধ্যবিত্ত? অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয় – অতি বার্ধক্যে মানুষ চান একটু সান্নিধ্য। তা জুটছে কি? জুটবে কি? বয়স্ক মানুষ উৎপাদক নন, গুছিয়ে কেনাকাটা করার মতো উপভোক্তাও নন। কাজেই সরকার বা বাজার কেউই তাঁদের কথা ভাববেন না। ভবিষ্যৎ বার্ধক্যের কথা মনে রাখলে ভাবতে হবে নিজেদেরই। বৃহত্তর স্বার্থে না হোক, অন্তত নিজেদের স্বার্থেই। সাফল্যের লোভে দৌড়ে চলার মাঝে একটু থমকে দাঁড়াতে পারলে – ভবিষ্যত বলতে শুধুই আরও ভালো গাড়ি আরও বড় বাড়ি আরও এক্সোটিক হলিডে ডেস্টিনেশন নয়, ভবিষ্যৎ বলতে বুড়ো হওয়া, ভবিষ্যৎ বলতে নির্ভরশীল হওয়া, এটুকু বুঝতে পারলে – ‘আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি’ কথাটিকে কোনও মহৎ আদর্শ হিসেবে নয়, স্রেফ নিজের ও নিজেদের ভালো থাকার জন্যই অত্যন্ত জরুরি ভাবনা হিসেবে দেখা যেতে পারে। ভাববেন কি?