আণবিক বোমা ফেলার বিতর্কিত সিদ্ধান্তে যে সব লোকজন যুদ্ধবাজ আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সমর্থনে দাঁড়ান, তাঁদের হাজির করা যুক্তিগুলির অসারতা প্রমাণ করার জন্য পপকর্ন পেপসি হাতে “ওপেনহাইমার” দেখে আসলেই সুধী পাঠক, আমার আপনার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, তার জন্য অন্য ন্যারেটিভের একটু আধটু খোঁজ খবর নিতে হবে, এই যেমন ধরুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের লেখা একটা গোপন ডায়েরি।
ওই গোপন ডায়েরীটা আবিষ্কার হয় পটসড্যাম সন্মেলনের তেত্রিশ বছর পরে ১৯৭৭ সালে। ওই ডায়েরিতে ট্রুম্যানের নিজের হাতে লেখা তথ্যের অনেক কিছুই পরে ট্রুম্যানের অফিসিয়াল স্মৃতিকথায় বাদ গেছে। ট্রুম্যানের গোপন ডায়েরি লেখা হয় জুলাই মাসের ১৬, ১৭, ১৮, ২০, ২৫, ২৬ এবং ৩০ তারিখে। সুধী পাঠককে ঘটনাবলীর তারিখগুলো একটু খেয়াল রাখতে অনুরোধ করবো।
৭ই জুলাই রওয়ানা দিয়ে ট্রুম্যান পটসড্যামে পৌঁছান ১৬ তারিখ। পরের দিন সন্ধেবেলায় যুদ্ধ সচিব স্টিমসনের কাছ থেকে আণবিক বোমার পরীক্ষামূলক সফল বিস্ফোরণের খবর পান। ভাষাটা ছিল, “operated in this morning, diagnosis not yet complete, but results seem satisfactory but already exceeds expectations,” স্টিমসনের ভাষায়, “খবরটা পেয়ে প্রেসিডেন্ট খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন।”
১৮ই জুলাই তারিখে লেখা ডায়েরির পাতা থেকে জানা যাচ্ছে যে জাপানের আত্মসমর্পণের আবেদন জানিয়ে স্ট্যালিনের লেখা চিঠির উত্তর পাওয়া গেছে জাপান সম্রাটের কাছ থেকে। উত্তরটা নেতিবাচক। এর প্রতিক্রিয়ায়, ট্রুম্যান লিখছেন, “Stalin also read his answer to me. It was satisfactory. Believe Japs will fold before Russia comes in”. পাঠককে মনে রাখতে হবে যে তখন পর্যন্ত রাশিয়া জাপানের সাথে যুদ্ধ শুরু করেনি, কিন্তু জাপান সীমান্তে রাশিয়া বিপুল সৈন্য সমাবেশ করে ফেলেছিল যারা জাপান সীমান্ত পেরোবার জন্য প্রস্তুত।
এর পরের লাইনে ট্রুম্যান লিখছেন যে, “I am sure, they (Japan) will (surrender) when Manhattan [আণবিক বোমা] appears over their homeland”. এই ভাবভঙ্গি কোনো গণতান্ত্রিক দেশের কর্ণধারের চেয়ে পাড়ার তোলাবাজ মস্তান, যে দেশি পিস্তলে অভ্যস্ত, সে যদি হঠাৎ করে একটা এ কে ফর্টি সেভেনের মালিক হয়ে যায় তার হাবভাবের সাথে বেশি মিল পাওয়া যাচ্ছে না?
ডায়েরি থেকে আরো জানা যাচ্ছে যে এটম বোমা নিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করলেও ট্রুম্যান কিন্তু স্টালিনকে ওই নিয়ে কিছুই জানাননি তবে উপযুক্ত সময়ে সেটা জানানোর ইচ্ছে ছিল। যদিও এখন সুধী পাঠক জানেন যে গুপ্তচর বাহিনীর দৌলতে স্ট্যালিনের কাছে ম্যানহাটান প্রজেক্ট-এর নিয়মিত তথ্য সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল। ট্রুম্যান এটা আদৌ জানতেন না। ফ্যাসিস্ট মুক্ত আগামী বিশ্বে তাঁর তুরুপের তাসটি স্ট্যালিনের সামনে মেলে ধরতে তাই এই ইতস্তত ভাব।
এর পরে ২০শে জুলাই তারিখের ডায়েরিতে ট্রুম্যান ট্রিনিটি টেস্ট বা পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের বিস্তারিত বর্ণনা লিখে রাখছেন। নিজের গোপন ডায়েরিতে এত কিছু লেখার কি দরকার ছিল? যুদ্ধবাজের আত্মপ্রসাদ লাভ? যাই হোক, স্পেকুলেট না করে আমরা বরং ফিরে যাই তথ্যের দিকে। ওই বর্ণনার ঠিক পরের লাইনটা হল হাড় হিম করা, “The weapon is to be used against Japan between now and August 10.” অর্থাৎ বোমা ফেলার দিনটা আগেই ঠিক হয়ে গেল।
ট্রুম্যান আরো লিখছেন যে তিনি যুদ্ধ সচিবকে নির্দেশ দেন বোমা ফেলার জন্য মিলিটারি টার্গেট ঠিক করতে। জাপানিরা যতই “স্যাভেজ”, “রুথলেস”, “মার্সিলেস” হোক না কেন, মুক্ত বিশ্বের নেতা হিসেবে তাঁর পছন্দ নয় যে এমন শহর যেখানে অনেক বেসামরিক মানুষ বসবাস করেন যেমন নতুন রাজধানী টোকিও বা পুরানো রাজধানী কিয়োটোতে বোমা ফেলা হোক। দ্বিচারিতা ঠিক কোন মাত্রা নিতে পারে সুধী পাঠক খেয়াল করবেন।
সেদিনই ট্রুম্যান ঠিক করে ফেলেন যে “we will issue a warning statement (আগামী ২৬ তারিখে জারি হতে যাওয়া চরম পত্র যেটা পটসড্যাম ঘোষণাপত্র হিসেবে খ্যাত) asking Japs to surrender and save lives. I am sure, they will not do that”. অর্থাৎ ট্রুম্যান নিশ্চিত ছিলেন যে ঘোষণাপত্রটা আদৌ কোনো কাজের হবে না এবং বোমা ফেলতেই হবে। কিন্ত কি ভাবে উনি এতটা নিশ্চিত ছিলেন ওই পত্রের অসারতা নিয়ে? সেটা আমরা এক্ষুনি দেখবো।
এর পরে জাপানের উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারি দিয়ে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয় ২৬ জুলাই তারিখে। সেই চরমপত্রের ভাষাটা খেয়াল রাখতে হবে আমাদের। লাস্টের আগের লাইন, ” We call upon the Government of Japan to proclaim now the unconditional surrender of all Japanese armed force and to provide adequate assurance of their good faith in such action”
ট্রুম্যানের উপদেষ্টাদের মধ্যে যাঁরা জাপান বিশেষজ্ঞ ছিলেন, যাঁরা জাপানিদের কালচার এটিচ্যুড কিছুটা হলেও বুঝতেন তাঁরা ট্রুম্যানকে জানিয়েছিলেন যে ওই “নিঃশর্ত” শব্দটাতে জাপানিরা কিছুতেই রাজি হবে না। তাঁদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করেই ওই শব্দটা রাখা হয় কারণ ট্রুম্যান ও তাঁর সহযোগী যুদ্ধবাজ উপদেষ্টারা সত্যি সত্যি চাইছিলেন না যে বোমা ফেলার আগে জাপানিরা আত্মসমর্পন করুক।
আত্মসমর্পণ প্রসঙ্গে ১০ তারিখে অর্থাৎ নাগাসাকিতে দ্বিতীয় বোমা ফেলার পরের দিন ট্রুম্যান লিখছেন, “ate lunch at my desk and discuss the Jap offer to surrender which came in a couple of hours earlier. They wanted to make a couple of conditions precedent to the surrender. Our terms are ‘unconditional’. They wanted to keep the Emperor. We told them, we would tell them how to keep him but we would make the term.”
ট্রুম্যান ও তাঁর যুদ্ধবাজ উপদেষ্টারা সহ সমর্থকরা বারবার যুক্তি সাজিয়েছেন যে হুঁশিয়ারি সত্বেও জাপানিরা কথা শোনে নি। ঘোষণাপত্রের লাস্ট লাইনটা ছিল, “The alternate for Japan is prompt and utter destruction” ইত্যাদি। কোথাও এটম বোমা সম্পর্কে একটুও উল্লেখ নেই। In fact, ট্রুম্যানের উপদেষ্টাদের মধ্যে একদল তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিল যে গোপনে নয়, প্রকাশ্যে মিডিয়ার সামনে, সকলের সামনে নমুনা বোমা ফাটানো হোক যাতে সবাই তার বিধ্বংসী ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা করতে পারে। এবং সেটা হবে ভয় দেখানোর জন্য যথেষ্ট। রক্তপাতহীন এই ব্যবস্থা গ্রহণ ট্রুম্যানের মনঃপুত হয় নি। যদি ওই বোমা ঠিক মতো না ফাটে তা হলে সবার কাছে হাসির খোরাক হতে হবে এই ছিল ট্রুম্যানের যুক্তি।
গোপন ডায়েরির বাইরে সামান্য দুটো তথ্য হাজির করা যায়। বোমা ফেলার এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ট্রুম্যান কোনো দিন কোনো অনুতাপ করেন নি যতদিন বেঁচে ছিলেন। ওপেনহাইমার অনুতাপ প্রকাশ করাতে তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে উনি “crybaby” বা “কাঁদুনে বাচ্ছা” বলে উপহাস করেছিলেন। তাঁর সাথে সাক্ষাৎকারের সময় বিচলিত ওপেনহাইমার যখন নাটকীয় ভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে হাতে রক্ত লেগে আছে, তখন ট্রুম্যান কোটের পকেট থেকে রুমাল বের করে ওপেনহাইমারকে রক্ত মুছে ফেলতে বলে ছিলেন। সাংবাদিকদের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় ট্রুম্যান বলেছিলেন যে, “when you have to deal with a beast, you have to treat him as a beast.”
প্রথম বোমাটা হিরোশিমায় ফেলার পেছনের যুক্তিগুলো অসারতার পর এবার আমরা চোখ রাখবো নাগাসাকিতে দ্বিতীয় বোমাটা ফেলার যুক্তির সন্ধানে আদৌ যদি কিছু থাকে। প্রথম বোমা ফেলার পরে ৬ই আগস্ট তারিখের বেতার ভাষণে ট্রুম্যান বলেন, “Japanese began the war from the air at Pearl harbor. They have been repaid many fold.” দিনের শেষে যুদ্ধ তাড়াতাড়ি শেষ করার তাগিদ ইত্যাদি অসার যুক্তি সরিয়ে বেরিয়ে আসে কেবলই নগ্ন প্রতিহিংসা নেয়ার মনোভাব, “রিপেইড মেনি ফোল্ডস”।
এখানেই শেষ নয়, ৯ই আগস্ট তারিখের বেতার ভাষণে ট্রুম্যান জানালেন, “হিরোশিমা বোমা একটা সাবধানবাণী মাত্র, যতক্ষণ না জাপান আত্মসমর্পণ করছে লাগাতার বোমা ফেলে যাওয়া হবে।” ভাবুন একবার, আণবিক নয়, মনে হচ্ছে চকোলেট বোমা ফাটানোর কথা বলা হচ্ছে। হিরোশিমা বোমার পরে নাগাসাকি করার একটাই কারণ। এই নির্মম মনোভাব সবাইকে বুঝিয়ে দেওয়া যে যুদ্ধবাজদের অভিধানে বিবেক দংশন বলে কোনো শব্দ নেই, অনুতাপ বলে কোনো শব্দ নেই।
আসলে বোমা ফেলার সিদ্ধান্তটা কেবল সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ছিল এমনটা ভেবে নিতে পারেন কেবল চূড়ান্ত সরল বা নির্বোধ। তাঁরা বুঝতেই চান না যে গোটা বিষয়টা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল জিও পলিটিক্যাল ইস্যু’র সাথে। ওই দুটো বোমা কেবল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দুটো বোমা বিস্ফোরণ নয়, ওগুলো ছিল ফ্যাসিস্ট মুক্ত বিশ্বে নতুন করে শুরু হওয়া ঠাণ্ডা যুদ্ধের প্রথম দুটো বোমা বিস্ফোরণ। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গড়ে উঠতে যাওয়া সমাজতান্ত্রিক শিবিরের প্রতি আণবিক বোমা সমৃদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের আস্ফালন। দেখো, আমাদের ভান্ডারে কি শক্তিশালী অস্ত্র আছে, তোমাদের হাতে নেই। আমাদের কথা না শুনলে তোমাদেরও এই হাল করে ছাড়বো।
ট্রুম্যানের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে রাশিয়া ওই আণবিক বোমা বানাতে পারবে না। আণবিক বোমার অধিকারী হিসেবে তথাকথিত মুক্ত বিশ্বের সর্বাধিনায়ক হিসেবে তিনি ও তাঁর দেশ ছড়ি ঘোরাবে। তাঁর সেই ইচ্ছে কতটা পূরণ হয়েছে বা হচ্ছে সেটা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। হাজার লক্ষ জাপানিদের প্রাণের বিনিময়ে সেই উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য ট্রুম্যানের নেতৃত্বে সেদিনের যুদ্ধবাজ শিবিরের বিবেকে বিন্দুমাত্র বাধেনি।
অনেকদিন হল ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসান হয়েছে, আজ আমরা প্রায় এক মেরু বিশ্বে বসবাস করছি। আণবিক বোমার তথাকথিত জনকের ব্যাক্তিগত জীবনের ট্র্যাজেডিকে বিশ্বখ্যাত পরিচালক অসাধারণ দক্ষতায় মেগা হিট বানিয়ে বেচে দিতে পারেন। সুধী পাঠক ছবি দেখে আধুনিক প্রমিথিউসের জন্য আপনার আমার চোখ ছলছল করে উঠবে। কিন্তু সুকৌশলে নির্মিত ওই ভাষ্য আপনার মনে যুদ্ধবাজ ট্রুম্যান ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের জন্য কোনো ঘেন্নার জন্ম দেবে না, আণবিক বোমার বীভৎসতার জন্য আপনার গা গুলিয়ে উঠবে না, আপনার হাত থেকে পেপসি পপকর্ন এর ঠোঙ্গা পরে যাবে না, আপনি আমি এক মেরু বিশ্বের শান্ত সভ্য বিশ্ব নাগরিক যে।
বিশ্বাস করুন, মানবতার স্বার্থে ওই গা গুলিয়ে ওঠাটা খুব জরুরী ছিল আমার আপনার জন্য। আজ চলুন একটি বারের জন্য বমি করে আসি এই সাম্রাজ্যবাদের গায়ে। এটাই আমাদের প্রতিবাদ। নাগাসাকি দিবসে এটাই হোক আমাদের শপথ। নেহাৎই সাধারণ মানুষ হিসেবে শপথ গ্রহণ করি যে মনুষ্যত্বের অবমাননাকারীদের, বিশ্বাসঘাতকদের ক্ষমা করবো না কোনোদিন। তাদের প্রতি পবিত্র রাগ ও ঘৃণার আগুন যেন আমাদের মনে জ্বলে থাকে, নাগাসাকি দিবস যেন ভুলে না যাই কোনোদিন। যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই।