আপনার ফ্র্যাকচারের ব্যথা কমানোর জন্য বেশ কড়া ব্যথার ওষুধ দিতে হল। সঙ্গে ভালো করে অ্যান্টাসিড দিলাম। খেতে ভুলবেন না।’
‘অ্যান্টাসিড লাগবে না। ঘরে প্যান্টি আছে। খাইয়ে দিয়েছি।’
‘মানে?’ ব্যাপারটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। মনে মনে বললাম, এত কঠিন জিনিস কি করে খাওয়ালেন?
ওষুধের উপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ প্রায় না থাকার ফলে আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ Pantoprazole এবং অন্য নিয়ন্ত্রিত ওষুধ ওষুধের দোকান থেকে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই নিজেরা কিনে খেতে পারে।
আমাদের দেশে ওষুধের দোকান থেকে, এমনকি মুদির দোকান থেকে (আমি সিকিমের এক প্রত্যন্ত এলাকায় স্টেশনারি দোকান থেকে ওষুধ কিনেছিলাম) ব্যথার ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক, ব্লাড প্রেসারের ওষুধ ওষুধের দোকানদারের পরামর্শ অনুযায়ী কিনে খায় লোকে। তার জন্য ব্র্যান্ডেড বা জেনেরিক- কোনো প্রেসক্রিপশনই লাগে না। প্রায় ১০০% ক্ষেত্রে ওষুধের দোকানদার ব্র্যান্ডেড ওষুধই বেচে- জেনেরিক নয়। তখন মানুষ জেনেরিক ওষুধ খোঁজে না।
জেনেরিক এবং ব্র্যান্ডেড ওষুধ নিয়ে জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন বা National Medical Commision (NMC)-র কিছু গাইড লাইন বেরিয়েছে। সারা দেশের সমস্ত RMP (Registered Medical Practitioner) অর্থাৎ জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনে রেজিষ্ট্রিকৃত চিকিৎসকদের বলা হয়েছে প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক ওষুধ লিখতে।
কথাটা শুনতে খুব ভালো। তত্ত্ব হিসেবেও। কিন্তু দেখতে হবে এটা বাস্তবে আমাদের ১৪৪ কোটির দেশে নিয়ন্ত্রণহীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কি আদৌ সারাদেশব্যাপী লাগু করা সম্ভব? না কি অনেক কিছুর মত এটাও একটা গিমিক।
প্রথমেই বলে রাখি মুষ্টিমেয় কয়েকজন স্বনিয়োজিত শহুরে চিকিৎসকের মত আমিও বেশীরভাগ প্রেসক্রিপশন কম্পিউটারে EMR সিষ্টেমে করে থাকি। তাতে ওষুধের ব্র্যান্ড নামের সাথে সাথে জেনেরিক নামটাও ছাপা হয়। কিন্তু আমি একজন অর্থোপেডিক সার্জেন। আমার কজনই বা রোগী! আর ওষুধ মোটেই আমার চিকিৎসার মূল উপকরণ নয়। তাই এই বিরাট দেশে জনা কয়েক শহুরে চিকিৎসক বা শহর কেন্দ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দিয়ে গোটা দেশের পরিস্থিতি বিচার করা সম্ভব নয়। কারণ দেশের বেশীরভাগ অঞ্চলে বাস করে আধুনিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বঞ্চিত দরিদ্র ভারতবাসী। তাদের অবস্থান মুম্বাই, দিল্লী, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ, কলকাতা থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে। সেখানে রাজত্ব করে অপাশকরা গ্রামীণ চিকিৎসক- জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন তাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা নয়। এছাড়া হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ, ইউনানি- এইসব চিকিৎসা ব্যবস্থার উপরও মানুষ অনেকাংশে নির্ভরশীল। তারাও অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ- যেগুলো কিছু মানুষ কেমিক্যাল বলে জানে এবং মনে করে (যেন আয়ুর্বেদিক, ইউনানি বা হোমিওপ্যাথিক ওষুধে কোনো রাসায়নিক পদার্থ থাকে না!)- সেগুলো ব্যবহার করে চিকিৎসা করে। সেসব ক্ষেত্রে কিন্তু ব্রান্ডেড-জেনেরিক ওষুধ বিতর্ক আসছে না। কারণ সমস্ত হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ, ইউনানি এবং অপাশকরা গ্রামীণ চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণ করা জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের পক্ষে সম্ভব নয়।
কিছু কিছু বিষয় জেনে নেওয়াটা এক্ষেত্রে জরুরী। যেমন,
জেনেরিক ওষুধ আসলে কি?
কোন একটা ওষুধের রাসায়নিক নাম যাতে ওষুধে কি রাসায়নিক বস্তু আছে তা বোঝা যায় তা হল জেনেরিক নাম। এছাড়া ওষুধটা যে কোম্পানী বিক্রি করে সে কোম্পানী একটা নাম দেয়। তাকে বলে ব্র্যান্ড নেম বা বাণিজ্যিক নাম। ওষুধটি যদি কোনো ভারতীয় কোম্পানীর গবেষণালব্ধ বা পেটেন্টেড পণ্য হয় তাহলে ভারতীয় পেটেন্ট আইন (1970)-এর 2 নম্বর ধারা অনুযায়ী ওষুধটি বাজার জাত করার একচেটিয়া অধিকার একমাত্র তাদেরই। আর ওষুধটি যদি কোনো বিদেশী কোম্পানীর গবেষণালব্ধ বা পেটেন্টেড পণ্য হয় তাহলে ‘গ্যাট (GATT)’ এবং ‘WTO’ চুক্তি অনুযায়ী সেই ওষুধের উপর ওই কোম্পানীর একচেটিয়া অধিকার সুরক্ষিত। এখন অন্য কোনো কোম্পানী ওই ওষুধ বিক্রি করতে চাইলে যে কোম্পানীর পেটেন্ট তাকে রয়ালটি দিতে হবে।
ওষুধের গবেষণায় শত শত কোটি কোটি টাকা খরচ হয়- কারণ কয়েক শত রাসায়নিক নিয়ে কাজ করতে শুরু করলে ল্যাবরেটরী, মনুষ্যেতর শরীর এবং মানব শরীরে গবেষণা ও প্রয়োগের স্তর পেরিয়ে হাতে গোণা মাত্র দু-চারটি রাসায়নিক পদার্থ ওষুধ হিসেবে মানব শরীরে ব্যবহারের এবং বাজারজাত করনের যোগ্যতা অর্জন করে। স্বভাবতঃই এই গবেষণার খরচ ওষুধের দামের সাথে যুক্ত হওয়ার ফলে ওষুধের দাম অনেক গুণ বেড়ে যায়।
একটা উদাহরণ দিই। ১৯৮৮ সালে বাবার টাইফয়েড হওয়াতে CIFRAN 500 mg ট্যাবলেট কিনেছিলাম এক একটি ট্যাবলেট ৪৮ টাকা। আজ ২০২৩ সালে গবেষণার পেটেন্ট উঠে যাওয়ার পরে তার দাম প্রতি ট্যাবলেট ৫ টাকা।
এত দামী পেটেন্টেড এবং ব্রান্ডেড ওষুধ গরীব রোগীদের নাগালের বাইরে থাকে। এই প্রবল দাম এড়ানোর দুটো উপায় আছে। এক, ওষুধের পেটেন্টের সময়সীমা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা।
দুই, ওষুধের কার্যকারিতা বজায় রেখে উপাদানের খুব সামান্য অদলবদল ঘটিয়ে পেটেন্ট আইন এড়িয়ে সস্তা দামে ওষুধ সহজলভ্য করা। একেই বলে জেনেরিক ওষুধ।
এখন বিভিন্ন দেশের আইন অনুযায়ী এই অদলবদল হয় বিভিন্ন রকমের। যেমন, আমেরিকায় FDA এর আইন অনুযায়ী এই পার্থক্য হতে পারে সর্বোচ্চ ০.১ শতাংশ। ভারতবর্ষে এই পার্থক্য আইন অনুযায়ী ৫ থেকে ১০ শতাংশ।
৩০০০-এরও বেশি ওষুধ কোম্পানী নিয়ে ভারতের ওষুধশিল্প আজ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম। ভারতের ওষুধ শিল্প আইনের এইসব ফাঁকগুলো ব্যবহার করেই এত বড় হয়েছে। তাদের করের টাকায় দেশের কোষাগার স্ফীত। কর্মসংস্থান হয়েছে প্রচুর শিক্ষিত যুবক-যুবতীর। যদিও প্রদীপের নীচেই আসলে অন্ধকার। এই ৫ থেকে ১০ শতাংশের আঘাত সইতে হয় ভারতবর্ষের আমজনতাকে। কোনো কিছু সস্তায় পেতে গেলে অন্য কোথাও তার জন্য দাম তো দিতেই হবে!
এই যে জেনেরিক ওষুধ নিয়ে এত কথা হচ্ছে- এর উৎস কোথায়? উৎস উন্নত দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। আমরা সব কিছুতেই তাদের অক্ষম নকল করতে যাই। বেশীরভাগ উন্নত দেশে স্বাস্থ্য হয় সরকারী, নয়ত প্রায় সকল নাগরিক স্বাস্থ্য বীমার সুবিধাপ্রাপ্ত। কঠোরভাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত। আমাদের দেশে ঠিক উল্টো পরিস্থিতি। গ্রামেগঞ্জে সরকারি নিয়ন্ত্রনের কোনো বালাই নেই।
নিয়ন্ত্রিত গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ ওযুধের দোকানে প্রেশক্রিপশন ছাড়া বিক্রি দূরস্থান, বেসরকারি ওষুধের দোকানের অস্তিত্বই নেই!
আমাদের দেশে প্রচলিত হাজার হাজার সংমিশ্রিত ওষুধ (combination medicine)। তার মধ্যে আছে বহু অযৌক্তিক সংমিশ্রণ। যে ওষুধের half life ১৮ ঘন্টা (দিনে একবার খেতে হবে), তার সঙ্গে একই ট্যাবলেটে সংমিশ্রিত আছে আর একটা ওষুধ, যার half life ৮ ঘন্টা (অর্থ্যাৎ দিনে তিনবার খেতে হবে)। একমাত্র সামান্য কয়েকটা fixed dose combination ছাড়া আর কোনো combination উন্নত দেশে অনুমতি প্রাপ্ত নয়। আর এই fixed dose combination (যেমন Amoxycillin + Clavulanic acid)। শুধুমাত্র এগুলোই ওদেশে ব্র্যান্ডেড ওষুধ। বাকী সমস্ত জেনেরিক ওষুধ।
সব শেষে আবার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আসি। সঙ্গের ছবিটা নিশ্চয়ই সবাই চিনতে পারছেন? পারছেন না? না পারলে বলি- এগুলো চারকোল (অর্থ্যাৎ কাঠকয়লা) ট্যাবলেট। তখন বেশ কয়েকদিন অম্বলে-এ ভুগছি। Over the counter (OTC) medicine অর্থাৎ ওদেশে ওষুধের দোকানে যে ওষুধ পাওয়া যায় তা খেয়ে দেখলাম। কাজ হল না। তখন পাড়ার জেনেরাল প্র্যাকটিশনারকে বললাম। তিনি এই ধরনের চারকোল ট্যাবলেট আমাকে দিলেন। যতই খারাপ লাগুক, ওগুলোই খেতে হল। কারণ, ওখানে ইচ্ছেমত ওষুধ কিনে খাওয়া যায় না।
Ref: 1.https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC2900001/
2.https://vakilsearch.com/blog/indian-pharmaceutical-patent-laws/
(চলবে)