খবরের কাগজ খুললেই IVF সেন্টারের পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। টিভিতে, রাস্তাঘাটে চলাফেরার পথে বাস, অটোর পিছনে একই ধরণের বিজ্ঞাপন । সব দেখেশুনে মনে হয় কিছুদিনের চেষ্টায় বাচ্চা না এলেই কোনো IVF সেন্টারে ছোটো আর বাচ্চা নিয়ে বাড়ি যাও। আজকাল যদি মহিলার বয়স ৩৫ এর ওপরে হয় তাহলে তো ধরেই নেওয়া হয় মা হওয়ার একমাত্র উপায় IVF। এমনই একজন বছর ৩৬ এর চাকুরিরতা মহিলা যার মাত্র ৪ মাস আগে বিয়ে হয়েছে, চেম্বারে এসে সরাসরি বললেন, আমার IVF চাই। কত খরচ হবে? সঙ্গে তাঁর স্বামীও ছিলেন। বুঝলাম তাঁরা দুজনেই বিজ্ঞাপনের মোহে ভালো রকম মোহাবিষ্ট।
বাচ্চা না হলে IVF একটা চিকিৎসা, কিন্তু সবার IVF এর দরকার হয় না। সামান্য কিছু পরীক্ষা, ছোটোখাটো চিকিৎসায় এবং অনেক কম খরচে infertility-র সমাধান সম্ভব। দুজনের সাধারণ স্বাস্থ্য ছাড়াও স্বামী ও স্ত্রীর কিছু আলাদা পরীক্ষা করে সহজেই নির্ণয় করা যায় কেন সন্তান আসতে দেরি হচ্ছে। যেমন মহিলাদের ক্ষেত্রে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নেওয়া AMH, FSH, TSH, , LH, Progesteron ও Prolactinএর কী কন্ডিশন। যা দেখে সন্তান না হওয়ার একটা কারণ আন্দাজ করা যায়। দরকার হলে Ultrasound করে দেখা হয় ovaryতে ওভাম কী পরিমাণ আছে, সেখানে কোনও Cysts আছে কিনা, কিংবা জরায়ুতে adenomyosis বা fibroid-এর জন্য প্রেগন্যান্সিতে বাঁধা আসছে কিনা। কারো কারো ক্ষেত্রে HSG করে দেখে নেওয়া হয় ইউটেরাইন ক্যাভিটিতে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কিনা ও fallopian Tube খোলা আছে কিনা।
শুধু স্ত্রীর নয়, স্বামীরও semen analysis করে দেখা হয় sperm quality ঠিক আছে কিনা। এই পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রায় ৪০-৫০% infertility-র জন্য দায়ী পুরুষ। যদিও আমাদের সমাজ এখনও মনে করে সন্তান না হওয়ার জন্য দায়ী শুধু মেয়েরাই। যদিও নানা কারণে ছেলেদের সিমেনের কোয়ালিটি খারাপ হতে পারে। যেমন, মদ, সিগারেটের অভ্যাস থাকলে, ওজন বেশি হলে। যদিও অনেক সময়েই এর কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই তামাক ও অ্যালকোহলের নেশা ছাড়লে ওজন ঠিকঠাক হলে, মাল্টি ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সাপ্লিমেন্ট নিলে এই সমস্যার সমাধানের সম্ভাবনা আছে।
আবার অতিরিক্ত মোটা বা রোগা হলেও মহিলাদের প্রেগন্যান্সিতে সমস্যা হতে পারে। মোটা মহিলারা তাঁদের ওজনের ৫-১০% কমালেই স্বাভাবিকভাবে প্রেগন্যান্ট হতে পারেন। একইভাবে রোগাদের ওজন বেড়ে স্বাভাবিক হলে তাঁরাও সন্তানধারণে সক্ষম হন। আজকের দিনে স্বামী-স্ত্রীর ব্যস্ত কর্মজীবনের কথা ভুললে চলবে না। কাজের চাপে অনেকেই শারীরিকভাবে সময়মতো মিলিত হতে পারেন না। ফল সন্তান আসতে দেরি হওয়া বা না আসা। যদিও ওভিউলেশনের অসময় মিলিত হন স্বাভাবিক প্রেগন্যান্সির চান্স অনেক বেড়ে যায়। Timed intercourse এখন recommend করা হয় না। এতে স্বামী, স্ত্রীর মধ্যে অযথা stress দেখা দেয়। সপ্তাহে ২-৩ বার intercourseই যথেষ্ট।
স্বামী –স্ত্রীর সব পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে এসে গেলে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু হয়। মেয়েদের অনিয়মিত ওভিউলেশনের জন্য খাওয়ার ওষুধ দেওয়া হয়। ওষুধ খাওয়ার সময় আল্ট্রাসাউন্ড করে দেখে নেওয়া হয় যে ওভারি ঠিকমতো কাজ করছে কিনা। অনেক সময় আবার IUI পদ্ধতিও প্রয়োগ করা যায়। একটা ছোটো catheter-এর সাহায্যে স্পার্ম সরাসরি uterus-এর মধ্যে পৌছে দেওয়া হয়। ডাক্তারবাবুর চেম্বারের এটা করা হয়। এর জন্য মাত্র ১০ মিনিট সময়ই যথেষ্ট। IUI তাদেরই করা যায় যাদের অন্তত একটা ফ্যালোপিয়ান টিউব ভালো অবস্থায় থাকে। যদি স্বামীর শুক্রাণুর সংখ্যা খুব কম থাকে তাহলে দম্পতির সম্মতি নিয়ে sperm bank থেকে নেওয়া Donar-স্পার্ম ব্যবহার করা হয়। আর IVF এর তুলনায় অনেক কম খরচে এই চিকিৎসা করা যায়। এর সাফল্যের হার ১০-১৫% এবং তা নির্ভর করে infertility-র কারণের ওপর।
ইনফার্টিলিটির কারণ যদি হয় Endometriosis, Chocolate Cyst, Polycystic Overies, Tubal block, Fibroid, Pelvic adhesions, Endometrial polyp ইত্যাদির মতো সমস্যা, তখন Laparoscopic বা Hysteroscopic surgery করে স্বাভাবিকভাবে সন্তানধারণের সম্ভাবনা বাড়ানো যায়।
ভাবছেন, যদি কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া না যায় তবে কী করবো? দেখুন ৩০% ক্ষেত্রে সব পরীক্ষা করেও সন্তান না আসার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এই সব মহিলাদের একটু বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়। তবে এও ঠিক, তাঁরা যে কোনোদিন সফল হবেন না, এমন নয়। আর কাজেই আগেভাগে IVF-এর কথা না ভেবে সাধারণ চিকিৎসার মাধ্যমে সন্তানলাভের কথা ভাবুন। কারণ IVF-বন্ধ্যাত্ব দূর করার একরকম চিকিৎসা মাত্র, একমাত্র চিকিৎসা নয়। take home baby rate হলও ৪ জনে একজন। IVF-এর খরচের দিকটাও মাথায় রাখুন। ২৫,০০০ টাকায় IVF-হয় না। বিজ্ঞাপনের নীচে ছোটো অক্ষরের লেখাগুলো ভালো করে পড়ুন। বিজ্ঞাপনে ৪০-৫০ বা ৬০% এ আপনার কিছু যায় আসে না। যদি বাচ্চা হয় তাহলে আপনার সাফল্যের হার ১০০% আর না হলে কিন্তু ০%।
©️ ডাঃ ইন্দ্রনীল সাহা