কতো ছোট ছিলাম? এখন দাদাদের কাউকে জিজ্ঞেস করলে সঠিক উত্তর কেউ দিতে পারবে না নিশ্চয়ই। আমার বয়স তখন বছর চারেকের বেশী ছিল না সম্ভবত।
আমাদের মাটির বাড়ীর নিচের তলার ছোট ঘরটা ছিল ঠাকুর ঘর। ঠাকুর ঘরের পিছনের দেওয়ালে একটা ছোট জানালা ছিল। এই জানালায় টিনের পাল্লা। এক বর্ষার দুপুরে আমরা তিন চারজন ভাই বোন, ঠাকুর ঘরে বসে খেলছিলাম। বাইরে এক পশলা বৃষ্টির পরও আকাশ কালো হয়ে আছে। তখনকার দিনে গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি। দিনের বেলায় কেরোসিনের আলো জ্বালানোর কথা কেউ ভাবতেও পারত না। প্রায় অন্ধকার ঠাকুর ঘরে আমরা নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত ছিলাম। এমন সময় পিছনের জানালায় ঠক্ ঠক্ ঠক্ ঠক্ করে বার চার পাঁচ শব্দ হতেই আমরা চমকে উঠলাম। বর্ষার দুপুরে ওরকম বিজাতীয় শব্দ একেবারেই অভাবনীয়। পরে ছোড়দা বলেছিল, অবশ্যই মায়ের ধমক খেয়ে, ওটা যে ছাগলের কানের ঝাপটা টিনে লেগে হয়েছিল, ও সেটা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু আমরা চমকে ওঠার সময়, ছোড়দা এমন করে, “ঐ ঠক্ঠকি” বলে উঠেছিল যে, আমি ভয় পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। সে সময় মা বা দিদি কে এসে আমাকে সামলেছিল, এখন আর মনে নেই। কিন্তু এমন ভয় পেয়ে ছিলাম যে, আমার ভুতের ভয় কাটানোর জন্য, কাঠ কয়লা ভেজানো জল খাওয়ানো হয়েছিল আমাকে।
আমাদের ছোট বেলায় গ্রামের বেশীরভাগ বাড়ীই ছিল মাটির। এই বাড়িগুলির জানালাও বেশ ছোট ছোট ছিল। অনেক বাড়ীতেই দেখেছি দুপুর বেলায়ও ঘরের ভিতরটা অন্ধকার। প্রায় সব বাড়িতেই দেখতাম, দুয়ার বা বারান্দা কাঠের বা বাঁশের রেলিং বা বেড়া দিয়ে ঘিরে ঘরের মত ব্যাবহার করা হয়। একমাত্র শীতকালেই ঘরের ভেতরে রাত্রে শোওয়ার ব্যবস্থা। বারান্দার রেলিং, আলো বাতাস চলাচলের জন্য এমন ভাবেই তৈরী করা হত যে, পুরোটাই জানালা বলা যায়। বাতাসের জন্য জানালার দরকার পড়ে একমাত্র গ্রীষ্ম কালে। তখন বারান্দায় , এমনকি খোলা আকাশের নিচে উঠানেও রাত্রে ঘুমাতাম।
আমাদের গ্রামের মাঝখানে বিরাট বড় জায়গা নিয়ে স্বাস্থ্য কেন্দ্র। আমরা বরাবরই হাসপাতাল বলি। হাসপাতালের মূল বাড়ীটা একতলা হলেও বেশ কয়েকটা ঘর নিয়ে, ছড়ানো। মাঝখানের ঘরটা বেশ বড়; আমাদের গ্রামের সাধারণ বাড়ীর যে কোন ঘরের প্রায় তিনগুণ। ঐ বড় ঘরটার পশ্চিম দিক, মানে বড় রাস্তার দিকে, প্রায় গোটা দেওয়াল জুড়েই বিরাট জানালা। এই বড় ঘরের উত্তর দক্ষিণ দু দিকেই বড় বারান্দা। ওই বারান্দার দিকে একটি করে মাঝারি মাপের জানালা। এই জানালাগুলিতে লোহার শিকের বদলে, লোহার গ্রীল লাগানো। এই গ্রীলের নিচের দিকে, মাঝখানে একটু বড় ফোকর। এই ফোকর দিয়ে মিক্সচারের বোতল দেওয়া নেওয়া হত। এই জানালাগুলির ভেতরের দিকে সিমেন্টের বড় তাক। এই তাকে বিরাট বিরাট কাঁচের বোতলে লাল নীল মিক্সচার রাখা থাকত। এই জানালাগুলির বাইরেটাতেও সিমেন্টের তাক। এই রেলের টিকিট কাটার জানালার মত জানালা দুটির উত্তর দিকেরটাই খুলতে দেখেছি; দক্ষিণের জানালাটা বন্ধই থাকত। এই হাসপাতালের মূল বাড়ীর অন্যান্য ঘর আর ডাক্তারবাবুর ও অন্য সব কর্মচারীর কোয়ার্টারের জানালাগুলিও বেশ বড় বড় ছিল। সব জানালায় আড়াআড়ি লোহার শিক লাগানো। জলের ঝাঁট আটকানোর জন্য, সব জানালার মাথার উপর আর পাশে সিমেন্টের সানশেড। সব জানালায় কাঠের পাল্লা ছিল। বহু বছর পরে জানালাগুলিতে লোহার তারের জাল লাগানো হয়েছিল। হাসপাতাল বাড়ী আর সব কোয়ার্টারের খোলা বারান্দাগুলি , যেখানে বৃষ্টির সময় আমারা দৌড়ে গিয়ে উঠতাম, পরে কাঠের ফ্রেমে লোহার জাল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছিল। বছর দশেক হল হাসপাতালের বাড়ী আর সবকটা কোয়ার্টারই পরিত্যক্ত হয়েছে। ডাক্তারবাবুর জন্য একটা নতুন কোয়ার্টার তৈরী হয়েছিল বছর পঁচিশ আগে; সেখানেও বছর কুড়ি আর কেউ থাকে না। হাসপাতালের জন্য একটা নতুন বাড়ী তৈরী হয়েছে। পুরনো হাসপাতাল বাড়ী আর সব কোয়ার্টারের জানালাগুলির কাঠের পাল্লাগুলি, রং উঠে গিয়ে কালো হয়ে গেলেও, জায়গা মত ছিল , এই সেদিন পর্যন্ত।
আর একটা জানালা, আমাদের গ্রামে সব থেকে বেশী বার যার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, সেটা আমাদের গ্রামের পোষ্ট আপিসের জানালা। রাস্তার পাশেই একটা ছোট ইঁটের দেওয়ালের বাড়ী, ছাদ ঢালাই ছিল না, টালির চাল। ওটাই ছিল পোষ্ট মাষ্টারের বাসস্থান আর আপিসও। যেদিকে পোষ্ট কার্ড, টিকিট ইত্যাদি দেওয়ার জানালাটা ছিল, তার উল্টো দিকের দেওয়াল ঘেঁসে শোওয়ার তক্তপোশ। ঐ তক্তপোশের মাথা আর পায়ের দিকেও দুটি জানালা ছিল; ওদিকে কোনদিন যাইনি। সেই পোষ্ট আপিসের বাড়িটাও ভাঙ্গা পড়েছে বোধ হয় বছর চল্লিশ আগে। পোষ্ট মাষ্টারও গত হয়েছেন বছর কুড়ি আগে। এই পোষ্ট মাষ্টার মশাই আবার আমাদের হাই স্কুলের করণিকও ছিলেন। আমরা যখন স্কুলে পড়ি তখন উনি হেডস্যারের বসার ঘরে, বারান্দার দিকের একটা জানালার পাশে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসতেন। অত্যন্ত চড়া মেজাজের মানুষ ছিলেন; তাই আমরা পারত পক্ষে ঐ জানালাটা এড়িয়ে চলতাম।
কলকাতার স্কুলে নতুন এগারো বারো ক্লাশে পড়তে এলাম। চার তলা উঁচু মূল বাড়ী। তার পিছনে একটা তিনতলা বাড়ীতে আমাদের ক্লাস হত। পিছনের বাড়ীর নিচের তলায় একটা আপিস থাকলেও, কিছু কিছু কাজে বড় বাড়ীর নীচের তলার আপিসেও যেতে হত। ঐ আপিসের জানালার উপরে একটা ইংরেজী ভাষায় লেখা বাণী, অনেক পরে এ বাংলায় দারুণ বিখ্যাত হয়ে যায়। লেখা ছিল, “Do it now”! আমরা যখন ঐ স্কুলে পড়ি তখন কেউ জানত না যে, ঐ স্কুলের এক প্রাক্তন ছাত্র রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হবেন।
আমি ঐ শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় ছাড়ার বছর দুই পরে, বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজের ডা বি সি রায় হোস্টেলে থাকতাম। আমাদের হোস্টেলের ঘরের জানালাগুলো বেশ বড় বড় ছিল। কাঁচের জানালা। মাঝের অংশ খোলা যায় না; দু দিকের পাল্লা বাইরের দিকে খোলা যায়। আমরা প্রথম যখন যাই তখন কাঁচে কোন রং ছিল না। পরে সব জানালার কাঁচে বাদামী রং করে দেওয়া হয়। ঐ সময় মাঝের অংশের সব থেকে উপরের কাঁচটা রং না করে সাদা রেখে দিলাম। ঐ বাদামী রং দিয়ে সাদা কাঁচে লিখে দিলাম, “Do it now”। সেই লেখা অনেক বছর ছিল। যে কেউ আমাদের সেই তের নম্বর ঘরে ঢুকলেই চোখে পড়ত,”Do it now”!
ভ্রাতৃপ্রতিম ডা গৌরাঙ্গ এই বাক্য বন্ধ নিয়ে খুব মেতেছিল, সম্ভবত যতদিন পর্যন্ত না ঐ বাক্য বন্ধ একটা রাজনৈতিক কথা হিসেবে বদনাম কুড়োয়। আমরা ঐ হোস্টেল ছাড়ার পরও অন্তত কুড়ি বছর ধরে আমার সাথে দেখা হলে বা ফোনে কথা হলে, গৌরাঙ্গ বলত, “দয়ালদা, ডু ইট নাউ”!
বছর চারেক আগে একবার বাঁকুড়ায় গিয়ে ঐ তের নম্বর ঘরে একবার ঢুকেছিলাম। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পর গিয়েও, জানালায় লেখাটা আছে কিনা খুঁজেছিলাম। না, নেই।
জানালার কথা বলতে বলতে কোথায় চলে যাচ্ছি। স্কুলে পড়ার সময় বার কয়েক, “ডাকঘর” নাটকের অভিনয় দেখেছি। তখন অবশ্য আমরা ওটাকে, “অমল ও দইওয়ালা ” নামেই জানতাম। এখনও ঐ নাটকের কথা কোথাও পড়লেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা ছবি, জানালায় বসে আছে, চাদর গায়ে অমল!
আমি তখন বাঁকুড়া থেকে আবার কলকাতায় ফিরে, পায়ের তলায় মাটি খুঁজছি। আমাদের এক কিংবদন্তি শিক্ষক আমাকে একটা কাজের খোঁজে দক্ষিণেশ্বরের ওদিকে পাঠালেন। একদিন দুপুরবেলা সেই আধা দাতব্য চিকিতসালয় ঘুরে, ফিরে আসার সময় হঠাৎ দেখি, রাস্তার পাশের জানালায় বসে আমার এক সহপাঠী পড়ছে।
সামনে একটা সরকারী চাকরীর পরীক্ষা ছিল। ওর বাড়ী দক্ষিণেশ্বরের ওদিকে কোথাও, এটুকুই জানতাম ; কিন্তু ঐ রাস্তায় ওর বাড়ী জানতাম না। আমার বন্ধুও আমাকে দেখে হৈ হৈ করে উঠল। ওর সাথে গল্প করে, চা খেয়ে ফিরে এলাম। কি গল্প হয়েছিল, এখন আর সব মনে নেই। কিন্তু আমার বন্ধু তখন একটা সরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চাকরীর জন্য কোমর বেঁধে পড়াশুনা করছিল; এটাই এখন প্রায় অবিশ্বাস্য একটা খবর।
আমার বন্ধু সেবার হাজার পাঁচেক লোকের সাথে প্রতিযোগিতা করেছিল, তিনশ পাঁচটি পদের জন্য। ও সেবার পেয়েছিল; আমি আরও চার বছর পর ঐ রকম কঠিন পরীক্ষা দিয়েই চাকরীটা পেয়েছিলাম। আমার বন্ধু বছর পাঁচেক টিঁকে ছিল চাকরীতে। তার বছর পনের পরে একবার বন্ধুপত্নীর মুখেই শুনেছিলাম, %E