ডাক্তারেরা সম্প্রতি রিপোর্টার আর বিচারপতিরও বলা ‘স্রেফ এমিবিবিএস’ বলার প্রতিবাদে নিজেদের প্রোফাইল পিকচারে ‘Proud to be an M.B.B.S.’ লেখা ফ্রেম লাগিয়েছেন। আমি লাগাইনি। কেন?
এই লেখাটা অ-ডাক্তারদের অনেকেরই বুঝতে অসুবিধে হবে। আর ডাক্তারদের অনেকেই পড়ে একমত না হয়ে মাথা নাড়বেন। হয় তো রেগেও যাবেন। তবু…
আমি তো চিরকালই বেশি কথা বলি।
★
আজ আপনারা যাকে স্রেফ এমবিবিএস বলেন, আমাদের শুরুর সময়ে তাকে বলা হত পাতি এমবিবিএস। এই তর্ক বিতর্কে ঢোকার কোনও ইচ্ছেই আমার ছিল না। কিন্তু ঢুকতে হল বাধ্য হয়েই।
খুব ছেলেবেলায় যে গ্রাম হিলোরা বা মফস্বল টাউন রঘুনাথগঞ্জে ছিলাম, সেখানে দুচ্চারজন এমিবিবিএস ছিলেন বটে, বাকি যাঁদের চিনতাম তাঁরা এলএমএফ। তো সেই এমবিবিএস এলএমএফ, যাই হোন, তাঁদেরকেই অসুখ বিসুখ হলে দেখাতাম। তাঁরা দেখেও দিতেন। জ্বর সর্দি কাশি মায় জন্ডিস, সান্নিপাতিক অবধি। শুধু কী তাই? হাড় ভাঙা, পোয়াতি খালাস (বাচ্চা ডেলিভারিকে তাইই বলত মা মাসিরা), একশিরা কাটা, আরও হরেক কিসিমের কাজ জানতেন সেই একা কুম্ভরা। এখনকার মত ‘এমডি’ ‘এমএস’ ডাক্তারের খোঁজ করা হত না তখন। অবশ্য ইতি মধ্যে চাহিদা বেড়েছে। লোকে ‘ডিএম’ ‘এমসিএইচ’ খুঁজছে হন্যে হয়ে।
পুরোনো সেই দিনের কথা ছেড়ে এবার জাম্পকাট। সত্তরের দশক। মেডিকেল কলেজ। আমার ছাত্রাবস্থায় মেডিকেল শাস্ত্রের কুলীন অকুলীন ভাগটা ক্রমশ ছায়া মেলল চোখের সামনে। যদিও এখনের মত তত প্রকটভাবে নয়। আস্তে আস্তে মাথায় গেঁথে গেল, নামের পেছনে ইংরেজি বর্ণমালার পেখম লাগাতে হবে। নইলে ডাক্তারি জীবন বৃথা। সেই বটল নেক না পেরোতে পারলে কদর নেই। ডাক্তারি ব্যাপারটি যে হাতে কলমে শেখার এক গুরুমুখী বিদ্যা, সেটা আংশিক ভুলে গিয়ে শুরু হল এলিমিনেশন টেস্টে উতরে যাবার এক দুরূহ লড়াই। ভোগে যাক ক্লিনিকস, হাতে কলমে শিক্ষা।
আগে বিচার্য নামের পেছনে পেখম আছে কি না। দেশি হলে ভাল, বিদেশি পেখম হলে আরও ভালো। সমাজ তাইই চাইছে। এবং চাইছে নিজের জ্ঞান বুদ্ধি মত। কলেজে আমার গাইনির মাস্টারমশাই সি.এস দাঁকে এক রোগিনী নাকি জিজ্ঞেস করেছিল, – আহা, ডাক্তারবাবু, আপনি এমডি তো বুঝলাম কিন্তু ডিজিও তো?
তখনও আম জনতার একাংশ জানত, গাইনির ডাক্তার মানে ডিজিও আর বাচ্চাদের ডাক্তার মানে ডিসিএইচ।
এইখানে নামের পরে পেখম জোড়াবার আলো আঁধারি রহস্যটি বলি। আশির দশকের শুরুতে পোস্টগ্রাজুয়েট এন্ট্রান্সএ এল এমসিকিউ মানে মাল্টিপল চয়েস কোশ্চেনের গোলকধাঁধা। হাজার হাজার ধাঁধা বুকে নিয়ে চলে এল কতশত বই। সেই সময়ের ঠিক আগে সদ্য ডাক্তারেরা পছন্দের কাজ শেখার জন্য হাউসস্টাফশিপ খুঁজত সেই ডিপার্টমেন্টে। এখন তারা সেই পছন্দের বিষয়ে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করবে বলে কাজ কম এমন ডিপার্টমেন্টে হাউসস্টাফশিপ করে। এখন আবার বইয়ের চেয়েও জরুরি হরেক কিসিমের কোচিং।
কাজ শিখে নেওয়া যাবে পোস্ট গ্র্যাজুয়েটে চান্স পাবার পর।
পোস্ট গ্র্যাজুয়েট পড়ার ঠিক আগের আর্থ-সামাজিক চিত্রটিও বিচিত্র। সে অবশ্য বহু আগে থেকেই। নইলে ভাবী শ্বশুরের টাকায় বিলেত যাবার সিনেমা-গল্প তৈরি হল কী ভাবে। সেও তো সেই বিলেত গিয়ে অক্ষর জোগাড়েরই প্রকরণ ছিল। যে লিগ্যাসিতে আজও কর্পোরেটে বিলেতফেরতের কদর।
সেই আর্থ-সামাজিক চিত্রের অন্য দিকটিও বলি। সন ১৯৮০। সেই বছরে একই সঙ্গে স্রেফ এমবিবিএস হল এক উচ্চাশাহীন, বস্তুত প্রত্যাশাহীনও এক কেরানি পুত্র আর এক অতি উচ্চবিত্ত শ্রেষ্ঠীপুত্র। বলে নেওয়া যাক, ইতিমধ্যেই ভারতে এই প্রদেশে নয় যদিও অন্যান্য দুএকটি প্রদেশে পরীক্ষা না দিয়ে টাকা দিয়ে ভর্তি হয়ে এমডি এমএস করা শুরু হয়ে গিয়েছে। সে সময় সেই ভর্তি হবার এই ক্যাপিটেশন ফি-কে আঙুরফল টকের দল বলত ডিক্যাপিটেশন ফি।
কেরানিপুত্রর পাখির চোখ একটি সরকারি চাকরি। তার টাকা নেই, সুলুকসন্ধানও জানা নেই। এমবিবিএসের রেজাল্ট শ্রেষ্ঠীপুত্রের চেয়ে বেশ কিছুটা ভালো এই যা। সেই চাকরি সে পেয়ে যাবে বেশ কিছু উদ্বেগাকুল দিনের পর।
শ্রেষ্ঠীপুত্র? সে তখন টাকা এবং মেধার (আজ্ঞে হ্যাঁ, উপার্জিত অর্থের সঠিক ব্যবহার করতেও মেধা লাগে বই কি!) জোরে এমএস ডিগ্রি হাসিল করে বিলেত যাবার প্লেনে উঠে বসেছে। যন্ত্রনির্ভর আধুনিক শল্যচিকিৎসার বিদ্যা শিখে সে ফিরবে যথাসময়ে। এবং তার সিদ্ধান্ত সঠিক। পারিবারিক রিয়াল এস্টেট ব্যবসার চাইতেও লাভজনক।
দিন গেছে দিনের নিয়মে। এখন আক্ষরিক অর্থেই যেহেতু ব্যাপারটা যন্ত্র ব্যবহারের পটুত্বের ওপর আর অভ্যাসের ওপরও নির্ভরশীল, স্রেফ এমবিবিএস সেই কেরানিপুত্র আর শ্রেষ্ঠীপুত্রের মাঝে আলোকবর্ষ পার দূরত্ব। উপার্জনের কথা ছেড়ে দিন। জ্ঞানে আর পরাক্রমেও।
এহ বাহ্য, নিজের কথা বলি। আমি নিজে কেন ‘গর্বিত এমবিবিএস’এর ওই ফ্রেম লাগাইনি নিজের প্রোফাইল ছবিতে?
সে আমি কারণ বলে যাই বোঝাই না কেন, আসল কারণ অন্য।
হ্যাঁ, এরকম একটা গল্প বানিয়ে বানিয়ে বলা যেতেই পারত। ধরে নিন, যে কোনও কারণেই হোক, কারওর হাসিমুখ দেখতে ভালোবাসি। গর্বিত ফ্রেম লাগিয়ে সেই একজন নিজের হাসিমুখ ঢেকে রেখেছে বলে তাকে সীমিত টেকনিক্যাল জ্ঞানেই এই ফ্রেম লাগিয়ে, আর হাসিমুখটাও রেখে একটা প্রোফাইল পিকচার বানিয়ে, খুব আবদার করে হাসিমুখ দেওয়া ছবিটা লাগাতে বলেছিলাম। কিন্তু তার আবার অন্য কাউকে কথা দেওয়া আছে, পছন্দের এই প্রোফাইল ছবি পাল্টানো যাবে না। মাননীয় পাঠক ধরে নিন, এই সব জটিল গল্পের অভিমানে আমি তাই আর ওই ফ্রেম লাগালামই না। আজ্ঞে হ্যাঁ, এইরকমের একটা মনগড়া সেন্টুর গপ্পো ঝাড়তে পারলে মন্দ হত না বটে। কিন্তু গর্বিত এমবিবিএস ফ্রেম না লাগানোর কারণটা অন্য।
চুপিচুপি বলি আপনাদের।
এক পোয়াতি মেয়েকে বড় হাসপাতালে দেখানোর ব্যাপারে ক্যাচ দেবার জন্য যোগাযোগ করেছিলাম বয়সে অনেক ছোটো এক গাইনোকোলজিস্টের সঙ্গে। ডাক্তারি ছেড়েছি। কিন্তু ডাক্তারি আমাকে ছাড়েনি। মানে ইয়ে, বারফাট্টাই মেরে একে তাকে বলি তো, অমুক ডাক্তার তমুক লজিস্ট আমাকে খুব মান্য করে। সেই বেশি কথা বলারই সাইড এফেক্ট এই ক্যাচ মারার জনসেবামূলক কাজ।
তো সেই ক্যাচ মারার পর্বে, এককথা দুকথার পর প্রকাশ পেলো, মানে কথাটা ফাঁস হয়ে গেল এই রকমও বলা যায়, যে এখনকার দিনে স্রেফ এমবিবিএস হতে হলেও যে জ্ঞান থাকা দরকার, আমার তা নেই। মানে ধরুন ফিটাল প্রোফাইল, জেনেটিক অ্যাবনর্মালিটি ধরবার অ্যালগরিদম কিছুই যে আমি জানি না সেই নিদারুণ সত্যিটি।
এই ব্যাপারটি কিন্তু ভেবে দেখার মত। এই যে স্রেফ এমবিবিএস ডিগ্রিটি পাবার পর গত চল্লিশ বছর ধরে নিজের সাবজেক্টের বাইরে অন্য কোনও আপডেটের চেষ্টাও করিনি। (আহা, নিজের সাবজেক্টেরও করেছি কি?)। বিদেশে নাকি কিছু সময় পরে পরে আপডেটেড জ্ঞান আছে কি না জেনে রেজিস্ট্রেশন রিনিউয়াল হয়। শোনা কথা। সত্যি মিথ্যে জানি না।
শেষ কথায় আসি। আমার অতি ভরসার সেই তরুণ ডাক্তারটি, যাঁকে দিয়ে ক্যাচ মারানোর তাল করছিলাম, হতাশ হয়ে বলল, – এখনকার দিনে এই নলেজ নিয়ে তুমি এমবিবিএসটাও পাশ করতে পারতে না। এইটুকুও জানো না, অথচ তুমি নাকি রেজিস্টার্ড ডাক্তার। হুঁঃ…
আমি বুঝলাম।
নতমস্তকে মেনে নেলাম ছবিতে ওই ‘প্রাউড টু বি এমবিবিএস’ ফ্রেম লাগানোর যোগ্যতা নেই আমার।
লাগাইওনি তাই।