আমাদের পাশের বাড়ির রবিনসন, গতকাল যার মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলো, তার গপ্পোটা শোনাবার আগে সত্যিকারের রবিনসনের গপ্পোটা হয়ে যাক। নিউইয়র্ক হারলেমের ১৫ বছরের কৃষ্ণাঙ্গ বাচ্চা ছেলেটা বন্ধুর বার্থ সার্টিফিকেট চুরি করেছিল। বয়েস কমানোর জন্য নয়। বাড়ানোর জন্য। না হলে বক্সিং টুর্নামেন্টে নামার অনুমতি পাচ্ছিল না। রাতারাতি ‘ওয়াকার স্মিথ জুনিয়ার’ হয়ে গেল ‘রে রবিনসন’।
ওয়াটারটাউন নিউইয়র্কে ম্যাচ চলার সময়ে দর্শক আসন থেকে এক মহিলা বলে ফেললেন, “কী মিষ্টি ছেলে! চিনির মতো মিষ্টি!!” ব্যাস। নামের সাথে জুড়ে গেল শব্দটা, সুগার। অন্য বক্সাররা, তাদের ট্রেনাররা আর ক্রীড়া সাংবাদিকরা একবাক্যে মেনে নিয়েছেন যে এই পৃথিবী নামক গ্রহটিতে জন্ম নেওয়া সর্বকালের সেরা বক্সার সেই পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির ছেলেটি। নাম ‘সুগার রে রবিনসন’।
গড়পড়তা আমেরিকানদের তুলনায় ছোটখাটো শরীর দিয়েছিল প্রকৃতি। অসম্ভব পরিশ্রম, অতুলনীয় ডেডিকেশন, মনের জোর এগুলো দিয়ে সেই অসুবিধে অতিক্রম করেছিল রবিনসন।
১৯৯৯ সালে রবিনসন “শতাব্দীর সেরা ওয়েলটারওয়েট বক্সার”; “শতাব্দীর সেরা মিডলওয়েট বক্সার” আর “শতাব্দীর সেরা ফাইটার” আখ্যা পান এসোসিয়েটেড প্রেস-এর কাছ থেকে। ২০০৭ সালে ইএসপিএন-এর “সর্বকালের সেরা পঞ্চাশ জন বক্সার” এর যে তালিকা প্রকাশ করে তাতে প্রথম নাম ছিল রবিনসনের।
মহম্মদ আলির নাম বেশি বিখ্যাত। তিনি গ্রেটেস্ট বলে পরিচিত। তিনি তাঁর প্রতিভার জোরে বিখ্যাত হয়েছেন। তাঁকে ছোট করার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু আলি আর রবিনসনের তুলনার প্রশ্ন মনে আসতেই পারে। এঁরা দুজনে কোনোদিন একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করেন নি। কারণ বক্সিং-এর নিয়ম। বক্সারের দৈহিক ওজন অনুযায়ী কতোগুলো বিভাগ তৈরি হয়। ছয় ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা আলী ছিলেন হেভিওয়েট বিভাগের খেলোয়াড়।
রবিনসনের দক্ষতা ও প্রতিভায় মুগ্ধ ক্রীড়া সাংবাদিকরা একটা শব্দবন্ধ আবিষ্কার করে ফেলেন তাঁকে অন্য বিভাগের বক্সারদের সাথে তুলনা করার জন্য “pound for pound” (ও দেশে ওজন মাপা হয় পাউন্ড দিয়ে)।
মহম্মদ আলী, জো লুই, সুগার রে লিওনার্দের মতো বিখ্যাত বক্সাররা একবাক্যে মেনে নিয়েছেন যে বক্সিং খেলাটার ফেয়ার প্লে স্পিরিট মানতে গিয়ে হেভিওয়েটের সাথে ওয়েলটার ওয়েটের লড়াই চলে না ঠিকই তবে “পাউন্ড ফর পাউন্ড” কনসেপ্ট মেনে নিলে ওই সুগার রে রবিনসনই হলেন ক্রীড়া ইতিহাসের সর্বকালের সেরা মুষ্টিযোদ্ধা। পাউন্ড ফর পাউন্ড হল লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির একটা কনসেপ্ট বা ধারণা। সমানুপাতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
বক্সিং ফেয়ার প্লে নিয়ম অনুযায়ী কোনোদিনই ১০০ পাউন্ড ওজনের কোনো বক্সারকে বলা হবে না, বাদবাকি নিয়মকানুন তো একই, তাই তুমি ভাই ২০০ পাউন্ড ওজনের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নেমে যাও। ভাই রবিনসন, একটু নামো তো দেখি মহম্মদ আলির বিরুদ্ধে। কারণ ওটা ফেয়ার প্লে নয়।
ঠিক তেমনভাবে মাধ্যমিক মেধা তালিকায় যারা স্থান করে নিয়েছে তাদের মেধা বুদ্ধি পরিশ্রমকে কোনোমতেই ছোট করা যায় না। কিন্তু এই সেরার সেরাদের সাথে মেধাতালিকায় যারা জায়গা পায় নি বা প্রথম দশজনের মধ্যে আসতে পারেনি তাদের তুলনা করার প্রশ্নটা অনায়াসে চলে আসে। আমরা হামেশাই করে থাকি। এবং করে থাকি অনায়াসে ভুলে যে এই প্রতিযোগিতায় কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছিল না। ছিল না কোনো “pound for pound” নিয়ম। ৯ জন গৃহ শিক্ষক সহ সারাদিন মুখ গুঁজে পড়াশোনা করার সুবিধে পাওয়া ছাত্র/ছাত্রীর সাথে বাবা হারা সংসারে মায়ের মুদির দোকান চালানোর কাজে সাহায্য করে বড় হয়ে ওঠা, কোনো গৃহশিক্ষকের সাহায্য ছাড়াই পরীক্ষা প্রস্তুতি নেওয়া কোন এক ছাত্র/ছাত্রীর সাথে তুলনা আমরাই করে থাকি।
জীবনতো আর বক্সিং রিং নয়, ফেয়ার প্লে আইন খাটে না। ফেদারওয়েটের বিরুদ্ধে অনায়াসে নেমে যায় হেভিওয়েট। আমরা হঠাৎ চমকে যাই যদি দেখি সুগার রে রবিনসনের মতো কোনো চ্যাম্পিয়ন চলে আসে। ওই মুদির দোকানের মিষ্টি ছেলেটা/মেয়েটার কথাই ধরা যাক।
এই অসম প্রতিযোগিতায় নামতে হয়েছে বলে দুঃখ করার কোনো জায়গা নেই। আবারো বলি যে জীবনের খেলায় বক্সিং এর কোনো নিয়ম চলে না। রিংয়ে নেমে যেতে হয়। তারপরে পাঞ্চ আর জ্যাব আর হুক। নানা ঘুষিতে অনায়েসেই হেভিওয়েটরা বিপর্যস্ত করার চেষ্টা করে ফেদারওয়েটকে। আমরা খালি দর্শক আসনে বসে দেখে যাই কি ভাবে অসম্ভব পরিশ্রম, অতুলনীয় ডেডিকেশন, মনের জোর দিয়ে লড়াই চালিয়ে যায় একের পর এক ফেদারওয়েট। ঘুঁষি খেয়ে মাটিতে পরে গিয়েও নক আউট হয়ে যায় না। আবার উঠে দাঁড়ায় লড়াই এর আঙিনায়। অদৃশ্য রেফারি বারবার গুনে যান এক, দুই, তিন, চার …..
মুখের কষ বেয়ে বয়ে আসা রক্ত, গ্লাভসের উলটো পিঠে মুছে নিয়ে, লঘু পায়ে ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে লড়াই দেয় ছিপছিপে চেহারার আমাদের ঘরের পাশের রবিনসন ।
সুধী দর্শকমন্ডলী, যাঁরা রিং এর চারপাশে বসে আছেন, দিল থামকে বৈঠিয়ে জনাব। আরো হাজারো রবিনসনের লড়াই এখনো বাকি। পৃথিবীটা একদিন না একদিন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে, হবেই। করে ছাড়বো আমরা। আমাদের রবিনসনদের কাছে আমাদের অঙ্গীকার। পাউন্ড ফর পাউন্ড।