স্কুল লাইফে এ রচনা লেখেনি এমন লোক পাওয়া মুস্কিল। অবধারিত ভাবে এ রচনা শুরু হত শরৎ কাল দিয়ে। আকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘ। বর্ষার পর ঝরঝরে আকাশ। পুজোর গন্ধ। ঢাকের আওয়াজ। কাশ ফুল ইত্যাদি সহকারে সে এক ভাসা ভাসি দের পৃষ্ঠা। অথচ আমার নিজের প্রিয় ঋতু বসন্ত আর হেমন্ত। বসন্ত যদি হয় টগবগে প্রেম নিবেদন তো হেমন্ত হল নিভৃত ভালোবাসার একপক্ষীয় প্রেমপত্র। যা কোনো দিন পাঠানো হবে না। লিখেই ছিঁড়ে ফেলা হবে। অথবা রাখা থাকবে ডাইরীর গোপন কোনও ভাঁজে। হেমন্ত হল কষ্ট কষ্ট সুখ। যা বিরহ যাপনের দুঃখ বিলাস নিয়ে থাকে। একেলাই। ভোর রাতে টুপটাপ শিশিরের মত।
আবার বসন্ত হচ্ছে খুনখারাপি ভেসে যাওয়া। আমাদের বাড়ির পেছন দিকে একটা শিমুল গাছ ছিল। জানি না এখনও আছে কিনা। আমবাগান পারকরে পায়ে চলা সুড়িপথ চলে গেছে চুর্ণীর দিকে।সে রাস্তার পাশেই চাষের ক্ষেত লাগোয়া সরু আল। তার ধার ঘেঁষে সুঠাম একটা মাঝারি উচুঁ গাছ। গরমের দুপুরে ঘুড়ি ওড়াতে গেলে ডালে বেঁধে যেত সুতো । এরকম কত কত পেপারে কঞ্চি আর জিগার আঠা লাগানো স্বপ্নের পেটকাটি চাঁদিয়াল ভোঁকাট্টা হোয়ে ঝুলে গেছে তার ডালে! আমরা বিরক্ত ছিলাম। এই শিমুল গাছটা ছিল আমাদের দুপুর বিলাসের কড়া মাষ্টারমশাই। অথচ বসন্ত আসলেই সে এক প্রেমিক পুরুষ। পাতা টাতার মেদ ঝরিয়ে সুঠাম দাঁড়িয়ে থাকতো ফুলের হাতছানি নিয়ে। কতশত পাখি আসতো। পুঁচকে লেজের উরুৎ ফুরুৎ মৌটুসী, কুহুকুহু কোকিল, বউ কথাকও। কোকিল ডাকলে আমরা ভেঙ্গাতাম। সেও সুর চড়িয়ে পাল্লা দিত। তারপর বিরক্ত হোয়ে উরে যেত বাঁশ বাগানের দিকে। বাঁশবাগানে তখন ডাই ডাই শুকনো পাতা। আমরা জড়ো করতাম। এগুলি দিয়ে বুড়ির ঘর হত। দোলের আগের দিন ন্যাড়া পোড়া। মাঝে মাঝে ভেসে আসতো বসাক পাড়া থেকে কীর্তনের সুর। ন্যাড়া পোড়ার আগুনের পাশে বসে আমরা আবিরে মাথাফাটা রং মেশাতাম। এভারেডি ব্যাটারী ভেঙ্গে কালো কার্বন জমিয়ে রাখতাম কাগজে। এরসাথে সর্ষের তেল মিশিয়ে তৈরী হবে জম্পেশ রং। কারও সাধ্য কি তাকে ওঠায়। দোলের অনেকদিন পরও সেটা লেগে থাকতো আমাদের হাতের চেটোতে।
ডাক্তারি জীবনের প্রথম প্রথম যখন রুগী ফুগী হতনা তেমন, মাঝের গ্রাম স্টেশনের কাছে একটা চেম্বারে বসতাম। আমার কালো হোন্ডা টুইস্টারে করে গাংনা পুর পার করে মাঝের গ্রাম। দুপাশে ফাঁকা মাঠ। মাঝখানের কুচকুচে পিচের রাস্তা। রুগী বিশেষ নেই। তাই তাড়াহুড়ো ও নেই। দুপাশে ভাটুল ফুলের জঙ্গল। ডাল উপচে সজনে ফুল। ফাঁকা মাঠে মাঝখানে শ্যালো মেশিন। এসব দেখতে দেখতে যখন চেম্বারে পৌঁছতাম, বিকেল গড়িয়ে গেছে। সাকুল্যে একজন কি দুইজন বসে। রুগী দেখা তো নয়, গল্পগুজব। দোকানদার প্রতিদিন একি কথা শোনাতো। অনেকগুলি নাম লেখা ছিল। এল না কেউ। আচ্ছা দেখি পরের দিন। তারপর প্লাস্টিকের কাপে চা আসতো। পাশের দোকান থেকে। চা ওয়ালা প্রতিদিন প্রেসার মাপাত ফ্রীতে। আমারই বা তাড়া কিসের? বিপি মাপতে মাপতে কথা হত।
লবণ তো ছাইরা দিছি। দূধ টুধ কি খামু! আচ্ছা ছানা খাইলে কি নো পেশার বাড়ে? ইত্যাদি ইত্যাদি।
রুগী ফুগি হতো না তেমন। তবু্ও আমি যেতাম। ওই রাস্তা। বিকেলের হুহু হাওয়া। রাস্তার দুধারের খুনখারাপি বসন্তের লোভে।
এমনি এক বসন্তের রাতে বাবা মারা গেল। ফোন এসেছিল রুগীর অবস্থা খুব খারাপ। আপনারা আসুন। হসপিটাল থেকে মৃত্যুর খবর এভাবেই আসে। সরাসরি বলা না হলেও বুঝিয়ে দেওয়া হয়। বাইকে চেপে যখন যাচ্ছি রাস্তায় ফুরফুরে হাওয়া । হাওয়ায় ফুলের গন্ধ। ছাতিম ফুলের। অথচ কি ভীষণ হাহাকার বুকের মধ্যে।
কিছুদিন পর ন্যাড়া মাথা আউটডোরে বসে আছি। পরিচিত এক বৃদ্ধ এলেন। সাথে ফাঁকা একটা ইনহেলার। আগেরটা সাম্পেল থেকে দিয়ে ছিলাম। শেষ। আর কি আছে!
এইডা নিয়া ভালো আছি বাবু।
না, সেবার আমার কাছে দেবার মত ইনহেলার ছিল না। দিতে পারিনি। সে কিন্তু আমার জন্য এনেছিল সজনে ফুল।
ভাইজা খাইও ডাক্তারবাবু। এগুলন খাওয়া ভালো।
কি জানি কেনও হঠাত বাবার কথা মনে পড়ছিল। কান্না পাচ্ছিল। কে বল্ল বসন্ত শুধু মিলনের।
তারও আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকে কতশত বিচ্ছেদ কথা।