প্রশ্নঃ- আপনি জীবনে নেশা করেননি কখনও?
উত্তরঃ-
নেশা?
যদিও নেশাকে সেই ভাবে সংজ্ঞায়িত করা মুশকিল। তবু নেশা বলতে পাঁচজনে যা বোঝেন, হ্যাঁ, করেছি! অবশ্যই করেছি। শিবরামের বলা রাবড়ির নেশা বা ওই জাতীয় কোনও লোক ভোলানো নেশা নয়। রীতিমতো রেজিস্টার্ড নেশায় পা দিয়েছি বই কি!
এবং তার সবকটাতেই অনার্স না হোক, পাশ কোর্সের অভিজ্ঞতা অবশ্যই হয়েছে।
দু’একটা নেশা অবশ্য সময় সুযোগের অভাবে কিম্বা প্রাণভয়ে করা হয়নি। সেই গুলি আগে বলে নিই। ডাক্তার ছাড়াও অন্যরা সেই নেশা করে। তবে ডাক্তারির সুবাদে সেই সব নেশাদ্রব্য পাওয়ার সুযোগ(নাকি দুর্যোগ) বেশি পাওয়া যায়। ছাত্রাবস্থায় দেখেছি ইমারজেন্সি থেকে ঝেড়ে ডায়াজিপাম ইঞ্জেকশন হোস্টেলে আধগ্লাস জলে পাঞ্চ করে খাচ্ছে কেউ। না, আকর্ষিত হইনি। পেথিডিন ইঞ্জেকশন তখন হাসপাতালের ওয়ার্ডে পাওয়া যেত। আর পাওয়া যেত অ্যানেস্থেটিস্ট বা ওটিতে অন্য যাঁরা যান তাঁদের সংগ্রহে। চেনা অনেককেই ওই সর্বনাশা ওষুধের কবলে পড়তে দেখেছি। শিশির দা বলে এক অসাধারণ দক্ষ অ্যানাস্থেটিস্ট নিজে নিজের পশ্চাদ্দেশে ফোটাতেন ইঞ্জেকশন ভরা সিরিঞ্জের সূঁচ।
এঁরাই আবার ঠিক সময়ে ইঞ্জেকশন জোগাড় করতে না পারলে হন্যে হয়ে যেতেন। তাও দেখেছি।
যাক সে কথা। নিজে যে নেশাগুলি করেছি, সেই সমস্ত পাপ একে একে স্বীকার করা যাক। প্রথমে বলি ধূমপানের কথা। সেটি দিয়েই শুরু করি নেশাসিক্ত এক পাপীর উপাখ্যান।
আমি গত প্রায় বিশ বছর অধূমপায়ী। কিন্তু কলেজের সেকেন্ড ইয়ার থেকে শুরু করে এই শতকের শুরুতেও এই আমি ধূমপান করেছি।
তার জন্য ভুগেওছি খুব। বড্ড কাশি হত। সারাক্ষণ গলা খুশখুশ। কেন যে বাবার পয়সায় এই উৎকট নেশাটি ধরেছিলাম, কীসের প্রেরণায় মনে করতে পারি না।
কিন্তু শুরু করেছিলাম। তখন আমার ব্র্যান্ড ছিল, হলুদ প্যাকেটের চারমিনার। হ্যাঁ, ফেলুদা যেটা টানত। তিরিশ পয়সা প্যাকেট। প্রদোষ মিত্র এই ব্যাপারে অন্তত তত বুদ্ধিমান ছিল না।
যদ্দুর খেয়াল পড়ে, দিনে দু তিন প্যাকেট অবধিও উঠেছিলাম। পয়সা না থাকলে বিড়ি খেতাম। সে এক বাজে অভিজ্ঞতা। ঠোঁট জিভ সব তেতো। তবু মানসিক রোগীর মত ধূমপান করতাম। করেই যেতাম।
একটা ছোট সাইজের বিড়ি পাওয়া যেত। যেটা নাকি অন্য ডিগ্রি কলেজে, “স্যার, বাইরে যাব”, বলে বেরিয়ে ফুক ফুক করে দু’টান দিয়ে ফের ক্লাসে এসে বসা যেত। তার আদরের ডাকনাম ছিল স্টুডেন্ট বিড়ি।
সিগারেট ভাগ করে খেতাম। ক্ষুধার্ত কুকুরের মত সহপাঠীর পরিত্যক্ত অবশেষ টুকরোটা দখল করতাম ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কিছু বন্ধু ছিল প্রফেশনাল সিগারেট শিকারি। অন্যের রুমে ঢুকে গম্ভীর ভাবে টেবিলের ওপর রাখা প্যাকেট থেকে অনুমতি না নিয়েই একখানা নিয়ে ধরাতো তারা।
তাদের জন্য প্রতিষেধক বার করেছিল আমাদের আশু। সেই রকম সন্দেহজনক কেউ ঘরে ঢুকলেই দৃশ্যমান প্যাকেটটা আক্ষেপ সহকারে খাটের নীচে ছুঁড়ে ফেলত।
– যাঃ শালা, প্যাকেট শেষ! কিছু মনে করিস না মাইরি!
সেই বন্ধু ঘর থেকে বেরোলে খাটের তলায় ঢুকে চলত হারানিধির অন্বেষণ।
এই অন্বেষণ অবশ্য অন্য সময়েও চলত। বিড়ি সিগারেটের স্টক নিঃশেষিত। টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে,
খাটের তলায় গুঁড়ি মেরে। যদি হেলায় ছুঁড়ে ফেলা পোড়া টুকরো পাওয়া যায় একটা! পরীক্ষার আগের দিন মাঝরাতে।
সেই সময়ে, কী বলব, বিড়ি সিগারেট টানলে জিভ জ্বালা করত কিন্তু তবু টানতাম। আমার সহপাঠী, একবছরের রুমমেট গৌর সিগারেট ছাড়বে বলে খৈনি ধরল, তারপর খৈনি ছাড়বে বলে নস্যি আর গুড়াকু। শেষ অবধি চার রকম তামাকই অভ্যেস হয়ে গেল তার।
তারপর পাশ করলাম। আর্থিক উন্নতির সঙ্গে ব্র্যান্ড উন্নত হল। গোল্ড ফ্লেক… ফিল্টার উইলস ইত্যাদি।
যতদিন না, হ্যাঁ, যতদিন না বড়পুত্র ভারি অভিমান করে বলল,”বাবা, বেশি কিছু তো চাইছি না। এইটুকুও দেবে না?”
সে তখন বাইরের দেশে যাচ্ছে। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরুবে। নিজের ওপরই খুব ঘেন্না হল। প্যাকেট শুদ্ধ সিগারেট এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে দুমড়ে ফেলে দিলাম। সেই শেষ। এখন গন্ধটুকুও অসহ্য লাগে। ফেসবুক করি বটে। কিন্তু সিগারেট মুখে ছবির ডিপি দেখলে অসহ্য মনে হয়। হ্যাঁ, ঘনিষ্ঠ বন্ধুরও।
কেউ একজন বলেছিলেন, “সিগারেট ছাড়া খুব সহজ। আমি বহুবার ছেড়েছি।”
ছাড়তে হলে ওই রকম ক্যাজুয়ালি ছাড়লে হবে না। ছাড়তে হবে রামকৃষ্ণ কথামৃতে বলা সেই চাষীর মত।
এক চাষী ক্ষেত থেকে ফিরেছে। গায়ে তেলটেল মাখছে। স্নানে যাবে। এসে ভাত খাবে। তার বৌ বলল, “জানো, জমিদারবাবু সন্ন্যাসী হয়ে যাচ্ছেন। জমি জমা সম্পত্তি সব বৌ-ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। নায়েব মশাই হরিদ্বারের টিকিট কাটতে গিয়েছে। টিকিট এলেই, ট্রেনে চেপে হরিদ্বার গিয়ে, সন্ন্যাসী হবেন”।
চাষী শুনে বলল, “ও’ভাবে হয় না, বুঝলি!”
চাষী-বৌ বলল, “হাঃ, উনি অত বড় জমিদার, উনি জানে না! সব জানো তুমি! কী ভাবে সন্ন্যাসী হতে
হয় তবে?”
“কী ভাবে হয় দেখবি?” এই বলে কাঁধের ওপর গামছাটি ফেলে চাষী বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। আর ফিরল না।
আজ্ঞে হ্যাঁ, ধূমপান ছাড়তে হলে, সিগারেটের পরিমান কমিয়ে, আরও নানা রকম হঠযোগ ইত্যাদি প্রয়োগ করে লাভ হবে না। চাষীটির মতন এই রকম ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। তবেই পারা যাবে।
এই গল্পটা আমি হাসপাতালে চেম্বারে অনেককে বলেছি। লাভও হয়েছে। আউটডোরে রোগীদের পকেট সার্চ করতাম। বাজেয়াপ্ত করতাম বিড়ির প্যাকেট। সেয়ানা রোগীরা, গেটে ঢোকার মুখে ডানদিকের দোকানে রেখে আসত পকেটের বিড়ি। দেশলাইয়ের প্যাকেট অনেক সময়ই পকেটে থেকে যেত। চোখ পাকিয়ে ঝামেলা করলে উত্তর আসত, “আজ্ঞে স্যার, যদি হঠাৎ কারেন্ট চলে যায়, আপনার এই ঘরটা যা অন্ধকার।”
আরেকটা কথা। ভায়া বিড়িই বলো কী সিগ্রেট চুরুট পাইপ… টানলেই বিপ্লবীর জীবন শেষ, বিপ্লবও শেষ। কমিউনিস্টরা বহু ভালো কাজ করেছে করছে (হয়তো বা)… দাঙ্গা রুখেছে, নারী স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়েছে ইত্যাদি। কিন্তু ওই ধূমপানটি করে গেছে প্রকাশ্যে( প্রমোদ বুদ্ধ কাস্ত্রো সবাই) যা একান্ত ভাবেই বিজ্ঞান তথা বিপ্লববিরোধী।
সিগারেট-বিড়ির সুখটান (না কি অ-সুখ টান) আমার পাঠক-পাঠিকারা (আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার কন্যারত্নটিও) অনেকেই দেন!
দেবেন নাই বা কেন! অতিশিক্ষিত ডাক্তার আর স্বাস্থ্যকর্মীগুলোই যেখানে বুক ফুলিয়ে সিগ্রেট ফোঁকে প্রকাশ্যে।
সবাইকে জানাই ধূমপানে পাওয়া সুবিধেগুলি,
১) সেরিব্রাল স্ট্রোক
২) চোখে টক্সিক অ্যামব্লায়োপিয়া যা অন্ধত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারে
৩) ঠোঁট-মুখ-গলা-ফুসফুসের ক্যান্সার
৪) ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ লাং ডিজিজের দরুণ সদাসর্বদা কাশি আর নিঃশ্বাসের কষ্ট
৫) কিডনি, ইউরেটার আর মূত্রথলির ক্যান্সার(ট্রানজিশনাল সেল কারসিনোমা- অধূমপায়ীদের হয় না)
৬) তথাকথিত পেটের গ্যাস, পাকস্থলির ক্যান্সার, পেপটিক আলসার
৭) প্যানক্রিয়াসের ক্যান্সার
৮) রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে পরিণতিতে হৃদযন্ত্রের নানান ব্যামো আর হার্টঅ্যাটাক
৯) ডায়াবেটিসের উপসর্গ বৃদ্ধি
১০) পায়ের ক্রনিক আর্টারিয়াল ইন্সাফিসিয়েন্সি যার ফলে পায়ের আঙুল থেকে গ্যাংগ্রিন শুরু হয়ে আস্তে আস্তে পুরো পা না হোক অন্তত হাঁটু অবধি অ্যামপুটেশন(অধূমপায়ীদের হয় না)
১১) পুরুষ ও নারীদের যৌনক্ষমতা হ্রাস ও বন্ধ্যাত্ব
১২) সরাসরি ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক ক্ষতি, সামান্য হিসেবেই বোঝা যাবে এর পরিমান কত বিপুল
১৩) এ’ছাড়াও আরও কোনও ক্ষতি, যা হয়তো আক্ষরিক অর্থেই মাথার থেকে পা অবধি বিস্তৃত এই ক্ষতির তালিকা থেকে বাদ গেল।
অলমিতি…
বড় হয়ে যাচ্ছে।
অন্য নেশাগুলির ইতিহাস পরে বলব।