সেদিন ছিলো পয়লা জুলাই,২০১৮ সাল। ডেবরা সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালে ঘাম ঝরানো দুপুর। পেটে ব্যথা নিয়ে বছর তিরিশের এক রোগা মহিলাকে নিয়ে চার পাঁচ জন যুবকের প্রবেশ। ভোর রাত থেকে হঠাৎ পেটে ব্যথা। গ্রামীণ ডাক্তারবাবুরা “গ্যাসের ব্যথা” ভেবে বিভিন্ন অবাঞ্ছিত চিকিৎসা করেছেন বটে। গ্রামীণ ওঝাও (জানগুরু) ঝাড় ফুঁক করেছেন। কিন্তু কোনওভাবেই বাগে আসেনি বলে অগত্যা অনিচ্ছা সত্বেও হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। তাঁদের হাবেভাবে অবিশ্বাসের বাঁকা চাউনি।
জিজ্ঞেস করলাম- নাম কি তোমার?
উত্তরে ভ্রূ কুঁচকে, অতি কষ্টে, সমস্ত শ্বাস একত্র করে মেয়েটি বলল- “ ফুঁলমনি হেঁমরঁম”।
অহেতুক নাসিক্য বর্ণের উপস্থিতি ও কষ্টার্জিত বাকবায়ুর প্রয়োগে চমকে উঠলাম। ভালো করে দুইচোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। চোখের পাতা কিছুটা যেন কষ্ট করে খুলে রেখেছে মেয়েটি। নিদ্রা ভরা দৃষ্টি। সঙ্গে সঙ্গে শুইয়ে দিয়ে পেটে চাপ দিতেই কঁকিয়ে উঠলো মেয়েটি। পেটের ব্যথা সারা পেট জুড়েই ছড়ানো। চোখ গোল গোল করে জিজ্ঞেস করলাম – “কাল রাতে কোথায় শুয়েছিলে”?
মেয়েটি আবার জোর করে শ্বাসবায়ু সংগ্রহ করে খানিক দম নিয়ে বললো “মেঁঝেঁতেঁ”।
যেন অভীষ্টের কাছে পৌঁছে গেছি, এরকম এক উত্তেজনা নিয়ে গলার জোর বাড়িয়ে বললাম – “মশারী টাঙিয়ে ঘুমিয়েছিলে?”
মেয়েটি ঋণাত্মক ভঙ্গিমায় মাথা নাড়ালো।
মনের মধ্যে চিৎকার করে উঠলাম- “ইউরেকা”। সিস্টার গায়ত্রী ম্যাডামকে বললাম “কালচিতিতে কামড়েছে। তাড়াতাড়ি এ.ভি.এস রেডি করুন”।
আমার ঘর্মাক্ত উত্তেজনায় শোরগোল তৈরি হলো। দৌড়ে অ্যাড্রিনালিনের অ্যাম্পুল খুলে এ.ভি.এস রিয়্যাকশনের প্রিমেডিকেসানের জন্য ইঞ্জেকশন রেডি করে যেই না দিতে গেলাম অমনি বেঁকে বসলো রোগীনির পরিজনেরা। “কি বলছিস ডাক্তার? কালচিতি? গ্যাসের রোগীকে সাপকাটির ওষুধ দিয়ে মারবি লাকি? তার থেকে বরং আমরা নার্সিংহোমে লিয়ে যাব। তুই ছেড়ে দে।”
ততক্ষণে “ভুল-চিকিৎসার” গন্ধ পেয়ে ছোটোখাটো একটা জটলা তৈরি হয়েছে। এমনিতেই ঐ সময়ের সংবাদ প্রক্ষেপণের বড় অংশ জুড়েই থাকতো “ভুল-চিকিৎসার” সাড়ম্বর আলোচনা। হাতে-গরম ভুলচিকিৎসার প্রমাণ পেয়ে আমায় লক্ষ্য করে শুরু হলো কটুকথার ফুলঝুরি। কেউ কেউ মুঠোফোনে প্রমাণ রেকর্ড করে সোশাল মিডিয়ায় লাইভ শুরু করেছেন।
মাতৃসমা সিস্টার ম্যাডাম কানে কানে বললেন- “ছেড়ে দিন স্যার। হাওয়া গরম হচ্ছে। তার থেকে ওরা নিজেরাই যখন নিয়ে যেতে চাইছে…।”
আমি সিস্টার দিদিমনিকে বললাম- “আপনি এ্যান্টিভেনাম দিতে শুরু করুন। এমনিতেই অনেক দেরী করে এনেছে ওরা। তার ওপর কোনও নার্সিংহোমে এই চিকিৎসার ওষুধ নেই। বেঘোরে মরবে মেয়েটা। আমি ওদের সাথে কথা বলে ভুলিয়ে রাখছি। ততক্ষণে এ.ভি.এস টা চালিয়ে দিতে পারলেই কেল্লাফতে। প্রাণে বেঁচে যাবে মেয়েটা।”
আমার জেদের কাছে হার মেনে সিস্টার দিদিমনি অ্যান্টিভেনাম ইঞ্জেকশন দিতে শুরু করলেন। আমিও হাতে থাকা অ্যাড্রিনালিন পুশ করলাম। দুর্ভাগ্যবশতঃ ঘোড়ার সিরাম থেকে তৈরি এ.ভি.এস, আমার দেওয়া অ্যাড্রিনালিনকে কুপোকাত করে শরীরে রিঅ্যাকশান শুরু করলো। সারা গা, হাত, পা চুলকাতে শুরু হলো মেয়েটির।মাথায় ছোটো ছোটো র্যাশ বেরোলো।
জনতা “ভুল-চিকিৎসার” হাতে গরম প্রমাণ পেয়ে মারমুখী হয়ে উঠলো। কেউ পুলিশে খবর দিলো। কেউ “দাদা”-দের ফোন লাগালেন। কেউবা “সুমধুর” ভাষার প্রয়োগে বিষ উগরে দিলেন চিকিৎসক সমাজের প্রতি।
সামাজিক চাপে নত হলাম। বললাম- “ঠিক আছে, নিয়ে যান রোগীকে। কিন্তু নিজ হাতে কাগজে লিখে আমার নামে অভিযোগ জানিয়ে জমা দিলে তবেই রোগীকে ছাড়বো।”
আমার এহেন অদ্ভুত আবদার শুনে সিস্টার দিদিমনি খানিক অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতে কানে কানে বললাম- “ওরা লিখতে জানে বলে মনে হয় না। যতক্ষণে লেখা শেষ করবে ততক্ষণে এ.ভি.এস চালিয়ে দিতে পারবো আশাকরি। তারপর যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যাক ওরা। প্রাণে তো আর মরবে না।”
আসলে কালচিতির কামড় সাধারণতঃ রাত্রিকালীন ও অতিমৃদু। অনেকসময় কামড়ের দাগ পর্যন্ত থাকে না। নিঃশব্দ কামড়। ব্যথাহীন, ফোলাহীন বলে রোগী বেশিরভাগ সময়ই বুঝতেই পারে না। মশারী বিহীন মেঝেতে শোওয়া, সকালে পেটে ব্যথা, ক্রমবর্ধমান চোখের পাতা পড়ে আসা (শিবনেত্র বা টোসিস), কথা বলতে বা জিভ বের করতে কষ্ট, কোনও কোনও সময় নাকি সুরের কথন। সবই আসলে নার্ভবিষের লক্ষণ।
আর এক নার্ভবিষওলা সাপ হলো ফনাযুক্ত গোখরো অথবা খরিশ। বাকি রোগলক্ষণগুলো সমান হলেও যেহেতু এক্ষেত্রে যন্ত্রণা ও কামড়ের স্থান ফুলে ওঠে বলে রোগী নিজেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। চিকিৎসকের প্রতি সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
আমাদের পশ্চিম বাংলায় আর এক ধরনের বিষাক্ত সাপ প্রবল ভাবে বিদ্যমান। রক্ততঞ্চনপ্রক্রিয়া ধ্বংসকারী বিষযুক্ত চন্দ্রবোড়া। এ সাপের কামড়ে, কামড়ের স্থানে অসহ্য ব্যথা ও ক্রমবর্ধমান ফোলা রোগীকে হাসপাতালে আসতে বাধ্য করে। এছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে অহেতুক রক্তক্ষরণ এই বিষের প্রধান লক্ষণ। এক্ষেত্রেও পেটে ব্যথা, সংশ্লিষ্ট লসিকাগ্রন্থির প্রদাহ হতে পারে।পরিশেষে বিলম্বিত চিকিৎসার কারণে কিডনি যন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যু হয় রোগীর।
প্রতি বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর সাপকামড়ের রোগীতে ভরে থাকে গ্রাম বাংলার হাসপাতালগুলো। সাপকে ঠেকিয়ে রাখার কোনও উপায় সেভাবে নেই।
- সাপের খাবার ইঁদুরের উপদ্রব থেকে বাঁচতে ইতিউতি খাবারের টুকরো ছড়িয়ে রাখবেন না।
- রাত্রে পথ চলার সময় টর্চ ব্যবহার করুন।
- মশারী টাঙিয়ে খাটের উপর শোওয়া কালচিতির কামড় থেকে বাঁচাতে পারে।
- অহেতুক সাপকে না মেরে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করুন।
- নিজেকে সাপের কামড় থেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করুন।
- অহেতুক বাঁধন নয়।
- কামড়ের জায়গা যতটা সম্ভব স্থিতিশীল রেখে প্রতিটি কামড়ের ক্ষেতেই যত দ্রুত সম্ভব নিকটবর্তী বেড থাকা সরকারি হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে যেতে হবে যাতে কামড়ের ১০০ মিনিটের মধ্যে ডাক্তারবাবু অন্ততঃ ১০০ মিলি এ.ভি.এস রোগীর শরীরে প্রয়োগ করতে পারেন।
- এতে রোগীর প্রাণহানির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
- মনে রাখবেন বিষাক্ত সাপের কামড়ের একম অদ্বিতীয়ম চিকিৎসা হলো ঘোড়ার সিরাম দিয়ে গোখরো,চন্দ্রবোড়া, স’স্কেল্ড ভাইপার,ও কালচিতির বিষের প্রয়োগে তৈরি এ.ভি.এস বা অ্য্যন্টিভেনাম সিরাম।
- বিকল্প চিকিৎসার খোঁজে অহেতুক দেরী বা দূরবর্তী নামজাদা হাসপাতালে নিয়ে যেতে গিয়ে ওই মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে গেলে রোগীর প্রাণহানির সমূহ সম্ভাবনা।
- মনে রাখবেন কোনোরূপ রক্তপরীক্ষা করে বিষের উপস্থিতি বা মূল্যায়ন আমাদের দেশে অমিল। তাই অহেতুক রক্তপরীক্ষা নয়। চিকিৎসকের রোগ-নির্নায়ক অন্তর্ভেদী নজরই একমাত্র উপায়।
তবে সে নজরের সফল প্রয়োগেও জনরোষের কাছে প্রায় হার মানতে বসেছিলাম সেদিন। যদিও শেষরক্ষা করেছিল মেয়েটির এক দিদি। হঠাৎই ভিড় ঠেলে আমাকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন তিনি। বললেন- “ডাক্তার, তোর খুব নাম শুনেছি। যারা ঝামেলা পাকাচ্ছে তারা আসলে শ্বশুরবাড়ির লোক। বোনটা মরে গেলে ওদের কি এসে যায়? আবার একটা বিয়া করে লিবে। তুই যা ভালো বুঝিস কর।”
কিছুটা জোর পেয়ে চিকিৎসা কম্পলিট করার পর দেখি ওদের নড়বড়ে হাতের লেখায় আমার অদ্ভুত দাবী পূরন করেছে তারা। আমিও যুদ্ধজয়ের হাসি হেসে ওদের দাবী পূরনে উদ্যত হলাম।
এই করে রাত আটটা বাজলো। এর মধ্যে অন্যান্য রোগীর ভিড়ে মস্তিষ্কের প্রয়োগে ব্যস্ত হলাম। আমার পরের ডাক্তারবাবু এসে হ্যান্ডওভার নিলেন।
পরের দিন সকালে আউটডোরে ঢুকতে গিয়ে ঘিরে ধরলো বেশ কয়েকজন। ভিড়ের ভিতর উঁকি দিচ্ছে গতকালের সেই পরিজনেরাও। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক প্রৌঢ় ঢিপ করে আমার পায়ে মাথা ঠুকে বলল – “কাল বড় ভুল হয়ে গেছে ডাক্তার। তুই ঠিকই বলেছিলি। ওর শোবার ঘরে একটা কালচিতি খুঁজে পেয়েছি। তোর চিকিৎসায় মেয়েটা ভালো আছে। এই হাসপাতালেই আছে। তুই গিয়ে একবার দেখে আয়।”
দৌড়ে ফিমেল ওয়ার্ডে এলাম। মেয়েটি উঠে বসে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। আমাকে দেখে হাসিমুখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। টুক করে মুঠোফোনে ছবি তুলে নিলাম।
আনন্দাশ্রু সামলে ফেসবুকের পেজে ওর ছবিটা বড়াই করে পোষ্টাবো ভেবে যেই না ক্লিক করেছি অমনি ভেসে উঠলো গতকালের “ভুল-চিকিৎসার” সেই ফেসবুক লাইভ। কমেন্টে সেকশানে লেখা “ ডাক্তার না ডাকাত?।
চোয়াল শক্ত করে আউটডোরের ভিড়ে মিশে গেলাম।
খুব ভালো লাগলো। আরো লিখুন এরকম লেখা
??Ekmatro doctor rai paren.
আরো বেশি ভালো কিছু লিখুন, খুব সুন্দর লেখা পেলাম। খুব ভালো লাগলো।
এই খবরগুলি কখনোই সংবাদ-এর শিরোনামে আসে না। হাজারে একটা রুগী মারা গেলে , এই সংবাদ মাধ্যমই শকুনের পালের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে।
Khub darkari ….barbar e khabor gulo samne asuk rr sacheton Hoi Amra.