আমার শহরের হাজারটা মুখ। মুখ আর মুখোশের আড়াল নিয়ে হেটে চলেছে পথের পর পথ। এক শহরের মধ্যে হাজারটা শহরের প্রাণ। যেন রাবণের অসংখ্য মাথা– নিংড়ে শুষে বেঁচে চলেছে কাড়াকাড়ি করে। একই আকাশ ধার করে। একে অন্যের প্রাণশক্তি দিয়ে। একে-অন্যের ঘ্রাণে জড়াজড়ি করে। কাজের সূত্রে এমন কলকাতাকে আমি রোজ ছুঁয়ে নেড়েচেড়ে দেখি।
গভীর বিষাদ জড়ানো কচি মুখ- ওর বেমানান মুখ দেখেই দাড়ালাম, থমকালাম ওর হাতের পুতুল টা দেখে। এ পুতুল এদিক পানে দেখিনি কখনো। বেশ কয়েকটা সুতির কাপড়ের স্তর দিয়ে তৈরি পুতুল। অনেকটা পুতুলনাচে যে ধরনের পুতুল আমরা দেখে থাকি, তার চেয়ে অবশ্য আকারে ছোট। মাথায় আবার মুসলিম মহিলাদের মত ওড়না জড়ানো।
জবা। নামটা পাল্টে দিলাম। ৮-৯ বছর বয়সী শিশুরা যেমন উচ্ছল হয়। তার ছিটেফোঁটাও নেই ওই উদাশী চোখে। কথা বলতে চাইলেও কোন উত্তর এলো না। বুঝলাম আলাপ সহজ হবে না। কথা বলতে থাকলাম ওর বন্ধুদের সঙ্গে। তারপর ওর পুতুল নিয়ে জানতে চাইলাম। খটকা লাগল ওর ভাষায়। উত্তর কিছুই পাওয়া গেল না। এদেশের মাটিতে নতুন। মা নেই বাবার হাত ধরে ফেলে এসেছে পরিচিত মাটিকে। নতুন আত্মীয়দের আশ্রয়ে – আশ্রয় করেছে চেনা পুতুলের হাত দুটিকেই।
ছবিটা এই শহরের প্রান্তিক এক কোনার। কলকাতার শরীরের এক অপরিচিত বস্তি। পশ্চিমবঙ্গের বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ—না সবুজ শ্যামল অতিথিবৎসল বাংলাদেশ নয়। অসহায় পলাতক ছিন্নমূলের বাংলাদেশ। আমরা ভাবি ছিন্নমূলের গল্প বুঝি ফেলে এসেছি অতীতে। বই এর পাতার নিশ্চিন্তে–আরামের শীতঘুম জড়িয়ে আছে তারা। অথচ রোজ মানুষ নিঃস্ব হয়, রোজ ছেঁড়াখোঁড়া নিয়ে বাঁচতে চায়। রোজ শরীর রক্তাক্ত হয় কতশত ছিন্নমূলে। শহরে পা পড়ে কতশত অসহায়ের- আমরা খোঁজ রাখি না জবা দের, জবার বাবাদের। যাদের স্বাস্থ্যের গুরুত্ব নেই- যাদের শিক্ষার গুরুত্ব নেই- নেই ন্যূনতম মৌলিক অধিকারের গুরুত্ব। ছিন্নমূল থেকে প্রান্তিক- প্রান্তিক থেকে পরিযায়ী- পরিযায়ী হয়ে তারা উড়ে যায় কোন শহরে। যারা ছড়িয়ে টুকরো টুকরো হয়ে- বিন্দু হয়ে যায়। আর বিন্দু থেকে নিশ্চিহ্ন- নেই হয়ে যায় একদিন। আমরা এসব গল্পে চোখ বন্ধ করে নি। আমরা নাগরিক জীবনের নিশ্চিন্তির আড়মোড়া ভাঙ্গি। আয়েশ করে পিড়ি পেতে বসি– সকালের রোদে উল্টেপাল্টে সেঁকে নি দুঃখকে।
ছবিটা জবার ও জবার বর্তমান পরিবারের।