আমরা গত মাসের শেষ সপ্তাহে দেখছিলাম যে মোট আক্রান্তের সংখ্যা কমছিল। গত এক সপ্তাহ কিন্তু তার উল্টো পরিণতি দেখতে পাচ্ছি। প্রতিদিন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, যদিও মোট টেষ্টের সংখ্যা সেই দশ হাজারের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। বলা বাহুল্য, এই সংখ্যাবৃদ্ধি একটি অশনি সংকেত বললে অত্যুক্তি হয় না। এই অবস্থায় এই রাজ্যের সিনিয়র চিকিৎসকরা রাজ্য জুড়ে কোভিড চিকিৎসার উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরী রাখার সরব চিন্তা করে চলেছেন।
আমরা জানি যে, মহামারির তীব্রতর অবস্থায় সারা দেশে প্রায় 10-15% মানুষ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনার কথা অনেকে অতীতে বলেছেন। যদিও অনেক পরস্পরবিরোধী খবর পরিবেশন হতে থাকে ও অনেকে বলেন যে, এই দেশে করোনার সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক কমেছে। একটি সূত্র অনুসারে কার্যকর যে গুণিতকে রোগী বাড়তে পারে সেই সংখ্যাটি 1.4% থেকে কমে 1.22% হয়েছে। যদিও এই সংক্রান্ত পূর্ণ গবেষণাপত্রটি ও তার সাম্পল সাইজ, এরর মার্জিন আমার জানা নেই।
এই অবস্থায়, সরকারী পরিসংখ্যান অনুসরণ করাই যুক্তিযুক্ত। সরকার মনে করে যে জুলাই ও আগস্ট মাসে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ করা যায় এমন বেডের সংখ্যা সারা দেশে বিপুল ভাবে বাড়তে পারে। পশ্চিমবঙ্গে সব মিলিয়ে ICU বেডের সংখ্যা 5667 (তথ্য সূত্র প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়)। মোট ভেন্টিলেটর সংখ্যা 2838 টি। এই অবস্থায় সরকারের যা কর্তব্য
1)মৃদু উপসর্গের রোগীদের একত্রে বড় সেটডিয়াম বা সরকার পোষিত কোন অট্টালিকায় রাখা দরকার। এদের এই রকম বড় কোন স্থানে রাখার যৌক্তিকতা হল অল্প চিকিৎসাকর্মী দিয়ে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণের সুবিধা। কোন রোগীর অবস্থার অবনতি হলে তাদের অক্সিজেন সুবিধাযুক্ত শয্যায় স্থানান্তর করা দরকার।
2) মাঝারি ধরনের অসুস্থদের জন্য মেডিকেল কলেজের সাথে সংযুক্ত হাসপাতালগুলিকে ব্যবহার করা। যথা- (কলকাতা শহরে) রামরিখ হাসপাতাল, শম্ভুনাথ পণ্ডিত, মেয়ো হাসপাতাল, লেডি ডাফরিন, সল্টলেক স্টেট জেনারেল, বাঘা যতীন হাসপাতাল ইত্যাদি।
3) প্রচুর অক্সিজেন প্রয়োজন বা ভবিষ্যতে ভেন্টিলেশন লাগতে পারে এমন রোগীদের জন্য মেডিকেল কলেজ ব্যবহার করা। ভেন্টিলেশন বেডের সমূহ সঙ্কটের সম্ভাবনা আছে বলে উচ্চ সুবিধাযুক্ত হাসপাতালগুলিতে তুলনামূলক কম উপসর্গের রোগীদের ভর্তি করা যুক্তিযুক্ত হবে না। সর্বস্তরে প্রতিটি কেন্দ্রে প্রতি সিফটে যথেষ্ট সংখ্যক সিনিয়র চিকিৎসক নজরদারি যাতে করেন তা নিশ্চিত করা দরকার।
- এই অবস্থায় মেডিকেল কলেজগুলির পঠনপাঠন ও প্রশিক্ষণের ত্রুটি হতে পারে। ছাত্রদের প্রতিনিধি, চিকিৎসক সংগঠন, স্বাস্থ্য আন্দোলন ও স্বাস্থ্য অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন সংগঠন, মানবাধিকার ও রোগী স্বার্থ নিয়ে কাজ করেন এমন সবার একযোগে বসে এই অবস্থায় করণীয় কি হতে পারে তা নিয়ে অবিলম্বে আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছানো উচিত।
- নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা সঙ্কুচিত হয়ে মৃত্যুহার বেড়ে যেতে পারে। তাদের চিকিৎসার জন্য পরিকাঠামোর অভাব হবে। মেডিকেল কলেজে সাম্প্রতিক সমস্যার জন্য ক্যানসার, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগীদের সমস্যা শুরু হয়েছে।
- ট্রমা ও অন্যান্য আপৎকালীন সমস্যায় জর্জরিত রোগীদের সমস্যা নির্ণয় ব্যাহত হচ্ছে কারণ প্রশাসনের দৃষ্টি এখন কেবল কোভিড নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত। এর ফলে নন-কোভিড রোগীরা কল্কে পাচ্ছেন না।
এই অবস্থায় সর্বস্তরে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করে স্থানীয় প্রশাসকরা যাতে তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তার জন্য একটি কর্মপদ্ধতিগত SOP প্রয়োজন।
আমরা একটি অত্যন্ত জটিল ও ভয়ঙ্কর সময় অতিবাহিত করছি। এই সময় সবাইকে ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা-জেদ ইত্যাদি ত্যাগ করে সর্বশক্তি দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।
প্রশাসনিক সুবিধা বা অগ্রাধিকারের চেয়ে জীবনের অধিকার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক একইভাবে এখন অতিরিক্ত ত্রুটি খোঁজার চেষ্টার পরিবর্তে সবাই ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করার মত সহনশীলতা অর্জন করতে হবে। এই সঙ্কট থেকে উদ্ধার পাবার কোন সহজতর পথ খোলা নেই।
সঙ্কটকালে কদাপি নয় কিন্তু ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারী বাজেট বাড়ানোর জন্য সর্বস্তরে আলাপ আলোচনা আরো বাড়াতে হবে। সেটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগ্রাম। স্বাস্থ্য আন্দোলন আদতে একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যদিও তা বিশেষ কোন দলীয় রাজনীতি নয়, তাহল মানুষের ন্যূনতম মানবাধিকার রক্ষার সংগ্রাম।