কেরালা গিয়েছিলাম বেশ কবছর আগে| এমন ঘন সবুজে ছাওয়া দেশ– আগে দেখিনি| এতো গাছ আর সে গাছে এমন বড় বড় পাতা– মনে হয় সবুজের একটা নদী| আর কলাপাতাগুলো সবুজ নদীতে সবুজ নৌকো| কিংবা হয়ত সবুজ এক তলোয়ার| পাপ কাটার তলোয়ার| যৌবনকে বাঁচাবার শ্যামল শস্ত্র|
মানুষগুলোও তেমনি সবুজরঙা| সবসময় ছটফটিয়ে কাজকম্ম করছে| প্রত্যেকটা কাজ শেষ করছে| হাসছে| খোলা গলায় কথা কইছে| রেগে চিল্লাচ্ছে| সরাসরি এবং মুখোমুখি| আবার পরদেশি দেখে একমুখ হেসে আলাপ করতেও এগিয়ে আসছে| একদম নিজে থেকে, যেন কতকালের বন্ধু আমরা|
সবচেয়ে আমাকে অবাক করেছিল, এঁদের খাদ্যসম্পদ বাঁচাবার এবং সেটা খাদ্যহীনকে বিলিয়ে দেবার আকুতি| কুইলনে গেস্টহাউসের এক বৃদ্ধ মালীকে দেখতাম, সারাদিন ধরে সতর্ক পাহারা দিচ্ছেন বাগানের ফলফুলুরি| পাহারায় এতো মতি– মনে হতো ফলগুলো সন্ধ্যাকালে পুটুলি করে পৌঁছে দেবেন প্রভুর আস্তানায়| সন্ধ্যেতে দেখতাম, দূরের গাঁ থেকে যত বাচ্চা এসে জুটেছে মালীর কোলে| আর তিনি বেছে বেছে সবথেকে স্বাদু ফলগুলো তুলে দিচ্ছেন বাচ্চার ধুলোমাখা হাতে| খোঁজ নিয়ে জানলাম, এ নিয়ম নাকি গেস্টহাউস কর্তৃপক্ষের| বাড়তি কিছুই জমাবেন না — এই সংকল্প|
কুইলন থেকে নদীপথে অলিপ্পি| পথে খাবার জায়গা পড়ল| প্রচন্ড খিদে| খাচ্ছি| চড়া দাম– একপদ দিয়েই একরাশ ভাত মেখেছি| খেতে গিয়ে গলায় ভাত আটকাল| দক্ষিণী হোটেল মালিক এসে নারকেল রস দিয়ে রাঁধা সামুদ্রিক মাছের দখিনা ঝোল পাতে ঢেলে দিয়ে গেলেন| ভাবতে পারেন? —আমাকে বকছেন ভদ্রলোক, কেন খেতে কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে মুখ ফুটে কিছু জানাইনি! এই অতিথ্যের জন্য বাড়তি দাম দিতে হয় নি আমাকে! খাওয়া শেষে সেই হোটেল মালিকের এমত আচরণের হেতু জানতে চেয়েছিলাম? —সব কিছুতে হেতু খোঁজা নচ্ছারের মতো| বলেছিলেন– “তোমাদের দেশে শুধু পার্টিকর্মী আর পার্টির দেগে দেয়া কিছু সর্বহারা কমিউনিস্ট| এখানে আমরা সবাই কমিউনিস্ট| আমরা ব্যবসা করি, লাভ করি, কিছু সময় হয়ত চুরি বাটপারিও করি| কিন্তু সবসময় মাথায় রাখি বাকি সকলকেও খাওয়াতে হবে আমায়| এই যে তোমায় এক টুকরো মাছ দিলাম তাতে ঠিক কতটুকু লাভ আটকালো আমার! আবার দেখো– কাল যে কাউকে দশ টুকরো জোগাতে পারব এমনও নয়| তবু আমি কিন্তু অহরহ খাদ্যভাগের কথা ভেবেই চলব– ভেবেই চলব| খিদেপেটের মানুষকে খাবার দেবার দায় স্বীকারটা করে যাও| দেখবে সাম্য একটা ধাত হয়ে যাবে তোমার | একটা নিত্যিদিনের অভ্যেস | কিংবা মানুষ হয়েছি– এই গোছের একটা জোরালো আবেগ|”– বলতে বলতেই অসমাপ্ত কথা রেখে ছুটেছিলেন আরেক টেবিলে|
স্রেফ ওঁর কথাগুলোই আপনাদের বললাম| মনে হলো, বার বার সময় এসে ফিরে যাচ্ছে| এবার তো বলতে হয়! বলতে হয়– হে বুদ্ধিমান ভারত তোমাদের অতিবুদ্ধির ধারালো কাটারি দিয়ে শ্রমিককে কৃষককে আর সেক্টর, উপ, মহাউপ সেক্টরে বিভক্ত আলাদা জাতি বানিয়ে তুলো না| মিশেল —মিশেল বোঝো? তাই একটু দাও না কেন– পৃথিবী জুড়ে যাক মহাকাশে|
মানুষের জন্য মানুষ ভাবে না বলেই তো——- !
প্রতিনিয়ত কাজ এবং ভাবনার মধ্যে দিয়েই সাম্য আসবে। অসাধারণ এক মানবিক লেখা
যেমন সবুজ আর backwater নিয়ে এই কেরল। কেরলবাসীর মন খুব মিশুকে। ময়ূরী মিত্র এত সুন্দর করে তাদের সাম্য ভাবনা লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন তা অপূর্ব। তাদের কাজের মধ্যেই যে সাম্যের ভাবনা তা থেকেই একদিন সারা দেশে এই ভাবনা চিন্তায় ভর করে সবাই মিলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাবে। এই আশা করি।
অসাধারণ শব্দছবি। সাম্যচিন্তার জ্যান্ত ফুটনোট-উপাসনা!