১৭ই অক্টোবর, ১৯৪৯ সালে Constituent Assembly তে Article 370 (তখন 306A) গৃহীত হ’লো, তার আগে আলোচনার পরে ভোটাভুটিতে বিপক্ষে ভোট পড়েছিল একটি। না সেটা বল্লভভাই প্যাটেল বা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এর নয়। বিপক্ষে ভোটদাতার নাম হসরত মোহানি। হসরত মোহানির যুক্তি ছিল গোটা ভারতবর্ষেই বিভিন্ন অঞ্চল ভিত্তিক ফেডারেল শাসনব্যবস্থা থাকা উচিত। উনি দেশভাগের বিরোধী ছিলেন, ওনার মতে গোটা দেশকে ছয়টি অঞ্চলে বিভক্ত করে ফেডারেল শাসনব্যবস্থা চালু করা সবচেয়ে ভালো সমাধান। সেই হিসাবে কাশ্মীরকে যে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হ’লো তা সমগ্ৰ দেশেরই প্রাপ্য!
হসরত মোহানি নামটা আমাদের কাছে পরিচিত ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান এর উদ্ভাবক হিসাবে। কিন্তু তাঁর অসাধারণ কীর্তিকলাপ থেকে গেছে বিলুপ্তির অন্ধকারে। কবি, স্বাধীনতাসংগ্রামী, বিপ্লবী, জনপ্রতিনিধি আবার আন্তরিকভাবে ধার্মিক, জীবনের সমস্ত অধ্যায় সামলেছেন অনায়াসে। মহামান্য তিলকের অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন, আবার পরবর্তী কালে ভারতে কমিউনিষ্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। বলশেভিক বিপ্লবের পর উজ্জীবিত হয়ে লেখেন একের পর এক ‘ব্যালাড’, বলেন ‘গান্ধীর মতো বসে চরকা কেটে কোনও লাভ নেই, দুনিয়াকে নাড়িয়ে দিতে হবে লেনিনের মতো!
১৯২৫ সালে কানপুরে প্রথম পার্টি সম্মেলনের সমস্ত প্রস্তুতি হয়েছিলো কানপুরে তাঁর বাড়ি থেকে, অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন তিনিই। আবার, ১৯২১ সালে আহমেদাবাদ কংগ্রেস অধিবেশনে প্রথম স্বাধীনতার দাবি তোলেন (পূর্ণ স্বরাজ), তাঁকে সমর্থন করেন স্বামী কুমারানন্দ পরবর্তী কালে যিনি কমিউনিষ্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হন ও বিহার থেকে আগত প্রতিনিধি মঘফুর আহমেদ আজাজি। সমর্থনে এগিয়ে আসেন রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকউল্লা খান প্রমুখেরা।
হসরত মোহানি ছিল তাঁর ছদ্মনাম, আসল নাম ছিল সৈয়দ ফজল উল হাসান। কমিউনিষ্ট হলেও ধর্মীয় আচরণে অত্যন্ত নিষ্ঠ, রোজা-নামাজ সবই মানতেন। নিজের সম্পর্কে বলতেন, ‘I am a Sufi, momin (faithful) and Communist Muslim…..’, যদিও ত্রিশ দশকের প্রথমেই ছিন্ন হয় কমিউনিষ্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক, ‘৩১ সালে তৈরি করেন ‘আজাদ পার্টি’।
আবার বারবার যেতেন মথুরায়, কৃষ্ণভক্তির উপর লিখেছেন শায়েরী উর্দু ও আওধী ভাষায়।
এ ছাড়াও দু ভাষাতেই লিখেছেন অসংখ্য কবিতা! ‘নিকা’ সিনেমায় গুলাম আলির গাওয়া বিখ্যাত গজল ‘চুপকে চুপকে রাত দিন…..’, তাঁরই রচনা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অতি সাধারণ জীবনযাপন করে গেছেন, আইনসভার সদস্য হওয়া সত্ত্বেও কোনো সরকারি সুবিধা নিতেন না। সংবিধান রচনা কমিটির সদস্য ছিলেন, কিন্তু আম্বেদকরের সঙ্গে মতভেদের কারণে চূড়ান্ত প্রস্তাব / খসড়ায় সই করেন নি। বলেছিলেন এই প্রস্তাবিত সংবিধান উপনিবেশ প্রভাবমুক্ত নয়!!!
জীবনকে একেবারে নিজের শর্তে এভাবে বাঁচতে পারা খুব সোজা কাজ কিন্তু নয়!
লোকসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন তাঁরা নাকি প্রথম থেকেই ৩৭০ ধারার বিরোধিতা করে গেছেন। কিন্তু, কী আশ্চর্য হসরত মোহানির নামটাই রইল’ অনুচ্চারিত!!!
এটা অবশ্য ঠিক, ইতিহাস নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়ে লাভই বা কি? তার থেকে নতুন করে লিখে ফেলাই বোধহয় অনেক সোজা, যখন যে রকম সুবিধা হবে এই আর কি!!
অঙ্গরাজ্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী কী হওয়া উচিত তার অনেক মডেল আছে ; আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত রাশিয়া, পূর্বতন যুগোশ্লাভিয়া ও চৈনিক মডেল…..। আমাদের শাসকদের বোধহয় শেষোক্তটাই বেশি পছন্দ!! কত সহজে প্রায় অনায়াস দক্ষতায় তিব্বত বা শিনচিয়াং প্রদেশের (Autonomous Council) সমস্যার সমাধান করে ফেলছে কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে! আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কে কী বললো কী এসে যায়!!! Style of governance তো নানা রকম হতেই পারে, ধরে নিন এটাও এক ধরণের প্রশাসন চালানোর পদ্ধতি, কেন্দ্রের কথাই আইন!! এই পদ্ধতিতে অবশ্যই কোনও জটিলতা নেই, সবই অতি সহজ সরল বিতর্কবিহীন! ১৯৬৪ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী গুলজারীলাল নন্দ বলেছিলেন, “…..Article 370 is neither a wall nor a mountain, but that it is a tunnel. It is through this tunnel a good deal of traffic has already passed and more will.”
না, এখন আর টানেল ফানেল কিছু লাগবে না, নিজেরই জিনিসের সঙ্গে আবার যোগাযোগের মাধ্যমের কী দরকার?!
একটাই সমস্যা, ভারত অন্ততঃ ১২টি রাজ্য 371 (A to J) ধারায় এবং আরও কিছু রাজ্যের নির্দিষ্ট অঞ্চল বিশেষ ক্ষমতাবলে শিক্ষা, চাকরি এবং বহিরাগতদের দ্বারা জমি কেনা-বেচার বিষয়ে বিভিন্ন রক্ষাকবচের অধিকারী। ৩৭০ ও একই সঙ্গে ৩৫এ ধারার বিলোপে, জম্মু কাশ্মীর ও লাদাখ এর কোনও আলাদা রক্ষাকবচই রইল’ না! কোর্ট এই নিয়ে কিছু উল্লেখ করে নি, তাই বলার কিছু নেই। তবে, কাশ্মীরের কথা নাহয় ছেড়ে দিন জম্মু বা লাদাখের জনগণ খুব খুশী হবেন তো??
কিছু দিন আগে কাশ্মীর কন্যা নন্দিতা হাকসারের The many faces of Kashmiri nationalism….পড়ছিলাম।সেখানে একজন প্রশ্ন করছে, কাশ্মীর যখন ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তখন কাশ্মীরের ব্যথা বেদনা কি শরীরের বাকি অংশ অনুভব করে না?? কী বলা যাবে??
কে কী অনুভব করে ঠিক জানা নেই, তবে একটা অংশ যে ভীষণ ভাবে উল্লসিত সে তো দেখতেই পাচ্ছি ; ‘২৪ সালের নির্বাচনে জেতা যেন এতেই নিশ্চিত হয়ে গেল!!! আবার কী চাই……