গত ৭ এপ্রিল আরেকটি বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস চলে গেল। একেবারে নিঃশব্দেই চলে গেল। আজকাল নানা রকম দিবস টিবস বেশ আড়ম্বর সহকারেই পালন করা হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য দিবস নিয়ে বিশেষ কারো মাথা ব্যথা নেই।
এবছরের স্বাস্থ্য দিবসে WHO এর স্লোগান “হেলথ ফর অল” অর্থাৎ “সবার জন্য স্বাস্থ্য”। এককালে স্বপ্ন টপ্ন দেখতাম হত-দরিদ্র মানুষ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী- একই রোগে একই চিকিৎসা পাবে। এখন অনেক ঘাটের জল খেয়ে জেনে গেছি রাজপ্রাসাদে থাকা মানুষের নখকুনি হলে তাই নিয়ে ঘণ্টায় ঘণ্টায় মেডিকেল বুলেটিন বার হবে; আর প্রত্যন্ত অঞ্চলে যক্ষ্মা বুকে নিয়ে কিশোরী বিড়ি বাঁধবে।
আসলে স্বাস্থ্য বলতে আমরা বুঝি অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা পাওয়া এবং সুস্থ হয়ে ওঠা। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি বলতে আমরা বুঝি বড়ো বড়ো ঝাঁ চকচকে হাসপাতাল। দামী দামী যন্ত্রপাতি। ডাক্তার- সিস্টার- অপারেশন থিয়েটার। অথচ স্বাস্থ্যের প্রকৃত মানে অসুস্থ না হয়ে পড়া।
WHO স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা দিয়েছে “Health is a state of complete physical, mental and social well-being and not merely the absence of disease or infirmity.” অর্থাৎ স্বাস্থ্য মানে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ভাবে ভালো থাকা- স্বাস্থ্য মানে শুধু মাত্র অসুখ বা পঙ্গুত্বের অনুপস্থিতি নয়।
তারপরই বলা হয়েছে The enjoyment of the highest attainable standard of health is one of the fundamental rights of every human being without distinction of race, religion, political belief, economic or social condition. অর্থাৎ জাতি, ধর্ম, অর্থনৈতিক অবস্থা, রাজনৈতিক বিশ্বাস, সামাজিক অবস্থা নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের সুস্বাস্থ্য ভোগ করা একটি মৌলিক অধিকার।
সমস্যা হলো যা মানুষের মৌলিক অধিকার সেগুলো আজকাল আর সহজে পাওয়া যায় না। খাদ্য- শিক্ষা- স্বাস্থ্য এই তিনটে মৌলিক অধিকারের পেছনে যা খরচ হয়, তাতে মাসের শেষে একজন মধ্যবিত্ত মানুষকে জটিল যৌগিক অংক কষতে হয়।
কেন মৌলিক অধিকার গুলি ফেল কড়ি মাখো তেল হলো, কেন খাদ্যের থেকে মোবাইল সহজ লভ্য হয়ে গেল সেসব জটিল বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লেখার ক্ষমতা আমার নেই। আমি বরঞ্চ গল্প শোনাতে পারি। শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের থেকে বঞ্চিত মানুষেরা কিভাবে বিকল্প চিকিৎসার সাহায্য নেন এবং বিপদে পড়েন।
ভোর চারটের সময় একটি ১২ বছরের ছেলেকে নিয়ে তাঁর হত দরিদ্র বাবা গ্রামীণ হাসপাতালে এসেছেন। ছেলেটি প্রায় অচৈতন্য। মুখ থেকে ফেনা বেরোচ্ছে। ছেলেটিকে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ সাপে কামড়েছিল। তারপর গ্রামের লোকের পরামর্শে একজন ওঝা ডাকা হয়। ওঝা ঘণ্টা খানেক ঝাড়ফুঁক করে জানান বিষ নেমে গেছে। ছেলেটি বিপদমুক্ত। তিনি তিনশ টাকা দক্ষিণা ও একটি নতুন গামছা নিয়ে বিদায় নেন। তার কিছুক্ষণ পর থেকেই ছেলেটির অবস্থা খারাপ হতে থাকে।অবশেষে ভ্যান রিক্সা জোগাড় করে ১২ কিলোমিটার গ্রামের ভাঙাচোরা রাস্তা পেরিয়ে ছেলেটি যখন গ্রামীণ হাসপাতালে পৌঁছায় তখন কিছু করার নেই। এভিএস চালিয়ে ছেলেটিকে সাব ডিভিশন হাসপাতালে রেফার করা হয়। কিন্তু ছেলেটি বাঁচেনি।
প্রায় সমবয়সী একটি ছেলেকে ভোর বেলা বাবা নিয়ে এসেছেন। ছেলেটি কোনোরকমে হাঁটতে পারছে। কিন্তু কথা বলতে পারছে না। কিছু খেতে গেলেই ভয়ানক বিষম খাচ্ছে। চোখে মুখে একটু হাওয়া দিলে চমকে উঠছে। ছেলেটিকে দিন পনেরো আগে কুকুরে কামড়েছিল। যথারীতি হাসপাতালে না এনে একজন ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওঝা পিঠে থালা বসিয়ে দেখেছিল থালা আটকে যাচ্ছে। সে বলেছিল কুকুরের বিষ ছেলেটির শরীরে আছে। ঝাড়লেই ঠিক হয়ে যাবে। ঘণ্টা খানেকের ঝাড়ানোর নামে নাটকের পর ওঝা আবার ছেলেটির পিঠে একটি থালা বসিয়ে দেখেছিল আর আটকাচ্ছে না। অর্থাৎ আর বিষ নেই। বাবা মাও নিশ্চিন্তে ছিলেন। অবশেষে জলাতঙ্ক আক্রান্ত ছেলেটিকে যখন হাসপাতালে আনা হলো, তখন আর কিছু করার নেই আই ডি হাসপাতালে রেফার করা ছাড়া। কারণ জলাতঙ্কে মৃত্যুর হার ১০০%।
এই অবধি যারা পড়েছেন তাঁরা ভাবছেন এতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দোষ কোথায়। মানুষ যদি অন্ধ বিশ্বাস আঁকড়ে থাকে তাহলে তো এমনই ঘটবে। প্রথমেই হাসপাতালে এলে এদের বাঁচানো যেতো। যারা এমন ভাবছেন তাঁরা সম্ভবত স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা পুরোপুরি বোঝেন নি। সামাজিক ভাবে ভালো থাকাও স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর এই প্রান্তিক মানুষগুলি কেউই সামাজিক ভাবে খুব ভালো অবস্থায় ছিলেন না। রাষ্ট্র তাঁদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারেনি। সামাজিক নিরাপত্তা দিতে পারেনি।
তবে সব সময় শিক্ষা থাকলেও যে খুব বেশি লাভ হয় তাও না। মেডিকেল কলেজের এমারজেন্সিতে পঁয়ত্রিশ বছরের যুবককে নিয়ে আসা হয়েছে। যুবকটি ইঞ্জিনিয়ার। একটি নামী সফটওয়ার কোম্পানিতে চাকরি করেন। যুবকটির চেতনা নেই। নাকমুখ দিয়ে সাদা ফেনা বেরিয়ে আসছে। তড়িঘড়ি মাথার সিটি স্ক্যান করে দেখা গেল মাথায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। বাড়ির লোকের সাথে কথা বলে জানা গেল যুবকটির বছর খানেক আগে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে। প্রথম প্রথম প্রেশারের ওষুধ খেলেও বাড়ির লোক এবং নিকটাত্মীয়দের পরামর্শে যুবকটি ওষুধ বন্ধ করেন এবং বিকল্প চিকিৎসা শুরু করেন। কারণ বাড়ির লোকের ধারণা ছিল এতো কম বয়স থেকে প্রেশারের ওষুধ শুরু করলে সারা জীবনই ওষুধ নির্ভর হয়ে কাটাতে হবে। তাঁরা শুনেছেন দীর্ঘদিন প্রেশারের ওষুধ খেলে কিডনি নষ্ট হতে পারে। যুবকটি আর বাঁচেনি। তাঁর প্রিয়জনেরাই তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী হয়ে রইলেন, যদিও তাঁরা তথাকথিত অশিক্ষিত নন।
এরকম ঘটনার কথা বলে শেষ করা যাবে না। এখন গ্রামে নয়, একটা মফঃস্বলেই প্র্যাকটিস করি। রোগীরা যারা আসেন তাঁরা অর্থনৈতিক ভাবে খুব একটা সুবিধাজনক জায়গায় না থাকলেও মোটামুটি শিক্ষিত। কিন্তু তাঁদের মধ্যেও স্বাস্থ্য নিয়ে ভুল ধারণা কম নয়। বিকল্প চিকিৎসা নিয়েও তাঁদের আগ্রহ কম নয়। বাতের রোগীরা প্রায় প্রত্যেকেই বলেন অমাবস্যা পূর্ণিমায় তাঁদের ব্যথা বাড়ে। এমন হওয়া সম্ভব নয় জানালে তাঁরা তর্ক করেন, চাঁদের প্রভাবে জোয়ার ভাঁটা হতে পারে আর ব্যথা বাড়তে পারে না।
অনেকেই রোগা হওয়ার জন্য সকালে লেবুজল খান। কষ্ট করে খালি পেটে লেবুজল না খেয়ে সেটা ভাতের সাথে মেখে খেতে বললে তাঁরা মনঃক্ষুণ্ণ হন।
প্রায় সকলেরই ধারণা টক খাবার খেলে ঘা শুকায় না। ডিম খেলে প্রেশার বাড়ে। লবণ ভেজে খেলে প্রেশারের রোগীদের সমস্যা হয় না। ঘাসের উপর খালি পায়ে হাঁটা উপকারী। এসব ভুয়ো তথ্য এতোগুলি মানুষকে একসাথে কীভাবে প্রভাবিত করলো সেটা গবেষণার ব্যাপার।
এক রোগিণী এসেছেন। ডায়াবেটিক ফুট আলসার। বুড়ো আঙুল গর্ত হতে হতে সাদা হাড় বেড়িয়ে গেছে। এই অবস্থায়ও তিনি ভোর বেলায় খালি পায়ে ঘাসের উপর হাঁটছেন। খালি পায়ে না হাঁটলে নাকি মাটির সাথে ঠিক ঠাক আর্থিং হয়না। এখন ভালোই আর্থিং হচ্ছে এবং ঘা’ও বাড়ছে। এখন তাঁর বুড়ো আঙুলটি কেটে বাদ দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।