ক্রিস্টোফার নোলান নামক প্রখ্যাত ভদ্রলোক যখন 2021 সালের অক্টোবর মাস নাগাদ ঘোষণা করেছিলেন ‘ইউনিভার্সাল পিকচার্স’-এর হাত ধরে যে – তাঁর পরবর্তী প্রজেক্টের সাউন্ড ডিজাইনার হলেন লুডউইগ ইয়োহানসন, তখন কিন্তু সিনেমাখোরেরা অবাক হয়নি এতটুকুও। নোলনের ঠিক আগের চলচ্চিত্র, নাম যার ‘টেনেট’, সেই টেনেটের আশ্চর্য আবহনির্মাণ তো করেছিলেন এই লুডউইগ সাহেবই।
হ্যাঁ। সত্যের খাতিরে এটাও বলা উচিত যে– টেনেটের সময়ই বরং উৎকণ্ঠা ছিল বিস্তর। হ্যান্স জিমারের ছেড়ে যাওয়া সিংহাসনে লুডউইগ রাজপাট বিস্তার করতে পারবেন কিনা, তাই নিয়ে। কিন্তু সেসব আশঙ্কা তো সপাটে দূরে উড়িয়ে দিয়েছেন ইয়োহানসন। টেনেটের থাম্প এবং বেস, শ্রোতাদের কানে এখনো বাজে মুহুর্মুহু। অতএব, লুডউইগ নামক এই ইয়োহানসন ভদ্রলোক উপযুক্ত তো বটেই। আর তাই আমার–আপনার মত আপামর সিনেমামোদী, বরং অপেক্ষায় ছিলাম পরমাণু বোমা সমবৃদ্ধ ওপেনহাইমার নামক ফিলিমটি কেমন হবে তাই নিয়েই। সাউন্ড ট্র্যাক নিয়ে নয়।
****
লুডউইগকে নিয়ে যাঁরা জানেন না, তাঁদের বলে রাখা উচিত তথ্যের খাতিরে, ভদ্রলোকের প্রথম ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরই উচ্ছসিত প্রশংসিত হয়েছিলেন sundance film festival এবং Cannes এ। সে ছবির নাম Fruitvale station। এবং সে রকম ছবি প্রত্যক্ষ করাটাও একটা দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা বটে।
এসব যদি বাদও দিই, একাডেমি এওয়ার্ড পাওয়া ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’-এর সাউন্ড ট্র্যাক, অথবা আপামর দর্শকের কাছে বড্ডো পপুলার – ‘টার্নিং রেড’ সিনেমার সাউন্ড ডিজাইনার এই লুডউইগ ইয়োহানসনই।
আমি দুজন অভিন্নহৃদয় মানুষকে বিলক্ষণ চিনি, যাদের একজন ব্ল্যাক প্যান্থার, মার্ভেল ডিসি নিয়ে পাগল। অন্যজন, ডিজনি, এনিমেশন, কোরিয়ান লাভ স্টোরি, বা টার্নিং রেড নিয়ে। এবং একথাও জানি যে তাদের দুজনের কেউই খেয়াল করেননি যে দুই জনকেই সমান তৃপ্তি দিচ্ছেন একই সুরকার। লুডউইক ইয়োহানসন।
এ বড় কম কথা নয়।
এ বড্ডো আশ্চর্যের।
****
যেকোনো ম্যুভি এবং তার নেপথ্য সুরের একটা গল্প থাকে। গল্প থাকে ভীষন পরিচিত। চলচ্চিত্র নির্মাতা সিনেমা শ্যুট করবেন। ‘ রাফ কাট’ সেই ফার্স্ট প্রিন্টে যোগ করা হবে ‘ টেম্প স্কোর’। টেম্প স্কোর, অর্থাৎ এমন কিছু সুর/ মিউজিক , যা অলরেডি এক্সসিস্ট করে জগতে।
মানে ধরা যাক, অমিতাভ বচ্চন অভিনীত সত্তে পে সত্তা র শুটিং প্রায় শেষ। অনেকটাই মিটে গেছে ডাবিং, কিংবা সিঙ্ক সাউন্ড সিংক্রোনাইজেশনও। এবার সেই রাফ ড্রাফট, মনিটরে দেখছেন পরিচালক , প্রযোজক এবং ঠিক তার পাশেই চেয়ার টেনে বসে থাকা–সুরকার। তো, ধরা যাক সেখানে, সেই রাফ ড্রাফটে, প্রয়োগ করা হলো ‘সেভেন ব্রাইডস ফর সেভেন ব্রাদার্স’ নামক হলিউডি সিনেমার সুর। এবং সুরকারকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো যে–” দেখুন মশাই, ঠিক এই জাতীয় সুরই চাইছি আমরা। নেপথ্য সঙ্গীত হিসাবে। “
সুরকার সেসব মন দিয়ে শুনলেন টুনলেন, এবং প্যাঁ পোঁ হারমোনিয়াম বাজিয়ে শুরুয়াত করলেন চলচ্চিত্র নির্দেশক-এর কাঙ্খিত সুর নির্মাণ করে ফেলতে।
এটা, সত্তে পে সত্তা না হয়ে অন্য কিছুও হতে পারে। হতে পারে রমেশ সিপ্পির শোলে, এবং কাউবয় জ্যাজ। হতে পারে , এবং ন্যাশনাল ট্রেজার ম্যুভির ফার্স্ট কাট আর ইন্ডিয়ানা জোন্স-এর সাউন্ডট্র্যাক ।
মোটমাট কথা এই যে– সিনেমার শ্যুটিং কমপ্লিট। ডাবিংও সারা হয়ে গেছে। এখন শুধু প্রয়োজন– আবহ নির্মাণের। যে আবহই আদতে সব।
আপনি শব্দ বন্ধ করে এক্সজরসিস্ট দেখুন। ভয় পাবেন না এতটুকু।
আপনি নেপথ্য ভুলে গিয়ে ইটি, এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল এর শেষ সিন দেখুন। কান্না দুরস্থান, স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে চায়ে চুমুক দিতেও আটকাবে না একফোঁটা।
আপনি ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ব্যতীত শুধু সংলাপ সমেত এমনকি পথের পাঁচালিও দেখতে বসুন। হাততালি দেবেন হয়ত চলচ্চিত্র নির্মাণের। কিন্তু গলায় এসে বসে যাবে না কান্না।
আবহ, নেপথ্য সঙ্গীত, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর… সাউন্ড ডিজাইনিং…এগুলো বড্ডো জরুরি। কসম খুদার, যদি ব্যক্তিগত জীবনে এই আবহসঙ্গীত থাকতো সব্বার, তাহলে বেশিরভাগ বিচ্ছেদই আটকে যেত। আমরা যখন ঝগড়া করি বিশ্রী, অথবা দিনের পর দিন ঘ্যানঘ্যান করতে করতে কেঁদে ফেলি একদিন হতশ্রী, তখন যদি ভায়োলিন বাজত কেউ অলক্ষ্যে, তাহলে বিচ্ছেদ বা ভুল বোঝাবুঝি হত না কোনদিনই।
***
অক্টোবর। 2021। ওপেনহাইমার রিলিজ হওয়ারও বছর দেড়েক আগেকার কথা। ক্রিস্টোফার নোলান যোগাযোগ করেছিলেন লুডউইগ ইয়োহানসনের সাথে। মূল সিনেমা শ্যুট করারও আগে লুডউইগকে দেখিয়েছিলেন কিছু মুহূর্ত।
এন্ড্রু জ্যাকসন নামক এক সাহেব ছিলেন ওপেনহাইমার নামক সিনেমার ভ্যিযুয়াল এফেক্টস সুপারভাইজার। তো সেই এন্ড্রু এবং নোলান কিছু আপাত বিচ্ছিন্ন মুহূর্ত দেখিয়েছিলেন লুডউইগকে। নিউক্লিয়ার ফিশন, নিউক্লিয়ার ফিউশন, কোয়ান্টাম মেকানিক্স… ইত্যাদি কিছু মুহূর্ত। কল্পিত। বোঝাতে চেয়েছিলেন– শোনো লুডউইগ,এই এরকমটা চাইছি। এইরকম। বাঁধভাঙা। আপাত এলোমেলো। এবং অতিবাস্তব, ক্ষুরধার। এবং একই সাথে আমরা চাইছি এমন এক আবহ নির্মাণ, যা ওপেনহাইমার নামক বিজ্ঞানীর মস্তিষ্কে অবিরত ঘটে চলা এলোমেলো ঘটনার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ।
ওপেনহাইমার বিজ্ঞানী হতে পারেন। পরমাণু বোমার কর্ণধার হতে পারেন। কিন্তু তিনিও ছিলেন আদতে মানুষই। আর তাই– এই তিনি ভাবছেন বিজ্ঞানের সূত্র, আর পর মুহুর্তেই তিনি ভাবছেন স্ত্রীকে সময় দেওয়া হচ্ছে না, ধ্যাৎ! এবং তারই সেকেন্ড ক্ষনিকের মধ্যেই ভাবতে শুরু করেছেন, বোমা যদি পড়ে সত্যি সত্যিই তাহলে হাততালি/ পা তালি ( foot stompimg) এর পাশেপাশেই হয়ত মনে পড়বে– ঠিক কতগুলো মুখ ঝলসে গেল অকালে।
অতএব…ভাবো। লুডউইগ। ভাবো।
***
তা লুডউইগ ভেবেওছিলেন। সিনেমা শ্যুট হয়ে যতদিনে রাফ ড্রাফট হয়ে গেছে, ততদিনে তিনি বানিয়ে ফেলেছেন প্রায় ঘন্টা তিনেকের সুর। যাকে আস্ত একটা অর্কেস্ট্রা বলাই বরং শ্রেয়। টেম্প স্কোর যোগ করে তাই আর ড্রাফট আর দেখতে হয়নি নোলান কে। প্রাথমিক স্কোর, রেডি। প্রস্তুত।
****
অন্য যে কেউ হলেই অন্য কিছু নির্মাণ করতেন। হয়ত, পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ নিয়েই কাটিয়ে দিতেন এত তৃতীয়াংশ। অথবা হয়ত পরমাণু বোমা কতখানি খারাপ সে বিষয়ে জ্ঞান দিতে গিয়ে পর্দা জুড়ে দেখিয়ে যেতেন জ্বলে যাওয়া শবদেহ। হাততালি আর বক্সঅফিস বকওয়াস জুটতো তাতে বিস্তর। কিন্তু ভদ্রলোক, এই ক্রিস্টোফার নোলান নামক মানুষটি ভিন্নরকম ভেবেছিলেন। ওপেনহাইমার শিরোনাম যখন এ সিনেমার, তখন সিনেমাটি ওপেনহাইমারেরই জীবনী।
নাটকীয়তা নেই। স্পেশাল এফেক্টস নেই। থমকে দেওয়া বিষয় নেই।
একটা লোক। যে আদতে বিজ্ঞানী। যার প্রাকটিক্যাল সায়েন্স ভালো লাগে না। যে স্বচ্ছন্দ থিওরিটিক্যাল সায়েন্স-এ। যার ব্যক্তিগত জীবন বিধস্ত। দিশাহীন। একাধিক নারীসঙ্গ। একাধিক গৃহসুখ বজায় রেখে সুখী সুখী বিপ্লব। এবং তারও অধিক ‘ঠিক ভুল ঠিক’ বিড়ম্বনা।
ক্রিস্টোফার নোলান নির্মিত ওপেনহাইমার আদতে এটুকুই। টুরিং বিষয়ক দ্য ইমিটেশন গেম এর সাসপেন্স নেই। পাগলাটে জন ন্যাশের আ বিউটিফুল মাইন্ড জাতীয় নাটকীয়তা নেই। নেই ” থিওরি অফ এভরিথিং” এর স্টিফেন হকিং এর কান্নায় গলা বুজে যাওয়া মুহূর্ত।
ওপেনহাইমার, স্রেফ ওপেনহাইমারই।
*****
তবুও তো, দায় কিছু থেকে যায়। যায়ই। শেষমেশ। আই ম্যাক্স ক্যামেরা নিয়ে শুটিং করার হাইপ। অথবা, ” ওই রে, নোলান পরমাণু বোমা নিয়ে সিনেমা নামাচ্ছে রে, ” জাতীয়।
এবং লুডউইগ সে বিষয়েও যত্নবান ছিলেন অবশ্যই। সমগ্র সিনেমাতে একবারও ‘ থাম্প’ / ঢিকচিক শব্দ ব্যবহার করা হয়নি নেপথ্যসঙ্গীতে। সচেতনভাবেই। পাছে, পরমাণু বোমার টেস্ট করার সময়ের বুমিং সাউন্ড -এর বুম বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে যাই আমরা। পাছে ম্লান হয়ে যায় বোমার– চরমতম অভিঘাত।
পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছিল বেহালা। ব্যবহৃত হয়েছিল পিয়ানো। পাগলাটে। কতখানি পাগলাটে? ” Can you hear the music ” নামক মিউজিক পিসে একুশ বার টেম্পো অর্থাৎ গতিবেগ, গতির বাঁক পরিবর্তন করা হয়েছিল ভেবেচিন্তে। ঠিক যে প্রকার একুশ বাইশ না ভেবেই মুহুর্মুহু বাঁক বদলায় আমাদের ভাবনা। এই সেই ভাবনা সৃষ্টিমূলক, পরমুহূর্তেই আত্মহননেচ্ছু। এই ক্ষণে বিজ্ঞান, পর লহমায় কামনা।
কত কঠিন অথচ কতখানি নিপুণ এই সুর নির্মাণ সেটা বুঝতে হলে স্রেফ তিনটি মিউজিক পিসই যথেষ্ট।
Meeting kitty , Atmospheric ignition আর Can you hear the music.
সাথে অবশ্যই ‘ ground zero’। বেস মিউজিকের সাথে যেখানে খাপছাড়া ছড়িয়ে আছে স্ট্যাটিক নয়েজ।
****
সাউন্ড ডিজাইনের সব চাইতে বড় চমকটি যদিও শেষমেশ লুডউইগ দিতে পারেননি। দিয়েছেন ফিল্মটির নির্দেশক ক্রিস্টোফার নোলান খোদ। ছবিটিতে বেশ কিছু মুহূর্তে সমস্তরকম ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরকে থামিয়ে, নেপথ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে স্রেফ কান্নার শব্দ। রবার্ট ওপেনহাইমারের শিশুপুত্রের। একটানা, এক নাগাড়ে, ক্লান্তিকর, বিরক্তি উদ্রেককারী। পাগল-পাগল লাগবে সেই কান্না শুনলে। আর মনের ভেতর খুব সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে ওপেনহাইমার নামক একটা লোকের দিশাহারা অবস্থাটা। সংসার, কর্মক্ষেত্র, লাভ-লাইফ , পরমাণু বোমার পর্বতপ্রমাণ দায়… এসব নিয়ে যে এক্কেবারে বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত, পাগলপারা।
*****
ওপেনহাইমার দেখবার জন্য যাঁরা ভিড় জমিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেরই মন ভরেনি এ ছবি দেখে। নোলনের আর সব সিমনেমার তুলনায় এটাই সবচাইতে ম্যাড়মেড়ে। এবং সম্ভবত এটাই শ্রেষ্ঠ।
এ ছবিতে কারুকার্য নেই স্পেশাল এফেক্টের। চমক নেই নাটকীয়। নিজের প্রাইম/ শীর্ষে থেকেও সমস্ত বাজারি প্রলোভন উপেক্ষা করে যে মানুষটি এরকম আক্ষরিক বায়োপিক নির্মাণ করতে পারেন, তাঁকে কুর্নিশ।
আর কুর্নিশ লুডউইগকে। যে ভদ্রলোক না থাকলে জানতেই পারতাম না – মাথার ভেতর অবিরত বয়ে চলা ভাবনার সুরটি আদতে কি রকম!
(সিনেমাটি অবশ্যই, অতি অবশ্যই থিয়েটারে গিয়ে অনুভব করে আসুন। শব্দ, সুর, স্বর যখন ফ্রন্ট রাইট স্পিকার থেকে একটু একটু করে পিছিয়ে চলে আসবে ডানহাতি ব্যাক স্পিকারে আর পর মুহূর্তেই ছিটকে চলে যাবে লেফট মিডল স্পিকারে, সেখান আবার উন্মাদের মতো রাইট ব্যাক, লেফট ফ্রন্ট… ফ্রন্ট সেন্ট্রাল … আশ্চর্য একটা প্যাটার্ন… অদ্ভুত একটা গঠন তৈরি হবে মাথার ভিতরে। ঠিক ওই পরমাণু, ইলেকট্রন, প্রোটন, কোয়ার্ক-এর মতোই। কিংবা এলোমেলো চিন্তার মতো বিমূর্ত বিষয়কে মূর্ত হয়ে উঠতে প্রত্যক্ষ করবেন অবাক হয়ে।)