সাড়ে ছয় বছর হতে চলল। ২০১৭-র মার্চ মাসে রাজ্য সরকার নিয়ে এলো নতুন ক্লিনিকাল এস্টাব্লিশমেন্ট অ্যাক্ট। সরকার ও শাসক দলের প্ররোচনায় চিকিৎসক ও সামনের সারির চিকিৎসা কর্মীদের ওপর হিংসার ঘটনা বেড়েই চলেছে। প্রতিক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন তরুণ তরুণী চিকিৎসক গড়ে তুললেন এক ফেসবুক গ্রুপ-ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম, পরে তা সরকারি-বেসরকারি, সিনিয়র-জুনিয়র সব ধরনের ডাক্তারেরই সংগঠনের রূপ নিল। আগে থেকেই ছিল অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস, ডক্টরস ফর ডেমোক্রেসি, ডক্টরস ফর পেশেন্টস, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ, মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার ও সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম। সাতটি সংগঠনকে নিয়ে তৈরি হল জয়েন্ট প্লাটফর্ম অফ ডক্টরস, ওয়েস্ট বেঙ্গল চিকিৎসকদের জীবন জীবিকার স্বার্থে, সুস্থ কাজের পরিবেশের স্বার্থে।
একসঙ্গে পথ চলার বেশ কয়েকটি বছর কেটে গেছে। চিকিৎসকদের ওপর আক্রমণের ঘটনায় বারবার ছুটে গেছে জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম, প্রতিবাদ করেছে সরকারি হাসপাতালকে বেসরকারি ব্যবসাদারের হাতে তুলে দেওয়ার, পাশে দাঁড়িয়েছে ২০১৮-এ মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেল আন্দোলনের, ২০১৯-এ নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারের ওপর নৃশংস আক্রমণের প্রতিবাদে জনসাধারণকে শামিল করেছে, ২০২১-এ আর জি কর মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ে পাশে থেকেছে, ২০২২-এ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের দাবিতে মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে থেকেছে।
২০১৮-র মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনকে ঘিরে জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম থেকে আলাদা হয়েছে মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার ও সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম। নতুন যুক্ত হয়েছে হেলথ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। আশির দশকে অল বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর ফেডারেশনের আন্দোলনকে সমর্থনের প্রশ্নে হেলথ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ভেঙে তৈরি হয়েছিল অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস। পেশার স্বার্থে জনসাধারণের স্বাস্থ্যের অধিকারের স্বার্থে আপাত বিরোধী এই দুটি সংগঠন একসঙ্গে পথ চলা শুরু করেছে।
অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস, ডক্টরস ফর ডেমোক্রেসি, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ, হেলথ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ও ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম একসঙ্গে ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনে লড়াই করেছে ২০১৮-এ। সেই নির্বাচনে সীমাহীন দুর্নীতির প্রতিবাদে হাইকোর্টে দায়ের করা মামলায় নির্বাচন স্থগিত থেকেছে।
২০২২ এর মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনে এই পাঁচটি সংগঠনের সঙ্গে একসঙ্গে লড়াই করেছে ডক্টরস ফর পেশেন্টস ও প্রদেশ কংগ্রেসের মেডিক্যাল সেল। আমরা জোরদার টক্কর দিয়েছি। বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক আমাদের সমর্থন করেছেন। এই নির্বাচনকেও সমস্ত স্তরে শাসক দল প্রহসনে পরিণত করেছে, লাগামহীন অনাচার সত্ত্বেও আমরা জোরদার টক্কর দিয়েছি, জয়েন্ট প্লাটফর্মের প্রার্থীরা এগিয়ে থাকায় গণনাতেও ব্যাপক গোলমাল করে শাসকগোষ্ঠী। এই প্রহসনের নির্বাচন বাতিলের দাবিতে আইনি লড়াই চলছে।
একদিকে চিকিৎসক ও জন বিরোধী সরকার, শাসক দলের চিকিৎসক সংগঠন, দলদাস স্বাস্থ্য ভবন, অন্যদিকে আমরা। প্রতিবাদ করার অপরাধে অন্যায় ভাবে প্রত্যন্ত স্থানের মেডিকেল কলেজগুলোতে ট্রান্সফার করা হয়েছে মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনে আমাদের প্রার্থীদের, আমাদের সংগঠনগুলির নেতাদের।
আমরা থেমে থাকিনি। প্রতিবাদ প্রতিরোধ জারি থেকেছে।
কোন লাভই কি হয়নি?
- চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মীদের ওপর আক্রমণের ঘটনা নিশ্চিতভাবে কমেছে।
• কোভিড কালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আক্রান্ত মানুষের পাশে থেকেছেন আমাদের সদস্য চিকিৎসকরা, অনেকে শহীদ হয়েছেন। - ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশনের বিভিন্ন চিকিৎসক বিরোধী, জন বিরোধী আদেশনামা, মিক্সোপ্যথি, ব্রিজ কোর্সে ডাক্তার তৈরি, সরকারি হাসপাতাল ভাড়া দিয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ–এইরকম নানা তুঘলকি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জয়েন্ট প্লাটফর্ম কনভেনশন-সহ নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি নিয়েছে।
• ২০২২-এর মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের মামলায় হাইকোর্ট ইন নির্বাচন সংক্রান্ত সমস্ত নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করেছেন। মামলা চলছে।
• স্বাস্থ্য দপ্তরের বদলি সংক্রান্ত অনিয়মের পর্দা ফাঁস করতে আমরা আর টি আই করেছিলাম। আর টি আই-এ জানা গেছে অধ্যাপক অভিজিৎ ভক্ত-র বদলি রদ করায় কি পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে।
• স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্বজন-পোষণ পোষণের বিরুদ্ধে আমরা রাজ্যপাল কে জানাই। উপাচার্য অপসারিত হয়েছেন।
• Hack-O-Med নামক যে অনুষ্ঠান বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যানেজমেন্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রভৃতির কাছ থেকে চাঁদা তোলা হয়েছে, অনুষ্ঠানের দায়িত্বে স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিকের আত্মীয় নিযুক্ত হয়েছে–এইসবই আমরা জানতে পেরেছি আর টি আই-এর মাধ্যমে।
• আগেই বলেছি আর জি কর মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ে আমরা পাশে ছিলাম। পরে চাপ দিয়ে ছাত্র-ছাত্রী ও জুনিয়র ডাক্তারদের প্রিন্সিপাল বাধ্য করেন জয়েন্ট প্লাটফর্মের নেতাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে। সবশেষে বদলি হয়েছেন আর জি কর মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল। বদলির কৃতিত্ব আমাদের নয়, কিন্তু তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি আমরা করেছিলাম বারবার স্বাস্থ্য দপ্তরে রাজ্যপালের কাছে।
এইরকম এক পরিস্থিতিতে জয়েন্ট প্লাটফর্ম এক কনভেনশনের আয়োজন করেছে। ১৬ই সেপ্টেম্বর বিকাল তিনটায় মৌলালির যুব কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হতে চলা এই মহতী কনভেনশনে সিনিয়র জুনিয়র ডাক্তার, সিনিয়র জুনিয়র রেসিডেন্ট, মেডিকেল ছাত্র ছাত্রী, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়া আসবেন সাধারণ মানুষও।
আপনিও আসুন। সবাই মিলে আমরা আগামী দিনের চলার পথ নির্ধারণ করি।