রাজ্যের চিকিৎসা-শিক্ষাব্যবস্থা – বা সামগ্রিকভাবেই রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা – যে ঠিক কোন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে, তার একখানা উদাহরণ হতে পারে আরজিকর মেডিকেল কলেজ।
সেখানকার অধ্যক্ষ ডা সন্দীপ ঘোষকে মুর্শিদাবাদ মেডিকেল কলেজে বদলি করা হয়েছে।
চিকিৎসা-শিক্ষাব্যবস্থার চাকরিতে বদলি ব্যাপারটা স্বাভাবিক। যদিও এখন পরিস্থিতি একটু অন্যরকম। আমাদের মতো সরকারের বিরাগভাজনদের বাড়ি থেকে দূরে থাকতে হওয়া – আরেকটু বিরাগভাজন হলে আরও বেশি দূরে – এবং কৃপাধন্যদের বছরের পর বছর কলকাতার কলেজ আলো করে বসে থাকা – একই জায়গায় দশকের পর দশক থাকতে থাকতে পশ্চাদ্দেশে শ্যাওলা পড়ে যাওয়া – এমনটাই স্বাভাবিক। এসব মেনে নিয়েই চাকরি করা, বিরক্তি নিয়েও যথাসাধ্য ‘পরিষেবা দেওয়া’-র চেষ্টা। এই নিয়মের মধ্যেও ডা সন্দীপ ঘোষের ব্যাপারটা ব্যতিক্রম।
কেননা, মাসকয়েক আগেই তাঁর একটি বদলির অর্ডার বেরিয়েছিল। যেহেতু তিনি আরজিকর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, তাঁর জায়গায় আরেকজন অধ্যক্ষকে সেই কলেজে পাঠানোও হয়েছিল। তাঁর জায়গায় আরও একজন। যাকে বলে চেইন অর্ডার। কিন্তু যে অধ্যক্ষ আরজিকরে জয়েন করতে এলেন, তিনি দেখলেন, অধ্যক্ষের ঘর তালাবন্ধ। উপাধ্যক্ষও ‘ছুটিতে আছেন’। দিশেহারা অবস্থায় ইতিউতি ফোনাফুনি করে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দশায় শেষমেশ তিনি পরদিন জানলেন ওসব অর্ডার-ফর্ডার বাতিল হয়ে গিয়েছে।
এর পরের ঘটনা আরও চমকপ্রদ। বদলির অর্ডার বাতিল হয়ে ডা ঘোষ পুনর্বহাল হতেই ছাত্রছাত্রীরা একেবারে গাঁদাফুলের মালা নিয়ে তাঁকে বরণ করে নিল। পরম ছাত্রদরদী, এমনকি কিংবদন্তীসম, অধ্যাপকদের জীবনেও এমন কিছু ঘটতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
এমতাবস্থায় নাদান পাঠিকা এমন মনে করতেই পারেন, ডা ঘোষ বুঝি অতীব ছাত্রবৎসল। এক অর্থে কথাটা ভুলও নয়। সংবাদপত্রের বয়ান মানলে, বাম-আমলে নাকি কলকারখানা বন্ধ হয়ে যেত ইউনিয়নের দাদাগিরিতে। তা সত্যি নাকি মিথ্যে নিশ্চিত জানি না। কিন্তু ডা ঘোষ একটি মেডিকেল কলেজে সেই ইউনিয়নের দাদাগিরি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছেন। অনেকে দুঃখ করেন, বর্তমান প্রজন্ম নাকি নিতান্ত কেরিয়ার-মুখী, এবং রাজনীতি-বিমুখ। সেই আক্ষেপ আরজিকর মেডিকেল কলেজে হপ্তাখানেক কাটালেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই রাজনীতি-সচেতন ছাত্রছাত্রীরা মেডিকেল কাউন্সিল ভোটে ছাপ্পা দেওয়া থেকে শুরু করে অধ্যাপকদের চমকানো, যাবতীয় গুরুদায়িত্বই অক্লেশে নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন। এমনকি পরবর্তী প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরাও যাতে সম্যক সচেতনতা লাভে বঞ্চিত না থাকেন, সেহেতু একুশে জুলাইয়ের সভায় যোগদান না করার ফল যে ডাক্তারির ফাইনাল পরীক্ষায়ও পড়তে পারে, তেমন কার্যকারণ সম্বন্ধ বুঝিয়ে বলার ব্যাপারেও পরাঙ্মুখ থাকেন না। তো এই গোষ্ঠীর ছাত্রছাত্রীদের ঘিরে থাকে সুরক্ষাচক্র – না, কোলগেট টুথপেস্টের নয়, ডা সন্দীপ ঘোষের সুরক্ষাচক্র।
আবার আরেকদিকে, বিপরীত মতের ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করলে তার প্রতিফলন যাতে পরীক্ষার ফলাফলে যথাযথভাবে পরিলক্ষিত হয়, সেটুকুও দায়িত্ব-সহকারে দেখা হয়ে থাকে। এমনকি, পাস করার পর ইন্টার্নশিপ ঠিকঠাক সম্পূর্ণ করার পর যে কমপ্লিশন সার্টিফিকেট – যা ছাড়া মেডিকেল রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট পাওয়া যায় না – ডা সন্দীপ ঘোষের আমলে কয়েকজন ছাত্রছাত্রীকে সে সার্টিফিকেট হাইকোর্টে মামলা করে আদায় করতে হয়েছে, এমন নজিরও রয়েছে।
তবে কুলোকে যা-ই বলুক, ডাক্তার ঘোষ আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব। ছাত্রদরদী অমায়িক মানুষটি সর্বদাই আগেপিছে জনাচারেক কালো পোশাক পরিহিত সিকিউরিটি নিয়ে ঘোরেন, রাজ্যে তো বটেই, সারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থায়ও এ এক অতিবিরল ব্যতিক্রম। যদ্দূর দেখেছি, রাজ্যের স্বাস্থ্যশিক্ষা-অধিকর্তাও অনুরূপ নিরাপত্তা পান না। এছাড়া, তাঁর এক্সটাকারিকুলার অ্যাক্টিভিটিও রীতিমতো ইম্প্রেসিভ।এমনকি বর্তমান আমলে সততার যে পরিবর্তিত মাপকাঠি, সেই মানদণ্ডেও তাঁর দুর্নীতিপরায়ণতা চমকপ্রদ। কাগজ ইত্যাদিতে সেসব প্রকাশিত হয়েছে, তার প্রতিবাদ জানিয়ে কাগজে চিঠি লিখে তিনি যাকে বলে গালে থাপ্পড় খেয়েছেন – কিন্তু গায়ে আঁচ লাগেনি। স্বাস্থ্যভবনে গিয়ে সেসব দুর্নীতির কাগজ কী করে যেন হারিয়ে যায়। এবং কী এক অজানা কারণে, তদন্তকারী চিকিৎসক-অধ্যাপকরাও এদিক-ওদিক বদলি হয়ে যান। কিন্তু আমরা অপ্রাসঙ্গিক আলোচনায় চলে গিয়ে লেখাটাকে বড্ড লম্বা করে ফেলছি। তো ডা সন্দীপ ঘোষের প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের কথাতে ফিরি।
এহেন ডা ঘোষের বদলির অর্ডারে ছাত্রছাত্রীরা – একটি বিশেষ ঘরাণার ছাত্রছাত্রীরা – যে বিষাদাচ্ছন্ন ও শোক-বিহ্বল হয়ে পড়বেন, তা বোধহয় প্রত্যাশিতই। এবং ডা ঘোষের অনুপ্রেরণায় – বা, প্রশ্রয়ে – বা, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, তাঁর প্রত্যক্ষ তদারকিতেই – কলেজ জুড়ে যেহেতু সেই ঘরাণার ছাত্রছাত্রীদের আধিপত্য – সব অর্থেই – প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই শোকবিহ্বলতায় সমস্ত ছাত্রছাত্রীর যোগদানই বাধ্যতামূলক (স্বেচ্ছায় নাকি অনিচ্ছায়, সে প্রশ্ন তুললাম না)।
তো, ডা সন্দীপ ঘোষের জায়গায় যিনি অধ্যক্ষ পদে যোগ দিতে এলেন, তিনি আপাতত কলেজে ঢুকতে পারছেন না। কেননা শোকাকুল ছাত্রছাত্রীরা প্রিন্সিপালের অফিস অবরোধ করে রেখেছেন।
এ তো আর যাদবপুর নয়, যে প্রশাসনকে এখুনি কিছু একটা করতে হবে। অতএব প্রশাসন নীরব দর্শক হয়ে আছেন।
আরও উৎসাহব্যঞ্জক খবর হলো – শোনা খবর, অবশ্যই – ডা সন্দীপ ঘোষের বদলির প্রতিবাদে বর্ধমান মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা, যাঁদের ভালোমন্দর সঙ্গে এই বদলির কোনও সম্বন্ধ অতিদূর কল্পনাতেও ভেবে উঠতে পারলাম না, তাঁরা নাকি বাহাত্তর ঘণ্টার ছাত্র-ধর্মঘট ডেকেছেন। শুনলাম, কিছু পরীক্ষাটরীক্ষাও নাকি সে বাবদে বাতিল হতে চলেছে।
সব মিলিয়ে, পরিস্থিতি খুবই কিউট।
যা বুঝছি, ডা সন্দীপ ঘোষের যুগাবতার উপাধিলাভ স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।
ভারী সুন্দর! চাপা হিউমার।