শুরুর কথা
ক্যান্সার একটি মারণান্তক অসুখ। পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তের চিকিৎসক, বিজ্ঞানী এবং গবেষকেরা এর বায়োলজি ও চরিত্র বোঝার জন্য বছরের পর বছর ধরে অহোরাত্রি পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসায় বিপুল সাফল্য মিলছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসা করাতে গিয়ে গিয়ে মানুষ সর্বসান্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শেষ অবধি মানুষটি আর ঘরে ফিরে এল না। একটি স্মৃতি হয়ে থেকে যায়। কিন্তু এতে হাঁ-মুখ দানবীয় বহুজাতিক ফার্মা কোম্পানির কিছু এসে যায়না। বাণিজ্যের চাকা ঘুরতে থাকে, মুনাফার তেল বেরোতেই থাকে। মৃত্যু নিয়ে ব্যবসা রমরমিয়ে চলে। “Global pharmaceutical industry – statistics & facts” প্রবন্ধে বলা হয়েছে (Satista, সেপ্টেমব্র ১০, ২০২১-এ প্রকাশিত) – বিশ্বব্যাপী বাজার থেকে ২০২০ সালে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির মোট রেভেন্যুর পরিমাণ ১.২৭ ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলার। এরমধ্যে অঙ্কোলজি (ক্যান্সার সংক্রান্ত রোগ) থেকে আয় ৯৯.৫ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার (এরপরে শুধু ডলার বলা হবে)। আরেকটি প্রবন্ধে (“Cancer Drugs Bring in Most Pharma Revenue”) বলা হয়েছে – “oncology drugs reached $145.4 billion in sales in 2019, almost triple that of the next item on the list, drugs treating diabetes with $51 billion dollars in sales. By 2026, cancer drug sales are expected to more than double their sales to $311.2 billion.” (Satista, ফেব্রুয়ারি, ২০২১)
সিদ্ধার্থ মুখার্জির বেস্ট সেলার ও তথ্যবহুল সুলিখিত গ্রন্থ The Emperoro of All Maladies: A Biography of Cancer-এ (2011) লেখক জানাচ্ছেন – “The emergence of cancer from its basement into the glaring ligt of publicity would change the trajectory of this story.” (পৃঃ ১০০) পরে বলছেন – “Part of the unpredictability about the trajectory of cancer in the future is that we do not know the biological basis for this heterogeneity.” (পৃঃ ৪৬৫)
অথচ ব্যবসা চলছে। সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকায় বলা হল – “Cancer medicine generates enormous revenues but marginal benefits for patients … Cancer has spawned a huge industrial complex involving government agencies, pharmaceutical and biomedical firms, hospitals and clinics, universities, professional societies, nonprofit foundations and media. The costs of cancer care have surged 40 percent in the last decade, from $125 billion in 2010 to $175 billion in 2020 (projected).” (“The Cancer Industry: Hype vs. Reality”, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২০)
ক্যান্সারের বাণিজ্যের ইতিহাস ও আংশিক বায়োলজি নিয়েই আমার এ প্রবন্ধ।
ক্যান্সারের বায়োলজি – ক্যান্সারের বাণিজ্য
১৯৭৬ সালে বিশ্ববাসীকে প্রথম জানানো হল আমেরিকার ২০০ বছর উদযাপনকে সামনে রেখে ক্যানসারকে নির্মূল করার অভিযান চালানো হচ্ছে। পরে বুঝলাম ক্যানসার একটি blanket term অর্থাৎ কম্বলের মতো একটি আচ্ছাদন যার নিচে অন্তত কয়েকশো ধরনের ক্যানসারের সন্তান-সন্ততি শুয়ে আছে। ১৯৭১ সালেই আমেরিকার ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা (War on Cancer) সমগ্র পৃথিবীর ক্যানসার-সংক্রান্ত গাইডলাইন এবং গবেষণার অভিমুখ নির্ধারণ করেছে।
মেরি লাস্কার “সিটিজেন’স কমিটি ফর দ্য কনকোয়েস্ট অব ক্যান্সার”-এর ওয়াশিংটন পোস্ট এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় তরফে পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন দিলেন। আমরা কনকোয়েস্ট শব্দটি নজরে রাখব। একদিকে যুদ্ধ (war on cancer) অন্যদিকে যুদ্ধজয় করে দখল করা (conquest) — এরকম সামরিক শব্দসম্ভার দিয়ে গড়ে উঠতে লাগল “ক্যান্সার”-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের দ্যোতনা। সত্যিই কি কোনও অসুখের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা যায়? তাহলে তো যে মানুষটি রোগ বহন করছে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়! বাস্তবেও সেটাই হয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় থেকে ক্যান্সারকে নিয়ে একটি শত্রু/একটি রোগ (USSR/cancer)-এর মডেল ব্যর্থ হলে দেখা গেল কোন নির্দিষ্ট উৎস অধরা থাকছে, অধরা থাকছে পেছনে কোন রাষ্ট্রের ভূমিকা। মজার ব্যাপার হল, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে সোভিয়েত প্রভাবকে তুলনা করা হচ্ছিল ক্যান্সারের মেটাস্টেসিসের সঙ্গে। যদিও বিশ্বব্যাপী মুক্ত পুঁজির ফেরিওয়ালা আমেরিকার প্রভুত্বের কিংবা দেশে দেশে অন্তর্ঘাতের প্রসঙ্গের জন্য কোন মেটাফর ব্যবহার করা হয়নি 1
এ মুহূর্তে ক্যানসার ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসা প্রতি বছরে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের (এর মধ্যে ক্যান্সারের ওষুধের ব্যবসা ১৮২ বিলিয়ন ডলার, ক্যান্সার চিকিৎসা ও রোগনির্ণয়ের ব্যবসার পরিমাণ প্রায় ২৪০ বিলিয়ন ডলার এবং বাকিটা আনুষঙ্গিক খরচ)। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অতিবৃহৎ দৈত্যসদৃশ কোম্পানির মুনাফা, এবং সেই মুনাফার মৃগয়াক্ষেত্র সমগ্র পৃথিবী জুড়ে বিস্তৃত। ফলে ক্যানসার শুধুমাত্র একটি আধুনিকতার অসুখ হয়ে থাকল না, এর সঙ্গে জড়িয়ে গেল বৃহৎ পুঁজি, আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য রাজনীতি এবং অত্যন্ত দামী নিত্য-নতুন প্রযুক্তির আন্তর্জাতিক বাজারের বিস্তারের প্রসঙ্গ।
আরেকটি গ্রাফ দেখা যাক।
(Allied Market Research থেকে সংগৃহীত)
এ প্রসঙ্গে বিস্তারে যাবার আগে ক্যানসারের বায়োলজি নিয়ে অল্প কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। এটুকু বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হবার কোনও প্রয়োজন নেই। একটু খোলা চোখে ভালো করে দেখতে হবে, মন দিয়ে বুঝতে হবে শুধু।
(Douglas A. Hanahan and Robert A. Weinberg, “Hallmarks of Cancer: The Next Generation”, Cell, 4 March 2011, pp. 646-674)
উপরের ছবিতে একটি স্বাভাবিক কোষ কীভাবে ক্যানসার কোষে পরিণত হয় সেটা বুঝিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কার্যত একটি স্বাভাবিক কোষের নিয়মকানুন অনুযায়ী ক্যানসার কোষ এর কার্যকলাপ চালায়, যদিও সমস্ত কার্যকলাপকে নিজের মতো করে পরিবর্তিত করে নিয়ে। স্বাধীন সম্রাটের মতো এর বেঁচে থাকা। মোটের ওপরে ৬টি মৌলিক পরিবর্তন ঘটে একটি ক্যানসার কোষে— (১) নিজেই নিজের বিভাজনের জন্য সিগন্যাল তৈরি করতে পারে, স্বাভাবিক কোষের মতো বাইরের সিগন্যালের ওপরে নির্ভর করে না; (২) স্বাভাবিক কোষে যেমন বাইরের থেকে বৃদ্ধি আটকে দেওয়ার সিগন্যাল এসে কাজ করতে পারে এক্ষেত্রে তা পারে না; (৩) সীমাহীনভাবে নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে যা একটি স্বাভাবিক কোষ পারে না; (৪) স্বাভাবিক কোষে programmed cell death বা বিধি-নিয়ন্ত্রিতভাবে মৃত্যু ঘটে (apoptosis), ক্যানসার কোষ একে নিখুঁতভাবে এড়িয়ে যেতে পারে; (৫) ধারাবাহিকভাবে নতুন রক্ত-সংবাহী নালী তৈরি করে চলে (angiogenesis), যা স্বাভাবিক কোষে প্রায় একেবারেই অনুপস্থিত; এবং (৬) উৎপত্তিস্থল থেকে অনেক দূরে এর উপনিবেশ তৈরি করতে পারে যে ক্ষমতা স্বাভাবিক কোষের নেই। একে আমরা চিকিৎসার পরিভাষায় metastasis বলে থাকি। এবং এসব পরিবর্তনগুলো স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার মাঝে ঘটে, ঘটার পরে প্যাথলজি হয়।
এবার আমার নিচের ছবিটি দেখে নিই।
(Douglas A. Hanahan and Robert A. Weinberg, পূর্বোক্ত প্রবন্ধ)
এখনও অবধি আমাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণা যে স্তরে রয়েছে তাতে আমরা এই সমগ্র প্রক্রিয়াকে যথেষ্ট অনুধাবন করতে পারিনি। বরঞ্চ বলা ভালো খুব-ই সামান্য একটি অংশকে বুঝে উঠতে পেরেছি, বা অদূর ভবিষ্যতে কত দূর বুঝে উঠতে পারব এ নিয়ে বিলক্ষণ সন্দেহ আছে। এখনও অবধি আমরা প্রায় একেবারেই বুঝে উঠতে পারিনি যে মেটাস্টেসিস কিভাবে ঘটে, কখন বা কোন পর্যায়ে ঘটে এবং একে বোঝার মতো কোনও মার্কার আছে কি না।
কিছুদিন আগে (২ জানুয়ারি, ২০১৫) একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল বিজ্ঞানী মহলে মান্য পত্রিকা Science-এ। প্রবন্ধের শিরোনাম— “Variation in cancer risk among tisues can be explained by the number of stem cell divisions”। তর্কযোগ্যভাবে, প্রবন্ধের লেখকদ্বয় ক্রিস্টিয়ান তোমাসেত্তি এবং বার্ট ভোগেলস্টেইন দাবী করেছেন— “এসমস্ত দেখায় যে কোষে ক্যান্সার ‘রিস্কের’ মাত্র ১/৩ ভাগ আরোপ করা যায় পরিবেশতগ প্রভাব বা জিনগত উত্তরাধিকার। অধিকাংশই “ব্যাড লাক”-এর জন্য— অর্থাৎ স্বাভাবিক ডিএনএ-র রেপ্লিকেশনের সময় জিনের এলোপাথারি মিউটেশনের জন্য। এ বিষয়টি কেবলমাত্র রোগটিকে বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা নয়, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য নতুন স্ট্র্যাটেজি তৈরির জন্যও প্রয়োজনীয়।”
এখানে শেষ নয়। আরও সাম্প্রতিক সময়ে, ২৪শে মার্চ, ২০১৭, সায়ান্স পত্রিকাতেই প্রকাশিত হল Genes, environment, and “bad luck” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ। গবেষকদের নাম Martin A. Nowak এবং Bartlomiej Waclaw। এ নিয়ে ২৪শে মার্চই সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকায় দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখা হল— Most Cancer Cases Arise from “Bad Luck”। এ প্রবন্ধে জানানো হল, এতদিন গবেষকেরা যে গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশ এবং জিনের গুরুত্ব ভেবেছেন ঘটনা সম্ভবত সেরকম নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জিনের মিউটেশন ক্যান্সারের জন্য দায়ী। তবে কার ক্ষেত্রে কীভাবে হবে তা আগাম বলা যাবে না।
আমাদের এই বিশেষ রোগটি সম্পর্কে এত অসম্পূর্ণ বোধ সত্ত্বেও কোনও কিছুর পরোয়া না করে তৈরি হয়েছে একটি পরিপূর্ণ বাণিজ্য জগৎ, ক্যানসারের জন্য একটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রভুত্বকারী বয়ান ও ভাষ্য, এক ভিন্ন ধরনের রাজনীতি— ক্যানসারের রাজনীতি। অদ্ভুত ব্যাপার হল যে এত কম জানা আর কোনও রোগ নিয়ে এত বেশি টাকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আর হয়নি। এবং এ বাণিজ্যে শুধু অতি বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানি শুধু নয়, রাষ্ট্র-ও পূর্ণত জড়িয়ে পড়ে। ক্যানসারের চিকিৎসা, অভিমুখ ও নিত্যনতুন বয়ান নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা বিভাজন বিভিন্ন সময়েই সুস্পষ্ট চেহারা নেয়। কিন্তু ক্যানসার, আমরা পরে বারে বারে দেখব, আমেরিকার নতুন মেডিক্যাল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল hegemony তথা বিজ্ঞানের ও চিকিৎসার hegemony তৈরির একটি উৎপাদন যন্ত্রও বটে। মাইকেল কোলম্যান তাঁর “The war on cancer and the influence of the medical-industrial complex”। গবেষণাপত্রে ৭৭ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্টে দেখিয়েছেন— “রিপোর্টটি সারভাইভাল বা জীবৎকালের হিসেবের ক্ষেত্রে একটি নতুন এবং ভুল পদ্ধতি নিয়েছে। এর মধ্যে ১২টি দেশ রয়েছে যেগুলোতে কোনও তথ্যেরই অস্তিত্ব নেই। এরপরে ১৯৯০ সালে ডায়াগনোসিস হওয়া জাতীয়ক্ষত্রে রোগীর “সারভাইভাল”-কে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ২০০২ সালে যেসব ওষুধ পাওয়া যায় তার ফলাফলের সঙ্গে (এ ওষুধগুলোর মধ্যে বেশ কিছুর লাইসেন্স ১৯৯০-এর দশকের পরে আর রিনিউ করাই হয়নি)।”
ইউরোপ ঘুরে আসার পরে এবং ওখানে ক্যানসার চিকিৎসার সুযোগ সুবিধে দেখার পরে কার্ল ভেগতলিন (Carl Voegtlin) ১৯৩৭ সালের ৮ই অক্টোবর এক চিঠিতে “comprehensive attack on the cancer problem which today does not exist anywhere in the world” অর্থাৎ “আজকের পৃথিবীতে কোথাও বিরাজ করে না ক্যানসারের বিরুদ্ধে এমন একটি সর্বাঙ্গীন আক্রমণ”-এর জন্য সুপারিশ করেছিলেন। ফলে, বিশেষত ক্যানসার চিকিৎসার ক্ষেত্রে, আমেরিকা হয়ে উঠবে নেতা এবং “was to assume the world leadership in the field.”[4]
প্রসঙ্গত, প্রায় চার দশক আগে অসুস্থতা তথা ক্যানসার নিয়ে বলতে গিয়ে সুসান সনট্যাগ বলেছিলেন— অসুস্থতা জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক, ক্লেশদায়ী নাগরিকত্ব। যে মানুষই জন্মেছে সে দুধরনের নাগরিকত্ব রক্ষা করে— একটি সুস্থতার রাজত্ব, আরেকটি অসুস্থতার।[5]
নাগরিকত্বের এই দ্বিত্বতা ভেবে দেখতে আমরা প্রায়শই ভুল করি। এবং, লক্ষণীয়ভাবে, ভুলে যাওয়ার এ ছিদ্রপথ দিয়ে অনেক স্বাভাবিক ঘটনা (সে দেহ বা সমাজ যাই হোক না কেন) আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও রাজনীতির যাদুদণ্ডে অ-স্বাভাবিক হয়ে ওঠে— ক্যানসার যার একটি প্রজ্জ্বলন্ত উদাহরণ। আরেকটি বিষয়ও আমরা ভেবে দেখব— ক্যানসার একেবারে আধুনিক সময়ের রোগ, “আধুনিকতা”-র রোগ। এজন্য ক্যানসারের “citizenship”-এর ভাবনার সঙ্গে লিঙ্গ-সম্পর্কের ভাবনা, নাগরিক আন্দোলনের প্রসঙ্গ, রাষ্ট্র-NGO-প্রশাসন-বহুজাতিক কোম্পানি যোগসূত্র ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় অণ্বিত হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে প্রধানত রাষ্ট্রপন্থী একটি অবস্থান থেকে লেখা হলেও সিদ্ধার্থ মুখার্জির পূর্বোল্লেখিত পুস্তক The Emperor of All Maladies-এ এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ আছে। রাষ্ট্র-NGO-প্রশাসন যোগসূত্রের একটি পরিচিত আমেরিকান উদ্যোগ হল Jimmy Fund। ১৯৪৮ সালে Jimmy Fund ২৩১,০০০ ডলার তুলেছিল লিউকেমিয়ার চিকিৎসা ও গবেষণার লক্ষ্যে। ১৯৪৪-এ ম্যানহাট্টান প্রজেক্ট-এর শুধুমাত্র Oak Ridge কেন্দ্রে প্রতি মাসে খরচ করা হত ১০০ মিলিয়ন ডলার এবং ১৯৪৮ সালে কোকা কোলা খাওয়ার জন্য আমেরিকানরা খরচ করেছে ১২৬ মিলিয়ন ডলার। এ প্রেক্ষিতে, সিদ্ধার্থ মুখার্জি জানাচ্ছেন, “the $231,000 raised by the Jimmy Fund was an impressive, but still modest sum.” অর্থাৎ, ক্যানসারের বিরুদ্ধে “যুদ্ধে” ফ্রন্ট-লাইন ক্যাপ্টেন হয়ে ঐতিহাসিক আবির্ভাব ঘটতে শুরু করল আমেরিকার রাষ্ট্র, প্রশাসন ও জনমতকে সাথী করে।
আমরা এবার ১৯৩০-এর দশক থেকে ১৯৭১ সাল ও তার পরবর্তী সময়ের ক্যানসার গবেষণা ও এর ভৌগোলিক বিস্তৃতি নিয়ে কথা বলব। ১৯৪৫ সাল হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক বিস্ফোরণের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে। কিন্তু আমেরিকার বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে ১৯৪৫ সালের আরেকটি ভিন্ন গুরুত্ব আছে। আমাদের আলোচনার জন্য পারমাণবিক বিস্ফোরণের চেয়েও বেশি জরুরি কীভাবে আমেরিকার বিজ্ঞানচর্চার নতুন অভিমুখ নির্ধারিত হল এসময়ে সেটা বোঝা। এখানে প্রসঙ্গত বলা যায়, আমেরিকান সার্জন হ্যালস্টেড-এর রোগীর পক্ষে ভয়াবহ radical mastectomy প্রায় ৭০ বছর ধরে ব্রেস্ট ক্যানসারের ক্ষেত্রে প্রায় একমাত্র চিকিৎসা হিসেবে রাজকীয়ভাবে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। এর একটা সম্ভাব্য বোধগম্য কারণ হতে পারে, ইউরোপের হাতে তত্ত্ব থাকলেও আমেরিকার আছে নিখুঁত টেকনিক বা সার্জারি— একে প্রতিষ্ঠা করা। ফলে ক্যানসার গবেষণার তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে ইউরোপ এগিয়ে আছে এ ধরনের বোধকে প্রতিহত করা যেতে পারে। ১৯৮৩ সালে, একটি গবেষণা পত্রে হ্যালস্টেড-এর radical mastectomy নিয়ে আলোচনা হয়েছে।[6]
এ গবেষণাপত্রে ৩১১টি সার্জিকাল কেস বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে যে radical mastectomy-র ফলে ক্যানসারে মৃত্যুর ক্ষেত্রে আদৌ কোনও পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না, radical mastectomy কিংবা ভিন্নতর কোনও সার্জিকাল চিকিৎসার মাঝে ফলাফলের দিক থেকে কার্যত কোনও পার্থক্য নেই। ১৯৮৫-র এক গবেষণাপত্রে জন কেয়ার্ন্স জানিয়েছিলেন সার্জারিতে সাফল্যের হার ৫০ শতাংশেরও কম।[7]
১৯৪৫ সালে আমেরিকার অফিস অব দ্য রিসার্চ অ্যন্ড ডেভেলপমেন্ট-এর অধিকর্তা ভ্যানেভার বুশ (Vannevar Bush) আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে একটি রিপোর্ট জমা দিলেন— Science: The Endless Frontier। এ রিপোর্টে তিনি জানালেন যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধবাজ সৈনিকদের মৃত্যু হার ছিল প্রতি হাজারে ১৪.১, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সে হার কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি হাজারে ০.৬ জন। ফলে বুশের মতে ১৯৪৫ সাল হচ্ছে সে সময় যখন “The War Against Disease” ঘোষণা করতে হবে। বুশের বয়ানে, “যুদ্ধের সময়ে মেডিসিনের নজরকাড়া অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে কারণ বিজ্ঞানের অসংখ্য জগতে বিপুল পরিমাণে মৌলিক গবেষণাকর্ম যুদ্ধের আগেই ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হয়ে আমাদের কাছে ছিল।”[8]
এই রিপোর্টের উল্লেখযোগ্য অংশটি হল, ২য় বিশ্বযুদ্ধের আগে মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার জগতে যে জ্ঞান ও তথ্য পুঞ্জীভূত হয়েছে তার ফসল মিলেছে যুদ্ধবাজ সৈনিকদের মৃত্যুহার কমার মধ্যে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল যে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি বা বায়োলজির জগতে প্রায় সমস্ত মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছিলো ইউরোপীয় ভূখণ্ডে। একের পরে এক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। প্রথমে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এর ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে যে বিশেষ প্রবন্ধটি লেখা হয়েছিল— Two Hundred Years of Cancer Research— সেখান থেকে উল্লেখ করি, তথ্য হিসেবে একটু ওজনদার হবে। ১৮৬৩ সালে জার্মান বিজ্ঞানী Rudolf Virchow আবিষ্কার করলেন ক্যানসার কোনও “ব্ল্যাক হিউমার” বা “কালো পিত্ত” থেকে হয় না, হয় কোষ থেকে (cellular origin of cancer); ১৮৬৯ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী ও প্যাথলজিস্ট স্টিফেন প্যাজেট প্রথম সূত্রায়িত করলেন “seed and soil” তত্ত্ব অর্থাৎ এক জায়গার ক্যানসারের বীজ আমাদের চিকিৎসার তোয়াক্কা না করে ছড়িয়ে পড়ে দূরের মাটিতে তথা অন্য কোন দেহাংশে এবং এর ফলে রোগটির মেটাস্টেসিস ঘটে; ১৮৯৫ সালে জার্মান পদার্থ বিজ্ঞানী রন্টজেন আবিষ্কার করলেন এক্স-রে; ১৯১৪ সালে আরেকজন জার্মান জীববিজ্ঞানী থিওডর বোভেরি আবিষ্কার করলেন যে ক্যানসারের উদ্ভবের ক্ষেত্রে ক্রোমোজোমের মিউটেশন বা বিশেষ ধরনের রূপান্তর ঘটে। থিওডোর বোভেরির ৮৪ পৃষ্ঠার সুদীর্ঘ গবেষণা পত্রের শিরোনাম ছিল— Concerning the Origin of Malignant Tumour। এছাড়াও এখন যাকে কেমোথেরাপি বলে তারও প্রাথমিক প্রয়োগ এবং সূত্রায়ন হয়েছিল জার্মানিতে পল আরলিখ (Paul Ehrlich)-এর হাত ধরে।
১৯৩০-এর দশকের পর থেকে ইউরোপে একদিকে বিরাট মন্দা বা Great Depression ও হিটলারের অভ্যুত্থান, অন্য দিকে ২য় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ সামাজিক অভিঘাতের ফলে ইউরোপের বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য ও শিল্পের শ্রেষ্ঠ মেধারা আমেরিকার আপাত-শান্তিপূর্ণ সামাজিক ও ল্যাবরেটরি গবেষণার জগতে প্রবেশ করলেন। আমেরিকার New Deal অর্থনীতিও এসময়ের রাষ্ট্রিক অর্থনীতি হয়ে ওঠে। এবং এসময় দিয়েই আমেরিকায় পারমাণবিক বিস্ফোরণের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল, যদিও মৌলিক পরমাণু বিজ্ঞানের পূর্ববর্তী পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল ইউরোপের মাটিতে।
এ প্রেক্ষিতে ঠান্ডা মাথায় ভাবলে ঐতিহাসিক হিসেব-নিকেশ কী দাঁড়াবে? আমেরিকার কাছে রইল মেধার নক্ষত্রপুঞ্জ, অপরিমেয় অর্থ, নিজের ভূখণ্ডে একটিও যুদ্ধ ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় হয়নি বলে সামাজিকভাবে অনেক বেশি সুস্থিত অবস্থা, সাম্রাজ্যবাদের নতুন অধীশ্বর হিসেবে সমগ্র পৃথিবীতে হিটলারের গণতান্ত্রিক মুখ এবং রেপ্লিকা হিসেবে সাম্রাজ্য বিস্তার করা, এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের নতুন ধরন যত না সামরিক তার চাইতে বেশি অর্থনৈতিক। বিজ্ঞানের দিক থেকে ভাবলে এদের কাছে থাকল উন্নত প্রযুক্তি, কিন্তু নতুন তত্ত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ ক্যানসার একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অসুখ হিসেবে উঠে এসেছে ১৯৩০-এর দশক থেকেই। খোদ প্রেসিডেন্টের (ফোর্ড) স্ত্রী আক্রান্ত হচ্ছেন ব্রেস্ট ক্যানসারে। ১৯৩৭-এ তৈরি হয়েছে National Cancer Institute (NCI). আমরা আগে যে বিষয়টি বলেছি— আমেরিকা কীভাবে বিশেষত ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই-এ আন্তর্জাতিকভাবে নেতৃত্বে এল— সেটা আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে যদি আমরা সেসময়ের সংবাদপত্রগুলোর দিকে একটু চোখ বোলাই। তিনটি তৎকালীন বিখ্যাত সংবাদপত্র ছিল Time, Life এবং Fortune। Time-এর সার্কুলেশন ছিল ৬,১৬,০০০; Life-এর ৮০০,০০০ এবং Fortune-এর ১,৪৮,০০০। সবমিলিয়ে প্রায় ১৬ লক্ষ সংখ্যা বিভিন্ন স্বরে ও ভঙ্গিতে একটিমাত্র বিষয় নিয়ে লিখতে ও জনমত তৈরি করতে শুরু করল। Fortune (মার্চ ১৯৩৭) লিখল— “Cancer: The Great Darkness”, Life (মার্চ ১, ১৯৩৭) লিখল— U.S. Science Wars Against An Unknown Enemy: Cancer”, Time (মার্চ ২৩, ১৯৩৭) লিখল— “Medicine: Millions for Cancer”। Fortune পত্রিকার প্রবন্ধেটিতে (“Cancer: The Great Darkness”) নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছিল ক্যানসার যতটা মেডিসিনের ততটাই রাজনীতির।
অর্থাৎ সবমিলিয়ে এটা যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে আমেরিকার নেতৃত্বে নতুন করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা অসুখ ক্যানসার নিয়ে collective consciousness তথা সামগ্রিক সচেতনতা তৈরির চেষ্টা পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়ে গেল। উল্লেখযোগ্য হল, এ ক্ষেত্রে সংবাদ ও অন্যান্য মিডিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করল। ২০০৪ সালের একটি হিসেব বলে, আমেরিকার ওপরের দিকের ৫টি নিউজ নেটওয়ার্ক বিজ্ঞাপনের জন্য ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বছরে ৫.১ বিলিয়ন ডলার আয় করে[9] ।
এবার বলুন, এ সমস্ত সংবাদপত্র ও অন্যান্য মিডিয়া ওষুধ সংক্রান্ত বিষয়ে কাদের পক্ষে এবং কীভাবে লিখতে পারে?
এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে বিপুল পারমাণবিক কর্মকাণ্ডের অনুসারী হিসেবে যে সমস্ত ভয়ঙ্কর ব্যয়-সাপেক্ষ অতি উন্নত প্রযুক্তি (যেমন সাইক্লোট্রোন, সিটি স্ক্যানার বা নিউক্লিয়ার অ্যাক্সিলারেটর) আমেরিকার হাতে এসে পড়েছে সেগুলোকে যদি আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করা না যায় তাহলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ধনে প্রাণে মারা পড়বে। এজন্য এমন একটি “হাই-টেক” রোগের সন্ধান ও বিপণন ঐতিহাসিকভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠল যা এ সমস্ত চাহিদাগুলোকে একসঙ্গে মেটাতে পারে। এবং ক্যানসার হল সেই বিশেষ রোগ যার সঙ্গে আমেরিকার আধুনিক বৈজ্ঞানিক সত্তা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। আবার এ রোগকে দেহের মাঝে দেহের গোড়ার নিয়ম মেনে চলা “অপর” হিসেবে দেখলেও চলবে না, যেমনটা চলে না গুয়ান্তানামো বে-র বন্দিদের ক্ষেত্রে। দেহের “অপর”কে মানিয়ে নেওয়ার কোনও প্রশ্ন উচ্চারণ করা অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ, এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ-ই ঘোষণা (War Against Cancer) করতে হবে। এমনকি ক্যানসার গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক সমাজ নিয়ে লেখা বিজ্ঞানীদের লেখা প্রবন্ধেও “Making better rifles and bullets”-এর মতো প্রসঙ্গ ক্রমাগত স্থান পেতে থাকল।[10] বায়োলজির জগতে আক্রমণ ও যুদ্ধের মেটাফর উৎপাদন করা তো শুরুই হয়ে গিয়েছিল ১৯শ শতকের শেষভাগ থেকে।[11] এখানে আমাদের অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে ২য় বিশযুদ্ধে ব্যবহৃত ভয়ঙ্কর মাস্টার্ড গ্যাস বাচ্চাদের লিউকেমিয়ার এবং লিম্ফোমার চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করেছিলেন দুজন বিজ্ঞানী, যাঁদের লেখা ফার্মাকোলজির পাঠ্যপুস্তক ডাক্তারি ছাত্রমাত্রেই জানে— গুডম্যান এবং গিলম্যান। এ বিষয়ে ১৯৪৮ সালে নেচার পত্রিকায় গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল — “Effects upon tumours of Various Haloalkylarylamines”। ক্যান্সারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নতুন প্রযুক্তি হল কোবাল্ট-৬০ রেডিওথেরাপি — একেবারেই পারমাণবিক প্রযুক্তির উপজাত।
কৌতুকপ্রদ হল ইউনিভের্সিটি অব টরোন্টো ম্যাগাজিনের ১৩ জানুয়ারি, ২০১৭-তে প্রকাশিত একটি মূল প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল “This “Bomber” Actually Saved Countless Lives”। কানাডার নামী চিকিৎসক হ্যারল্ড জনস প্রথম কোবাল্ট দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন। লেখা হল, “কোবাল্ট বোমা”-র (যা একটি নিউক্লীয় তেজস্ক্রিয়তা ব্যবহারের প্রযুক্তি) আবিষ্কারক ডঃ জোনস জরায়ু মুখ, মূত্রথলি এবং প্রোস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটালেন। পৃথিবী জুড়ে কোবাল্ট-৬০ থেরাপির সাহায্যে লক্ষকোটি মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। আরও মজার যে কোবাল্ট থেরাপি দেওয়ার সময় ডঃ জোনসের নিজের মনে হত যেন ইউ-২ বোমারু বিমানের ককপিটে বসে আছেন। ক্যান্সার নিয়ে যুদ্ধ ছাড়া আর কোনও মেটাফরই বুঝি তৈরি হয়নি!
এ পটভূমিতে ২২শে জানুয়ারি ১৯৭১ সালে ক্যানসারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের সে ঐতিহাসিক ঘোষণা করলেন নিক্সন — “সে পরম মুহূর্ত সমাগত যখন যে ধরনের সংহত প্রচেষ্টা পরমাণুর কেন্দ্রের বিভাজন ঘটিয়েছে বা মানুষকে চাঁদে পাঠিয়েছে সে সমস্ত প্রচেষ্টার গতিমুখ এবার নির্দিষ্ট করতে হবে এই ভয়ঙ্কর রোগের বিরুদ্ধে জয়ী হবার জন্য। চলুন, এ লক্ষ্যে সফল হবার জন্য সামগ্রিক ও সর্বাঙ্গীন জাতীয় অঙ্গীকার করি আমরা।” (নজরটান আমার)। এবং এর জন্য প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ করা হয়েছিল ১০০ মিলিয়ন ডলার। এর আগে Science: The Endless Frontier-এর ১৯৬০ সালের সংস্করণে অ্যালান ওয়াটারম্যান জানিয়েছিলেন আমেরিকার বিজ্ঞানচর্চা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছে কোরিয়ার যুদ্ধ, “ঠান্ডা যুদ্ধ”, মিসাইল ও উপগ্রহের প্রতিযোগিতা, সোভিয়েট রাশিয়ার প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ এবং দ্রুত ধাবমান মহাকাশ গবেষণা-র দ্বারা। অত্যন্ত প্রাঞ্জল স্বীকারোক্তি। আমেরিকার বিজ্ঞানচর্চার leit motif খুব স্পষ্ট হয়ে যায়। এটা নয় যে আগের থেকে সামগ্রিক চিত্রের খুব কিছু উন্নতি হয়েছিল বলে এরকম উল্লসিত অবস্থার দিকে মোড় ঘুরল, বরঞ্চ এটা বলা ভালো যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আমেরিকার মনোভাব অনেক বেশি আশাবাদী ছিল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ব্যাপারে জনতার চালু বিশ্বাস এতটাই গভীর ছিল যে চিন্তা-সমৃদ্ধ বিরুদ্ধ মতামত বা বা সংশয়বার্তা কিংবা সতর্কবাণী পূর্ণত নস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল। “The turn to cheer was not because the picture was improving. Rather, the mood of post-war America was optimistic. Popular belief in technology and scientific progress overwhelmed thoughtful counter-messages based in scepticism and caution.”[12]
এ মানসিকতার একটি নমুনা হল যখন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ১,২৫০,০০০ ভোল্টের এক্স-রে মেশিন বসেছে, পূর্বোক্ত Life পত্রিকা জানাল এটা ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে “biggest gun in the war”. সাইক্লোট্রন-এর আবিষ্কর্তা আর্নেস্ট লরেন্স জানালেন যে ক্যানসার কোষের ওপরে বোমা মারার ক্ষেত্রে সাইক্লোট্রন দিয়ে পাঠানো তেজষ্ক্রিয় পদার্থের পরমাণু অনেক ভালো কাজ করবে।[13]
যে কোনও সাধারণ শিক্ষিত মানুষের ভয় লাগবে! সেল বায়োলজির এখনও অব্দি সামান্য বুঝে ক্রমাগত দেহের অভ্যন্তরকে তালিবানি বা ইরাকি বা গাজার মানুষদের মতো নির্বিচারে আক্রমণ করে যাওয়া ক্যানসার মেডিসিন বা অঙ্কোলজি-র একমাত্র লক্ষ হয়ে দাঁড়াল। ১৯৭৫ সাল নাগাদ ভিয়েতনাম যুদ্ধের মেটাফর প্রবেশ করতে শুরু করল ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বোঝাতে গিয়ে— the war in cancer is a medical Vietnam।[14]
“Hallmarks of Cancer” গবেষণা পত্রের লেখক বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী ডগলাস হানাহান (যাঁকে আমরা প্রবন্ধের শুরুতেই উদ্ধৃত করেছি) ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে জানাচ্ছেন – “অধিকাংশ লক্ষ্য–নির্দিষ্ট চিকিৎসা নিতান্ত সাময়িকভাবে কার্যকরী; প্রাথমিক কিছু ক্ষয়-ক্ষতি সামলে নিয়ে ক্যানসার নিজেকে নতুন চিকিৎসার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয় এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে কিংবা চিকিৎসাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে পারে। ফলে নতুন জীবনীশক্তি নিয়ে রোগের অগ্রগতি পুনরজ্জীবিত হয়” সুইৎজারল্যান্ড-এর লুগানো-তে ২০১২-র শেষভাগে World Oncology Forum-এর সম্মেলন হয়েছিলো। সে সম্মেলনে ৪০ বছর ধরে ক্যানসারের বিরুদ্ধে লাগাতার যুদ্ধ ঘোষণার পরে প্রশ্ন উঠেছিলো “are we winning”? সাধারণভাবে সম্মেলনের সংক্ষিপ্ত জবাব ছিলো – NO. (Hanahan, “Rethinking the war on cancer”, Lancet, 2014)।
এরকমটাই হবার কথা ছিলো। আমেরিকার দম্ভ, আধুনিক হিটলারের ধরণে অর্থনীতিতে, সংস্কৃতিতে, চেতনায় ও social psyche-র জগতে সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তকে দখল করার উদগ্র বাসনা ও ইতিহাসের একমাত্র চালিকা শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার অত্যুগ্র বাসনা অনিবার্যভাবে এ পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে। ১৯৭৯ সালেই আমেরিকার NCI-এর একদল প্রথম সারির বিজ্ঞানী পরম খেদ নিয়ে বলেছিলেন – আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কেবলমাত্র নিজের অর্থনৈতিক ক্ষমতার ব্যাপারে অতি-আত্মবিশ্বাসী একটি সমাজের অর্থনৈতিক, সামরিক এবং চিকিৎসার জগতে আপন নেতৃত্ব হারানোর ভয় ও হতাশাবোধ একটি লাগামহীন খরচের যুগের জন্ম দিল। এ যুগ হয়ে উঠলো ক্যানসারের ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত চিন্তার দৈন্য এবং চিন্তাহীন পরিকল্পনার একটি যুগ। (The era of lavish spending, born out of the affluence of a society overconfident of its economic power and spurred by the sheer desperation and fear of losing political, military, and medical world leadership, has been an era bare of rational thinking and planning in matters of human cancer.) (Patterson, The Dread Disease, p. 253, নজরটান আমার।)
আরেকটা তথ্য এখানে প্রাসঙ্গিক। ১৯৮০-র দশকে আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে সাধারণ মানুষের ক্যানসারকে আগাম নির্ণয় ও চিকিৎসা করার জন্য যত সংখ্যক কেন্দ্র ছিল, রাশিয়ায় তার চেয়ে অনেক বেশি ক্যানসার কেন্দ্র ছিল। রোজ কুশনার আমেরিকায় ব্রেস্ট ক্যান্সার অ্যাডভাইসরি সেন্টার-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং অধিকর্তা ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত বই Breast Cancer: A Personal History and Investigative Report এবং তিনি নিজেও ব্রেস্ট ক্যানসারের রোগী ছিলেন, যেমন ছিলেন Silent Spring-এর সুবিদিত লেখিকা র্যাচেল কারসন। রোজ কুশনার তাঁর আমেরিকান চিকিৎসকের কাছে রাশিয়ার প্রতিতুলনায় আমেরিকার অবস্থা নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন। চিকিৎসক ছেলেটি প্রত্যুত্তরে অট্টহাস্যে জানিয়েছিল অন্য দেশের বিশেষত্ব নিয়ে সে আদৌ ভাবিত নয়। তার সংক্ষিপ্ত জবাব ছিল— আমাদের আমেরিকায় যা আছে সেটাই সর্বশ্রেষ্ঠ। এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। (What we have in the United States is the best. No question.) আরেকটি ঊল্লেখ্যগয বই হল এলেন লিওপোল্ড-এর A Darker Ribbon: Breast Cancer, Women, and the Doctors in the Twentieth Century ।
আমেরিকান দম্ভের এর চেয়ে ভালো প্রকাশ আর কী হতে পারে! কুশনার মন্তব্য করছেন— “Perhaps we do not have enough oncologists in the United States to handle all our cancer patients.” (Ibid, p. 335)
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন
১৯৭৫ সালেই মেডিক্যাল সাংবাদিক ড্যানিয়েল গ্রিনবার্গ জানালেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতোই ক্যানসারের যুদ্ধে হেরে যাওয়াকে ক্রমাগত আড়াল করা চলছে — “It’s like Vietnam. Only when the public realized that things were going badly did pressure build to get out”। তিনি আরও জানালেন, ১৯৭৩ সালে বিখ্যাত নোবেল বিজয়ী রসায়নবিদ ও বিজ্ঞানী লাইনাস পাওলিং (Linus Pauling) NCI-এর কাছে প্রস্তাব রাখেন যে ক্যানসার গবেষণার জন্য বরাদ্দ টাকার একটি ছোট অংশ যেন “unconventional research”-এর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়। তাঁর প্রস্তাবে কেউ কর্ণপাত করেনি। আরেকটি মনোযোগ দেবার মতো ঘটনা হল, সে সময়ে ক্যালিফরনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের James Enstrom জানিয়েছিলেন খ্রিস্টানদের এক বিশেষ সম্প্রদায় “Mormon”-দের মাঝে নিজস্ব ধর্মীয় রীতি অনুসারী জীবনযাত্রার জন্য ক্যানসার-জনিত মৃত্যুহার লক্ষণীয়ভাবে কম। এ নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য এন্সট্রম কিছু অর্থ সংস্থান চেয়েছিলেন। সে প্রস্তাবও তৎক্ষণাৎ নাকচ হয়। গ্রিনবার্গ-এর মনে হয়েছিল যে এর কারণ হল গোঁড়ামো এবং “The Closed Mind of Medicine”.[15]
১৯৭৬ সালে আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি প্রকাশ করল — The Hopeful Side of Cancer. এর প্রথম বাক্যটি ছিল — Cancer is one of the most curable diseases in this country। অথচ এর এক বছর আগে গ্রিনবার্গ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন ৭৮ শতাংশ ক্যানসারের ক্ষেত্রে অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয় না, এবং সর্বোপরি, National Cancer Act, 1971 একটি এক-মাত্রিক আমলাতন্ত্রের জন্ম দিয়েছে। এদের ভিন্নতর কোনও ভাবনা নেই, এরা ক্যানসারের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না।[16]
ক্যানসারের চিকিৎসার নতুন নতুন ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল নিয়ে হাড় হিম করা সব তথ্য আছে গবেষকদের সংগ্রহে। Non-small-cell lung cancer-এর জন্য “আবিষ্কৃত” ওষুধ Geftinib (ব্র্যান্ড নাম Iressa) হল অতি বৃহৎ ওষুধ কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা (AstraZeneca)-র আবিষ্কার। কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় এ ওষুধ দিয়ে। কিন্তু অসহায় রোগীর অর্থ ধ্বংস ছাড়া শেষ অব্দি আর কিছু হয় কি এ ওষুধে? হয়তো দেখা গেল ৬ মাস বেঁচেছে। এ ওষুধটি ছাড়া বাঁচত না, একথা কে জোর দিয়ে বলবে? চিকিৎসা বিজ্ঞানের বর্তমান স্তরে একথা দায়িত্ব নিয়ে বলার মতো সময় আসেনি এখনও। সেরকম কোনও নির্ভরযোগ্য trial report নেই। এ ওষুধটির Phase I Trial-এ আমেরিকায় যেসব মানুষ অর্থহীন, ইন্সিউরেন্স-এর সমস্ত সুযোগ-সুবিধে শূণ্য এবং চালচুলোহীন, বিশেষ করে মেক্সিকো ও লাতিন আমেরিকার বুভুক্ষু মানুষকে “paid volunteers” হিসেবে নেওয়া হয়। এদের দৈনিক রোজগার ২০০ থেকে ৪০০ ডলার। এরা এতেই পরম খুশি। অতি বৃহৎ ওষুধ কোম্পানিও খুশি এত কম পয়সায় কাজটি করিয়ে নেওয়া যাচ্ছে।[17]
নতুন ওষুধ নিয়ে যেসব গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয় তার মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশকে পাথুরে প্রমাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যায়। বাকিরা ভুষি মাল। রিচার্ড স্মিথ প্রশ্ন করছেন— What could be worse than two millennia spent making life and death decisions with inadequate information? এত অপর্যাপ্ত তথ্য নিয়ে জীবন ও মৃত্যু সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেবার জন্য ২০ লক্ষ ডলার ব্যয় করার চেয়ে খারাপ আর কি হতে পারে?[18]
আমাদের কাছে কোনও উত্তর নেই! Reuters-এর খবর অনুযায়ী, এ তথ্যটুকু আছে যে এরকম অসম্পূর্ণ তথ্য নিয়েও ২০০৪ সালে ৭২ বিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক ব্যবসা করা যায়।[19]
১৯৮৬ সালে জন বালিয়ার দেখিয়েছিলেন মিডিয়া এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রচুর আওয়াজ সত্ত্বেও ক্যানসারে মৃত্যুর হার না কমে বরঞ্চ ১৯৬২ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে বেড়েছে।[20]
১৯৯৭ সালে একই গবেষক আরেকটি গবেষণাপত্র লিখলেন— “Cancer Undefeated”।[21] এক কথায় জানালেন— এটা পরিষ্কার হয়ে উঠছিল যা দীর্ঘ ৪০ বছরের চিকিৎসা-কেন্দ্রিক ক্যান্সার রিসার্চের পরেও দীর্ঘকালীন এবং ধীরে অগ্রসরমান মৃত্যুহারকে বিপরীত দিকে নিতে পারেনি।” অস্যার্থ, দুঃখজনকভাবে, অন্যান্য চিকিৎসার সঙ্গে তুলনা করলে ক্যানসার চিকিৎসার গবেষণায় ব্যর্থতার হার সবচেয়ে বেশি। এ কথা পরিষার হয়ে গেল যে কম-বেশি ৪০ বছর ধরে ক্যানসারের ক্ষেত্রে প্রধানতঃ চিকিৎসা-কেন্দ্রিক গবেষণা মৃত্যুর পরিসংখ্যানে সুদীর্ঘ অথচ ধীর বৃদ্ধিকে বিপরীতমুখী করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এরকম স্বল্প সাফল্যের হার গ্রহণযোগ্য নয় এবং হালেও পানি পায় না। উল্লেখযোগ্য হল এ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে ক্লিনিকাল মেডিসিনের জগতে অতি মান্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ।
Nature-এর মতো পত্রিকায় ক্লিনিকাল ট্রায়াল নিয়ে মন্তব্য করা হচ্ছে— “Sadly, clinical trials in oncology have the highest failure rate compared with other therapeutic areas … However, this low success rate is not sustainable or acceptable…”। গবেষকেরা দেখেছেন There must be more opportunities to present negative data. এ রকম হলে ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলো আদৌ কতটা বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে তার একটা অনুমান করা যায়। ওষুধ কোম্পানিগুলো কেবলমাত্র এদের প্রয়োজনে positive data হাজির করে। এর কারণ হল যে কোনও চিকিৎসার কেন্দ্রে থাকে মানুষ। (patients are at the centre of all these efforts.) মানুষ না থাকলে মেডিসিনের কোনও প্রয়োজন পড়তো না।[22]
British Medical Journal-এর গবেষণাপত্রে দেখানো হচ্ছে কিভাবে কর্তিত (truncated) ট্রায়ালকে FDA-র কাছ থেকে লাইসেন্স বের করার কাজে লাগানো হচ্ছে। একটি নতুন ধরনের মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি Bevacizumab-এর ব্যবসার পরিমাণ বছরে ২৭০ কোটি ডলার। এ জন্য FDA-র নিয়মকানুন কিছু ক্ষেত্রে শিথিল করাও হয়েছে।[23] এমনকি ২,০৪৭টি গবেষণা পত্রকে ছাপা হয়ে যাবার পরে তুলে নেওয়া হয়েছে। খুব খোলাখুলি এ প্রশ্নও উঠে আসছে।[24]
যে কোনও চিকিৎসার কেন্দ্রের মতো যে কোনও মুনাফার কেন্দ্রে, যে কোনও আধিপত্যের কেন্দ্রে এবং যে কোনও অর্থপূর্ণ সম্পর্কের কেন্দ্রে আছে মানুষ। প্রতিটি সংস্কৃতিতে তার নিজস্ব ধরণে রোগের যন্ত্রণা, বেদনা এবং, পরবর্তীতে, মৃত্যুকে সওয়ার ও ধারণ করার ক্ষমতা আছে। বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বিস্তীর্ণ জনজীবনে এটা বাস্তব ও সত্যি, এটাই resilience of society – সমাজের প্রতিঘাত সহ্য করার ক্ষমতা। এরকম এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও চেতনার জীবনসম্ভারে বহু ক্ষেত্রেই রোগি ও চিকিৎসকের মাঝে একটি inter-subjective ঐক্য জন্ম নেয়। আর্থার ক্লিনম্যান দেখেন – একটি অর্থনৈতিক লেনদেনের বিষয় হিসেবে চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ককে পণ্যায়িত করে তোলা এ সম্পর্কের কোন পরিমাণগত বৃদ্ধি বোঝায় না। এ সম্পর্কের একদিকে আছে চিকিৎসকের মানবী দান, আর অন্যদিকে রোগীর।[25]
বিশেষ করে ক্যানসারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা চিকিৎসার আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যে ও অবাধ মুক্তপুঁজির দুনিয়ায় এই ব্যক্তি-ব্যক্তি ঐক্য ক্রমাগত ভেঙ্গে পড়তে থাকে। স্তন ক্যানসারে মৃত্যুর কিছুদিন আগে কুশনার লিখেছিলেন যে ক্যানসারে গুরুতর জীবন-সংকট উপস্থিত না হলে আমেরিকাতে খুব কম চিকিৎসক-ই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে মাথা ঘামান। এখন এটা ভারত বা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্যি। এর পেছনের একটি বোধগম্য কারণ হল গত ২০-২৫ বছরে আমাদের নিজস্ব পড়শি-নির্ভরতার সামাজিক জীবনে একটি anamorphic (অস্তিত্বের মূল থেকে পরিবর্তনের মতো) রূপান্তর ঘটেছে। রোগি হিসেবে কুশনারের উপলব্ধি ছিলো – “Most of the time, oncologists do not even see their patients during regular, routine appointments. In the United States, baldness, nausea and vomiting, diarrhea, clogged veins, financial problems, broken marriages, disturbed children, loss of libido, loss of self-esteem, and body image are nurses’ turf”।[26]
সমস্ত চিকিৎসার পরে ধনে-প্রাণে সর্বসান্ত, বহুহাতিক কোম্পানির মুনাফার উদগ্র বাসনা ও আমাদের ডাক্তারির সার্জারি-কেমোথেরাপি-রেডিওথেরাপির ফলে zombie বা প্রায় প্রেতাত্মার মতো চেহারা নেওয়া একজন মানুষকে দেখে যে কোন বিবেকী চিকিৎসকের মনে প্রশ্ন উঠবে – এ পরিণতি কি এতো আবশ্যিক ছিলো? প্রায় কোন গবেষণা পত্রেই এখনো অবধি নিশ্চিতভাবে ক্যানসার চিকিৎসায় নিরাময়ের কথা নির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হয় নি। অথচ ক্ষমতার দম্ভে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ৪৩ বছর হয়ে গেল। আনন্দের কথা cell biology এবং জিন গবেষণা চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনেক নতুন সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে। যেমন recombinant DNA technology, অনেক নতুন বায়ো-মার্কার, transducer ও signaling pathway সম্পর্কে অজস্র নতুন পথ খুলে যাচ্ছে যা ভবিষ্যতে মানুষের বেঁচে থাকাকে অনেক স্বাভাবিক করে তুলবে। কিন্তু ক্যানসার একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জগত – আমাদের দেহে বাস করা আমাদের “অপর”। গোলাগুলি ছুঁড়ে, যুদ্ধ ঘোষণা করে একে থামানো যাবে না।
১৪ নভেম্বর, ২০১৩ সালে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ Dead Man Walking-এ টমি ডেভিস নামে এক ক্যান্সার রোগীর বর্ণনা আছে (নাম পরিবর্তিত)। ইন্সিউরেন্সহীন এই মানুষটি তার সর্বস্ব খুইয়েছে ক্যান্সারের অর্ধসমাপ্ত চিকিৎসার জন্য। শেষ অব্দি একটি zombie বা জীবন্ত লাশ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার চিকিৎসকদের প্রতিক্রিয়া – “After hearing this story, we were neither shocked nor saddened nor disheartened. We were simply appalled”।
মার্চ, ২০১৯-এ ল্যান্সেট-এর মতো পত্রিকায় বলা হয়েছিল – “Prices for new drugs are often so prohibitive that negotiations between pharmaceutical companies and individual health-care systems are commonplace. For drug companies, who can reduce their original asking price by as much as 70%, what does this say about the elasticity of their prices? With an average return of US $14·50 on every $1 invested in research and development, there is no doubt room for manoeuvre.” (“Prevention, treatment, and profit: an unsustainable alliance”, পৃঃ ৩১১)
এ জার্নালেই অন্য একটি প্রবন্ধে (বাইডেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পরে) বলা হয়েছিল – “With a global economic crisis looming due to COVID-19, difficult choices will be necessary over the next few years when prioritising health-care spending. We hope to see data-driven decision-making and consensus on fair drug prices that will help overcome the long-term consequences of public health and financial crises.” (“The real worth of cancer drugs”, ডিসেম্বর ১, ২০২০)
ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ (৪ নভেম্বর, ২০২০) প্রকাশিত একটি মেটাঅ্যানালিসিসে (“Mortality due to cancer treatment delay: systematic review and meta-analysis”) বলা হল যে ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে ১ মাস দেরী হওয়া মৃত্যুর সম্ভাবনা ১০% বাড়িয়ে দেয়। একটি ডায়াগ্রামও দেওয়া হয়েছিল এ প্রবন্ধে।
আমার প্রবন্ধে বেশি জোর দিয়েছি ক্যান্সারের রাজনীতি, বহুক্ষেত্রে চিকিৎসার মিথ নির্মাণ করার সংস্কৃতি, ক্যান্সার নিয়ে কর্পোরেট পুঁজির আন্তর্জাতিক ব্যবসা এবং একে নিয়ে গড়ে ওঠা মেডিক্যাল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের ওপরে। কিন্ত এখানেই শেষ নয়। যে বিজ্ঞানীরা নিরলস পরিশ্রম করে নতুন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির জন্ম দিচ্ছেন এবং যার ফলে বহু ক্যান্সার নিরাময় সম্ভব কিংবা আয়ুষ্কাল বাস্তবিক অর্থেই বাড়িয়ে তোলা যায় তাঁরা মানুষের অনিঃশেষ শ্রদ্ধার পাত্র।
কিন্তু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে যদি বাইরের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যদি আগাম বোঝা যায়, যদি মানুষকে ভোগ্য পণ্য হিসেবে না দেখে চিকিৎসা করা যায় তাহলে ক্যান্সার-আক্রান্ত হবার পরেও একটি পরিসর তৈরি হতে পারে যেখানে রোগটিকে শান্তভাবে একে স্বীকৃতি দেওয়া যায় এবং মেনে নেওয়া যায়। তাহলে আমাদের জীবনকে অনেক সহনীয় হয়ে উঠবে। আমরা প্রাণী বলেই মারা যাবো, কিন্তু বর্তমান চিকিৎসার জগত থেকে হারিয়ে যাওয়া sufferings ও pain-কে বোঝার মানসিক জগতকে আমাদের চিকিৎসকদের নিজেদেরই গড়ে তুলতে হবে— অনেকটা “আরোগ্য-নিকেতন”-এর জীবন মশাই-এর মতো।
১৯৮৫ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কারজয়ী ডঃ বার্নার্ড লোন (Bernard Lown) একটি প্রবন্ধে প্রশ্ন করেছিলেন – “Doctor as scientist, healer, magician, business entrepreneur, small shopkeeper, or assembly line worker — which is it?” আমাদের এ উত্তর দিতে হবে। কাজটি শক্ত, কিন্তু পারতে হবে এজজন মানুষ ও চিকিৎসক হিসেবে একজন রোগির জীবনে ও অস্তিত্বে প্রভাতী হাসি দেখার জন্য! এ পথে একদিন পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে যে!
[1] প্রাসঙ্গিক গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক— এলেন লিওপোল্ড, আন্ডার দ্য রাডার: ক্যান্সার অ্যান্ড দ্য কোল্ড ওয়ার
[2] জার্নাল অব ক্যান্সার পলিসি, ২০১৩-তে প্রকাশিত
[3] A pan-European comparison regarding patient access to cancer drugs
[4] James T. Patterson, The Dread Disease: Cancer and Modern American Culture
[5] Illness as Metaphor, p.3
[6] William A. Maddox et al, “A randomized prospective trial of radical (Halsted) mastectomy versus modified radical mastectomy in 311 breast cancer patients”, Annals of Surgery, আগস্ট ১৯৮২, ১৯৮ (২)ঃ ২০৭-২১২।
[7] John Cairns, “The Treatment of Diseases and the War against Cancer”, Science, নভেম্বর ১৯৮৫, ২৫৩ (৫)ঃ ৫১-৫৯।
[8] Science: The Endless Frontier, A Report to the President by Vannevar Bush, Director of the Office of Scientific Research and Development, July 1945, p. 13. (নজরটান আমার)
[9] Sharon Batt, “Limits on Autonomy: Political Meta-Narratives and Health Stories in the Media”, American Journal of Bioethics, 16 August 2007
[10] Seymour S. Cohen, “Cancer Research and the Scientific Community”, Science, 18 June 1971
[11] দ্রষ্টব্য: Laura Otis, Membranes: Metaphors of Invasion in Nineteenth-Century literature, Science and Politics।
[12] Sharon Batt, Patient No More: The Politics of Braest Cancer
[13] Fitzhugh Mullan, Vital Signs: A Young Doctor’s Struggle with Cancer
[14] Patterson, The Dread Disease, p. 252
[15] Daniel S. Greenberg, “Cancer: Now, the Bad News”, Outlook, Washington Post, January 19, 1975
[16] Greenberg, “Progress” in Cancer Research – Don’t Say It Isn’t So”, New England Journal of Medicine, March 27, 1975
[17] বিস্তৃত আলোচনার জন্য দেখুন, Ben Goldacre, Bad Pharma এবং Jill Fisher, Medical Research for Hire.
[18] Richard Smith, “Where is the wisdom …? The poverty of medical evidence”, British Medical Journal, 5 October 1981
[19] Sharon Bigley, “Is high spending on cancer care ‘worth it’?, Reuters, April 9 2012
[20] John C. Baliar III and Elaine M. Smith, “Progress Against Cancer?”, New England Journal of Medicine, May 8, 1986
[21] New England Journal of Medicine, May 29, 1997
[22] C. Glenn Begley and Lee M. Ellis, “Raise standards for preclinical cancer research”, Nature, 29 March 2012
[23] JPA Ioannidis et al, “The need to consider the wider agenda in systematic reviews and meta analyses”, BMJ, 13 September 2010
[24] “Stopping a trial early in oncology: for patients or for industry?”, F. Toria et al, Annals of Oncology, 27 February 2008
[25] The commodization of the healer-sick relationship as an economic transaction cannot quantify this aspect of relationship … It is rather healer’s gift as well as that of the patient. – Arthur Kleinman, The Illness Narrative (1988), p. 54.
[26] Kushner, “Is the aggressive Adjuvant Chemotherapy the Halsted Radical of ‘80s?”. Cancer Journal of Clinicians, November 1984)
Excellent one sir.
অত্যন্ত তথ্যপূর্ণ লেখা। সমৃদ্ধ হলাম।ধন্যবাদ স্যার
খুব ভালো ও প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ
জয়ন্তদাদা, আপনি এতো পড়েন কখন, জানি না।তবে একটা বিষয়ে সহমত, শুধুমাত্র ক্যানসার নয়, গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থাটাই একটা মস্তো বড়ো ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে।এখন প্রায় সবাই, কেবলমাত্র লক্ষণগুলোর চিকিৎসা করেন।
বহু ক্ষেত্রেই, আমি দেখেছি, একটু সহমর্মিতা দেখালে, রোগের কারণ পাওয়া যায়-একগাদা পরীক্ষা ছাড়াই।মেডিক্যাল হিস্ট্রি টেকিং ব্যাপারটাই এখন পরিত্যক্ত হয়েছে।ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা, মানে নাড়ির গতি বা প্রশ্বাসের হার?বহু দূরের কথা।
ক্যানসার তো অনেক বড়ো বিষয়।যেটার আগা মাথা, কিছুই আমরা জানি না।কেন হয়, মেটাস্ট্যাসিস হবে কিনা বা কতোটা ভিরুল্যান্ট জানার কোনও উপায়ই নেই।চেষ্টাও নেই।সামান্য একজন শ্বাসকষ্ট বললেই তাকে যূপকাষ্ঠে তোলা হয়।কখন শ্বাসকষ্ট হয়, সঙ্গে আর কি কি কষ্ট হয়, কিছুই জানার চেষ্টা নেই।অবশ্যই বিশেষজ্ঞরা সব জানেন।আমি কিছুই জানি না।তাই নিজেকে হাতুড়ে বলে পরিচয় দিই।প্রণতঃ
দীঘো।
আদর ?
পড়লাম। ক্যানসারের উৎপত্তি ও ছড়িয়ে পড়া ( metastasis বা দূরবর্তী উপনিবেশ গঠন ) এর সহজ উপস্থাপনা কর্তৃত্বের দাবি করে। অনেক অজ্ঞতা আর মৃত্যুভয় এ দুটোর সুযোগ নিয়ে ফার্মা কোম্পানি গুলো আদা জল খেয়ে নেমেছে। আর মুনাফা যত বেশি ততই অর্ধ সত্য উপস্থাপনা অনৈতিকতা ও রাষ্ট্র জড়িয়ে পড়া এ যুগের এক সাধারণ ধারা। লেখক কে এই সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বোধগম্য ধারণা দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আরো এমন লেখা পড়বার আশায় রইলাম।
ধন্যবাদ, ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য। গত পনের বছর ধরে বহু প্রিয়জনকে কর্কটরোগে হারিয়ে আমার মনে হয়েছে অসুখটি সাধারণভাবে সারবার নয়। অথচ চিকিৎসার খরচ সংগ্রহ করা নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের আয়ত্ত্বের বাইরে।খোঁজ নিয়ে এও জেনেছি, যে ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয় হয় তা বাজার থেকে কম করে ৪০% ছাড়ে আমরা পেতে পারি। সেটা সরকারী হাসপাতালে সম্ভব, কিন্তু হোটেল-হাসপাতালে পুরো বিলই মেটাতে হয়। বাড়তি মুনাফা তাদের ব্যাগেই ঢোকে।
এর চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার হোক আর ভাল করার নামে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়বহুল চিকিৎসা বন্ধ হোক।
আমি অনেক দিন, অপেক্ষা করেছি তোমার এই লেখার জন্য। এককথায় অসাধারণ।
তথ্যপূর্ণ লেখা। পড়ে অনেক কিছু জানা গেল। যতদিন না পর্যন্ত এক বিপুল সামাজিক পরিবর্তন হবে ততদিন অব্দি ক্যনাসার এবনহ অন্যান্য অসুখনিয়ে ব্যবসা চলবেই!