যে সময়ের কথা বলছি তখনো কলকাতায় ঘরে ঘরে টেলিভিশন আসেনি। প্রাত্যহিক লোডশেডিংয়ের উৎপাতে সন্ধ্যে হতেই বাড়িতে হ্যারিকেন জ্বলে উঠতো। সেই আলো-আঁধারির মধ্যেই আমরা ঢুলতে ঢুলতে স্কুলের পড়া করতাম।
অন্ধকার ঘনাতেই কোত্থেকে এসে পরতো যত মশাদের দল, বিন বিন করে বিরক্তিকর গান শুনিয়ে, শরীরের চতুর্দিকে গেরিলা আক্রমণে দুর্বিষহ করে ফেলত জীবন।
তবু আনন্দ ছিল অনেক। শীত, গ্রীষ্ম অথবা বর্ষা, যাই হোক না কেন, স্কুল ফেরত মাঠের পাশের জনৈক দাদার দোকানে ব্যাগ বই রেখে ঢুকে পড়া হতো ফুটবল আর ক্রিকেটের টিমে।
সারা বিকেল বল পিটিয়ে ক্লান্ত শরীরে যখন বাড়ি ফিরতাম কাদামাখা স্কুলের জামা-প্যান্ট নিয়ে, গুরুজনদের বকুনি দেওয়ার অন্ত ছিল না। কপাল খারাপ থাকলে উত্তম-মধ্যম জুটে যেত তৎক্ষণাৎ। আর সন্ধ্যের সময় পড়তে বসলেই চোখে নেমে আসতো রাজ্যের ঘুম।
তখনো সিনেমা যাওয়ার মত বড় হয়ে উঠিনি আমরা কেউই। দূর থেকে সিনেমা হলের পোস্টার দেখতাম, বাসে করে স্কুলে যাওয়ার পথে।মনে হত সব অন্য জগতের মানুষ। ব্ল্যাকার দের দৌরাত্ম্যে সেই সব সিনেমার টিকিট ছিল অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য। কালে কালে সেইসব সিনেমা হল উঠে গিয়ে এখন মাল্টিপ্লেক্স অথবা হাল আমলের নেটফ্লিক্স কিংবা অ্যামাজনে এসে ঠেকেছে।
তবে কাড়াকাড়ি করে পড়া হত বই। পূজাসংখ্যা মানে তো কথাই নেই। গোগ্রাসে গিলতাম আনন্দমেলা, শুকতারা আর কিশোর ভারতী। মাঝেমাঝে বড়দের জন্য রাখা ‘দেশ’। সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ, সঞ্জীব থেকে শুরু করে আশাপূর্ণা দেবী,লীলা মজুমদার। মানিকবাবু যে আমাদের স্কুলের ছেলে তা জেনেছি অনেক পরে।
সেটা খুব সম্ভবত ৮০ -৮১ সাল হবে। ক্লাস সেভেনে পড়ি। কিছুদিন আগেই পড়েছি পূজা সংখ্যায় লেখা শীর্ষেন্দুর উপন্যাস ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’। বুকুনের অঙ্কে তেরো পাওয়ার কাহিনী মাথায় গেঁথে রয়েছে তখনও।
আমি দ্বিতীয় প্রজন্ম উদ্বাস্তু। মা-বাবারা দুজনেই বাংলাদেশ থেকে এদেশে আসেন ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর।আরো অনেক উদ্বাস্তুদের মতোই উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে বিভিন্ন স্থানে গড়াতে গড়াতে এসে ঠাঁই লাভ করেন কলকাতায়।অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত একটা পাকাপাকি ঠিকানা মেলে তাদের।
আমরা ভাই-বোনেরাও ততদিনে বিভিন্ন মফস্বল ঘুরে স্কুল-কলেজ যাওয়া শুরু করি এ বাড়ি থেকেই। ততদিনে আত্মীয়-স্বজনরাও ওপার বাংলা থেকে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে, ছড়িয়ে পড়েছেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে।
কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে লড়াই করে সাফল্য পেয়েছেন। কেউবা ততটা সাফল্য পাননি। তবুও যে যার মতো করে জীবনের লড়াই করে যাচ্ছেন। খুঁজতে চাইছেন মাথা গোঁজার ঠাঁই।
এর মধ্যেই একজন ছিলেন আমার জ্যাঠতুতো দাদা। সম্পর্কে দাদা হলে কি হবে বয়স ছিল আমাদের থেকে অনেকটাই বেশি। আমরা ছোড়দা বলেই ডাকতাম উনাকে। ছোড়দা ছিল যাকে বলে অপরিসীম প্রতিভাবান । আমাদের ছোটবেলার ‘আইকন’। বাংলাদেশে স্কুলে পড়ার সময় গাছ থেকে পড়ে গিয়ে তার একবার ডান হাতের আঙুলে চোট লাগে। লিখতে অসুবিধা হতো বলে সে তৎক্ষণাৎ বাঁ হাতে লিখতে শুরু করে দেয়। বার্ষিক পরীক্ষা চলাকালীন তার অনভ্যস্ত হাতের লেখা দেখে মাস্টারমশাই যখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো খাতার পাতায় তাকিয়ে আছেন, সে নাকি বলে উঠেছিল,”কি দেখছেন স্যার? মুক্তো ঝরছে!” তারপর কি হয়েছিল তা অবশ্য আর আমাদের জানা নেই। তবে ছোড়দা সেই সময়ই এইসমস্ত নায়কোচিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমাদের চোখে বেশ একটা হিরো হয়ে উঠেছিল।
স্কুলের পরবর্তী জীবন টাও ছিল বেশ একটা স্বপ্নের মত।
আইন পরীক্ষা পাশ করে খুব দ্রুত সে সুপ্রিম কোর্টের ল’ইয়ার হয়ে যায়। জমাটি ওকালতি ব্যবসা আর ভাগ্যদেবীর আশীর্বাদ, দুইই ঝরে পড়ে তার জীবনের উপর। তৎকালীন শিকড় ছিঁড়ে এপার বাংলায় আসা মানুষরা যখন কোন একটা অবলম্বন ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, সে সময় অন্য আরেক উদ্বাস্তু পরিবারের মানুষের এমন সাফল্য ছিল কল্পনাতীত।
এই হেন ছোড়দা দিল্লি শহরে তখন পাকাপাকি ভাবে প্রতিষ্ঠিত। বিদেশি গাড়ি,সাদা ইউনিফর্ম পড়া ড্রাইভার। এমন একজন দাদা পেলে কার না অহঙ্কার হয়। আমাদের ও হতো। কলকাতায় এলে, সচরাচর আমাদের বাড়িতে উঠতো না ছোড়দা। থাকতো গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে। খুব সম্ভবত নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে, ছোট ছোট খুড়তুতো ভাইবোনদের থেকে আলাদা রাখার জন্য। কিন্তু একবারই সে কিছুদিন কলকাতায় হোটেল ছেড়ে আমাদের বাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়।
সেইবার, ওর সেই ছোটবেলায় চোট পাওয়া ডান হাতে একটা প্লাস্টিক সার্জারি করতে হয়েছিল। আমার বাবার তত্ত্বাবধানে, সরকারি মেডিক্যাল কলেজে। বাড়িতে আসার পর বিশ্রাম নেওয়া ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না ছোড়দার। রোজ রোজ এক হাতে লুডো, ক্যারম আর কত খেলা যায়। লুকিয়ে আনা ক্যান বিয়ারের স্টকও ফুরিয়ে গিয়েছিল ওর ততদিনে।
গরমের ছুটির জন্য দিল্লির কোর্ট তখন বন্ধ। দেখতে দেখতে আমাদেরও গরমের ছুটি শেষ হয়ে গিয়ে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল।
ছোড়দা ঠিক করলো দিল্লি ফেরার আগে একবার তারকেশ্বরকে দর্শন করবে। স্বভাব নাস্তিক ছোড়দার এই সিদ্ধান্তের পিছনে ঠিক কি কারণ ছিল তা এখন আমার আর মনে নেই,তবে গাড়িতে করে ভাইবোনেদের প্রথম এই সফরের পরিকল্পনা আমাদের উৎসাহিত করেছিল প্রচুর। কিন্তু একমাত্র সমস্যা হলো যে দিনটি নির্বাচিত হয়েছিল পাঁজিপুঁথি দেখে তার ঠিক পরের দিনই, ইস্কুলের হাফ ইয়ার্লিতে আমার অঙ্ক পরীক্ষার দিন।
মাকে অনেক কষ্টে ছোড়দা রাজি করিয়ে ফেললো। উকিল বলে কথা। যুক্তির মারপ্যাঁচে বিচারক একদম ঘায়েল। মায়ের ও বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেল অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন খুব সম্ভবত নতুন করে কিছু প্রস্তুতি নেওয়ার থাকে না।
কিন্তু সেটা সারা বছর ধরে যারা পড়াশোনা করে তাদের জন্য। আর যারা গোটা মরশুম কাদা মাঠে ফুটবল পিটিয়ে, পাতার পর পাতা গল্পের বই পড়ে অথবা মাঝ দুপুরে টিপ হয়ে যাওয়া ঘুড়ির দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সময় নষ্ট করে,তাদের জন্য নয়।
যাইহোক যথাসময়ে একটা ভাড়া করা অ্যাম্বাসেডর গাড়ি নিয়ে যাত্রা শুরু হলো আমাদের। তারকেশ্বর বাবাজীর দর্শন সেরে, মন্দির লাগোয়া কোন এক হোটেলে বসে দুপুরের খাওয়া হয়েছিল এটুকু এখনো মনে আছে।
খাওয়ার মাঝেই আচমকা বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। যদিও মেঘলা আকাশ কলকাতা থেকেই সঙ্গী হয়েছিল সে যাত্রার।
বিল মিটয়ে প্রচুর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমরা তখন গাড়িতে উঠবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। মন্দিরের আশেপাশে সব ধর্মস্থানের মতোই এখানেও দালাল আর ভিখারিদের অভাব নেই। খাওয়ার হোটেলের ধারেই সবাইকে ছাপিয়ে একটি কমবয়সী মহিলা, কোলে একটি বাচ্চাকে বসিয়ে একটানা সুরে ভিক্ষা চেয়ে যাচ্ছিলো, অনেকক্ষণ ধরে। একে মুশলধারে বৃষ্টিতে সবাই তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে উঠতে ব্যস্ত তার মধ্যে এই একঘেঁয়ে ভাবে পয়সা চেয়ে যাওয়াটা আমাদের ভারি বিরক্তিকর ঠেকছিলো। ভিজতে ভিজতেই তাড়াতাড়ি করে গাড়িতে উঠে এসে বসলাম সবাই। জলের ছাঁট সামলে জানালার কাঁচ যখন হাতল ঘুড়িয়ে তোলা হচ্ছে সেই মূহুর্তে, মহিলাটি কান্নার সুরে বললে,”ত্যালা মাথায় তো সকলেই ত্যাল দ্যায়, রুক্ষ মাথায় কিছু দিয়া যান বাবারা!”
খুব সম্ভবত বলতে চাইলো যে পাথরের ঠাকুরের তো কোন কিছুরই অভাব নেই, সেখানে মানুষ কত কিছু দিয়ে যায়,কিন্ত অভাবের তাড়নায় যারা রাস্তায়, তাদেরকে সাহায্য করার লোক পাওয়া যায় না।
তখন অনেক ছোট ছিলাম। গুরুত্ব বুঝিনি সে কথার।
-“রুক্ষ মাথায় তাহলে দুঃখ দিয়ে গেলাম।” এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা বিরক্তি আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল। তুমুল হাস্যরোলের মধ্যে আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিল কলকাতার উদ্দেশ্যে। দারুণ ছন্দ মিলিয়ে প্রত্যুত্তর দিতে পেরেছি বলে অনেকেই বাহবা দিল আমায়।
আমি শুধু দেখলাম গাড়ির রিয়ার ভিউ মিররে কোলে বাচ্চা নিয়ে ভিজতে থাকা মা ভিখারিনীর অবয়বটি ধীরে ধীরে দূর থেকে আরও দূরে চলে যাচ্ছে। আবছা হয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবন থেকে।
স্বাচ্ছন্দ্য থেকে দারিদ্র্য যে সত্যিই অনেক দূরের পথ!
অনুশোচনা হচ্ছিল খুব। পরে ভেবেছি সেই মা ও নিশ্চয়ই খিদের তাড়নায় কোলের বাচ্চাটিকে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে ভিক্ষে চাইতে বেড়িয়েছে।
কাউকে সাহায্য করতে না পারলে তাকে আঘাত করার অধিকার তো আমাদের কারোরই নেই, তাই না! তা সে যে কারণেই হোক। আর তা করলে নিজের জীবনেই হয়তো সেটা ফিরে আসে অতর্কিতভাবে। আমারও হয়েছিল একদম হাতে হাতে।
পরেরদিন অঙ্ক পরীক্ষার সময় গালে হাত দিয়েই বসে থাকতে হয়েছিল সারাবেলা। সাত সতেরো ভাবতে গিয়ে পরীক্ষায় সতেরোই জুটেছিল শেষমেশ। সারা বছর অঙ্কে ফাঁকি দেওয়ার ফল।
গোঁসাইবাগানের ভূতের মতোই সেই, “বুকুন তুমি অঙ্কে সতেরো,”দুঃস্বপ্নের মতো জ্বালিয়ে যেতো আমায়। উঠতে বসতে অঙ্ক নিয়ে খুব ‘খোঁটা’ শুনতাম বাড়িতে। সেই বকা শেষ হয় মাধ্যমিকে একানব্বই পাওয়ার পর। শাপমোচন হয় অঙ্ক পরীক্ষার।
কিন্তু জীবনের সব অঙ্ক কি সত্যিই মেলে?