রাত প্রায় দুটো বাজে। আই সি ইউ-র ওয়াশ বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া চলছিল খুব যত্ন করে। এরপর পেপার ন্যাপকিনে হাত মুছে একপ্রস্থ স্যানিটাইজেশন।
রাতের আইসিইউ-তে কর্মব্যস্ততা একটুখানি কম। সিস্টাররা নিঃশব্দ পদচারণায় তাদের রুটিন কাজগুলো করে যাচ্ছেন। আইসিইউ-র ডাক্তাররা পেশেন্টের সারাদিনের চার্ট পরীক্ষা করে লিপিবদ্ধ করেছেন প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী। শুধু মাঝরাত্তিরে কোন এমার্জেন্সি ঢুকলে মৃদু হইচই শুরু হয়ে যায় ওয়ার্ডে।
সার্জিক্যাল এমার্জেন্সি মেডিকেল ইমার্জেন্সির তুলনায় সামান্য পৃথক। দ্রুততার সাথে রোগীর চিকিৎসা এবং পাশাপাশি তাকে অপারেশন থিয়েটারের জন্য প্রস্তুত করা দুটো কাজের দায়িত্বই বর্তায় ইনটেনসিভ কেয়ারের ডাক্তার এবং নার্সদের। যেমন আজ রাত বারোটায় ছুটে আসতে হয়েছে আমাকে একটি স্ট্রোক পেশেন্টের ইভ্যালুয়েশন এবং ম্যানেজমেন্টের জন্য। এই আমাদের মত সার্জিক্যাল স্পেশালিটির ডাক্তাররা আইসিউতে এসে পড়লেই মাঝরাত্তিরে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায় সবার।
ষাটের কোঠায় বয়স দেবাশিস বাবুর। অনেক রকম প্রয়োজনীয় ওষুধ খেতে হয় রোজ। কাজের জন্য আজ সারাদিন বাড়ির বাইরে কাটাতে হয়েছে তাকে। বাড়ি ফিরে দিব্যি ছিলেন। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন বাড়ির লোক। সিটি স্ক্যানে দেখতে পাওয়া গেছে ব্রেনের মধ্যে ইন্টারনাল হেমারেজ। তাই মাঝরাতে বিছানা থেকে উঠে আসতে হয়েছে আমাকে।
অপারেশন লাগবে রোগীর। সকালেই কোভিড স্যাম্পল পাঠিয়ে আমরা ওনাকে থিয়েটারে নিয়ে নেব। কোভিড পজিটিভ ধরে নিয়েই যাবতীয় সাবধানতা অবলম্বন করে অপারেশন করতে হবে কাল সকালেই। কারণ রিপোর্ট আস্তে আস্তে কালকের রাত অথবা পরশু সকাল।
রোগীর যাবতীয় চিকিৎসা শুরু করে দিয়ে বাড়ির লোকেদের জানিয়ে দিলাম সে কথা। মেয়ে আর জামাই নিয়ে এসেছেন ভদ্রলোককে হাসপাতালে।
ছেলে থাকেন বিদেশে মায়ের সাথে। মোবাইল ফোনে সবার সাথেই কথা বললাম আমি। অপারেশনের প্রয়োজনীয়তার সাথে রোগীর বিপদের কথাও। রাত দুটোর সময়ে মেয়েকে তার বাবার ক্রিটিকাল শারীরিক অবস্থার কথা শোনাতে কারই বা ভালো লাগে?
কিন্তু সেটাই প্রটোকল। খারাপ লাগলেও পুঙ্খানুপুঙ্খ জানাতে হয় সবকিছু। এটা মরণ-বাঁচনের প্রশ্ন।
“তোমাদের মধ্যে কতজন পজিটিভ হয়েছে এখনো পর্যন্ত?” হাত ধোয়া শেষে জিজ্ঞাসা করলাম সিস্টারকে।
“স্যার আর হিসেব করছি না আমরা। কালকে অবধি যে নেগেটিভ ছিল আজকে সে পজিটিভ হয়ে যাচ্ছে। পজিটিভ লোকেরা আবার নেগেটিভ হয়ে জয়েন করছে। পজিটিভ আর নেগেটিভ এখন একটা বৃত্তের মতো হয়ে গেছে আমাদের হাসপাতালে। চাকা ঘুরে চলেছে। জীবনটা মনে হচ্ছে শুধুই পজিটিভ আর নেগেটিভের খেলা। আর কিছু নেই। তাই ঐসব নিয়ে আর বিশেষ ভাবছি না।”
আমার হাতে স্যানিটাইজার স্প্রে করতে করতে সিস্টারের দার্শনিক উপলব্ধি! মজাই লাগলো শুনে।
কোভিড পেশেন্টদের আইসিইউ আলাদা। কিন্তু আপাতত কোভিড নন যারা, কিন্তু যাদের জ্বর রয়েছে অথবা কোভিড পরীক্ষা হয়নি এখনো যাদের, তাদের জন্য করা হয়েছে মাঝামাঝি একটা ব্যবস্থা। তাদের আপাতত কোভিড ধরে নিয়েই সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে আমাদের সবাইকে। বেডগুলিও রাখা হচ্ছে আলাদাভাবে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আউটডোর থেকে পেশেন্ট ভর্তি করার সময়। সার্জারির জন্য যেসব রোগী প্রস্তুত হচ্ছেন তাদের আমরা কোভিড টেস্ট করে নিচ্ছি ভর্তি হওয়ার আগেই। অদ্ভুতভাবে অনেক রোগী পজিটিভ হচ্ছেন। যাদের কোন উপসর্গই নেই।
যত দিন যাচ্ছে বাড়ছে এই সম্ভাবনাটা। উপসর্গহীন কোভিড রোগী।
আমাদের চারপাশে এখন টেস্ট করালে প্রচুর মানুষ পজিটিভ হবেন। যাদের কোনো উপসর্গ নেই।
এটাই হবার কথা। সবার শরীরেই কোভিডের ছোঁয়া লাগতে হবে। তবেই তো তৈরি হবে সামাজিক অনাক্রম্যতা(Herd immunity)।
এই পজিটিভ হওয়ার চক্করে পিছিয়ে যাচ্ছে আমাদের যাবতীয় অপারেশনগুলি। রোগীদের আবার নেগেটিভ হয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে অপারেশন করাবার জন্য। ব্রেন টিউমার বা মেরুদন্ডের অপারেশনের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
একজন ক্যান্সার রোগীর সাথে আউটডোরে কথা হচ্ছিল সেদিন। ভদ্রমহিলার ঘাড়ে আর হাতে তীব্র যন্ত্রণা। ওষুধ কাজ করছে না। স্ক্যানে দেখা যাচ্ছে ঘাড়ের মেরুদন্ডের (সারভাইকাল স্পাইন) মধ্যবর্তী ডিস্ক সরে গিয়ে নার্ভে চাপ দিচ্ছে। ওষুধ আর ফিজিওতে না কমলে অপারেশনই এর একমাত্র চিকিৎসা।
তাই আলোচনা হচ্ছিল রোগী এবং তার পরিবারের সঙ্গে। ভদ্রমহিলার সাতবার অপারেশন হয়েছে এর আগে। এই কোভিডের বাজারে আরেকবার টেবিলে উঠতে নারাজ স্বাভাবিকভাবেই।
অভয় দিতে গিয়ে আমার সিনিয়র এবার ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে বসলেন। আমায় দেখিয়ে বললেন “এই যে ডাক্তারবাবু আপনাকে পরীক্ষা করে আপনার প্রেসক্রিপশন লিখছেন, উনার ঠিক আপনার মতো রোগ হয়েছিল। উনার অপারেশন হয়ে গেছে, তাও আপনার মতো এক লেভেল নয় দু লেভেলে। উনি সুস্থ হয়ে এখন আপনার চিকিৎসা করছেন। তাহলেই ভাবুন কতটা সেফ এই অপারেশন।”
ভদ্রমহিলা অবাক। বলেই ফেললেন আমাকে,
“আপনার মতো সুস্থ মানুষের অপারেশন লেগেছে?
দেখে তো বোঝাই যায় না!”
“আপনাকে দেখেও তো বোঝা যায় না,আপনি ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে জিতে এসেছেন।”
উত্তর দিলাম আমি।
“আর এই অপারেশনটা শুধু আমার নয়, শাহরুখ খানেরও হয়েছে। ওর মতোই আমার গলাতেও একটা কাটা দাগ রয়েছে। আমার দুটো ইমপ্লান্ট আর শাহরুখের একটা।”
এই বলে আমার গলার ডান দিকের কাটা দাগটা দেখিয়েও দিলাম। আর এটাও বললাম আমার পাশে বসা সিনিয়রই আমার সার্জারিটি করেছেন।
আর পাঠকদের চুপিচুপি বলে রাখি সিনিয়রেরও একটা ছোট অপারেশন তার কিছুদিন আগে আমি করে দিয়েছিলাম।
আসলে অভয় দিতে গেলে সব কথাই খুলে বলতে হয় রোগীকে। মায় নিজের অভিজ্ঞতার কথাও। সেটাই দস্তুর আমাদের পেশার।
ভদ্রমহিলার কপাল থেকে চিন্তার ভ্রুকুটি অনেকটাই কমে গেল এরপর। মুখে হাসি ফুটলো।
পজিটিভ আর নেগেটিভ হওয়ার সাথে সাথে এইসব পজিটিভ আর নেগেটিভ চিন্তার লড়াই চলতেই থাকে আমাদের সকলের জীবনে।
আমার এক পুরনো রোগী যেমন কাল ফোন করে জানালেন,”পার্থদা,যে ব্যাঙ্কে কাজ করি সেখানে সবার রুটিন করোনা টেস্ট হয়েছে। পজিটিভ হয়ে গেছি আমি। কি করবো?”
বুঝলাম ডায়বেটিক বলে ভয় পাচ্ছে। এ ছাড়া বৃদ্ধা মা আর ডায়াবেটিক স্ত্রীও রয়েছেন বাড়িতে।
প্রেসক্রিপশন পাঠিয়ে দিলাম মোবাইলে। বাকি সব সাবধানতা কি অবলম্বন করতে হবে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েই। আমার মাসতুতো ভাইও এভাবেই সুস্থ হয়ে উঠলো দুদিন আগে।
তাই ধীরে ধীরে পাড়া, গলি, মহল্লায় অনেকে পজিটিভ হবেন। চিকিৎসা বা বিনা চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠবেন। যতদিন যাবে একটু একটু করে দুর্বল হবে ভাইরাস।
লকডাউন একদম উঠে গেলে কেসের সংখ্যাও বাড়বে, বাড়বে উপসর্গহীন রোগের সংখ্যাও।
স্প্যানিশ ফ্লু এসেছিল ঘুরেফিরে তিনবার। এটাও হয়তো আসবে।
তবে সাবধানতাগুলি মেনে চললে ধীরে ধীরে কমে যাবে সংক্রমণ আর মৃত্যুর হার। মরশুমি ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই তখন পড়ে থাকবে করোনা। আরেকটা সাধারণ ভাইরাল রোগ হয়ে।
সেই দিনের আশাতেই বুক বেঁধে আছি।
ভালো থাকবেন সবাই।
Inspiring write up.
আপনার লেখা সবসময়ই আমাদের মনোবল বাড়ায়। আপনি এবং আপনারা ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আর এভাবেই আমাদের সাহস জোগাতে থাকুন।
অসাধারণ সুন্দর এক ইতিবাচক বার্তাবাহী শক্তিশালী লেখা। খুব ভালো লাগল।
খুব ভালো লাগলো ভাই।তোমার লেখা সব সময়েই আশা ব্যঞ্জক। এই মহামারীর বাতাবরণে মানসিক শক্তি টা খুব জরুরী , তুমি আমার থেকেও ভালো জানো। তোমার লেখা পড়ে সেটাই পাই।ভালো থেকো ভাই।খুব ভালো থেকো ,তোমরা সকলে।
অসম্ভব ভালো একটা লেখা। ভীষণ ভালো লাগল পড়ে।
সেই আশাতেই আছি .আপনারা ভালো থাকবেন .তবেই তো আমরাও ভালো থাকবো
লেখাটা পড়ে মনের জোড়টা অনেকটাই বেড়ে গেলো। তোমরা নিজেরা লড়াই করে প্রত্যেকের সেবা করে যাচ্ছ , সাথে আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে যেভাবে সাহস যুগিয়ে দিচ্ছ তার জন্য তোমাকে আমার কুর্নিশ। ভালো থেকো
আপনার দিনলিপি আমাদের যে কতটা মনের জোর বাড়ায় তা বলে বোঝাতে পারবো না।এই যে পড়লাম, তাতে একটু হলেও মনে হলো, না পারবো,পারবো কাটিয়ে উঠতে এই ভয়ংকর রোগটিকে।পড়ার আগে পর্যন্ত খবরাখবর শুনে মন থেকেই বোধহয় হেরে বসেছিলাম।আপনার লেখা আবার মনোবল পেলাম।আপনিও ভাল থাকুন।আপনাদের ভাল থাকাটা খুব প্রয়োজন আজ।
How nicely you have explained that the people who were negative the next day became positive…those who were positive joined their work in hospital again after becoming negative..the front line workers are working day and night with Covid 19 though knowing very well they are playing Life and Death…your writing always gives us Hope and shows Light after darkness…just like Sadness followed by Happiness nothing is permanent in this world …..?
অসাধারণ ??
অসাধারণ ??