কর্মসূত্রে আমার অনেক বন্ধুবান্ধবই দেশের বাইরে রয়েছেন। বেশিরভাগ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন ইউ কে-র বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে। ব্যস্ত রয়েছেন বিবিধ পরিষেবায়। কেউ কেউ নাগরিক হয়ে গেছেন সেখানকার, কেউ বা এখনো দিন গুনছেন ফিরে আসার।
এমনই একটি ডাক্তার দম্পতির জীবনের ঘটনা নিয়ে আজকের এই লেখার অবতারণা।
অরুণাভ আর অহনা দুজনেই আমার ক্লাসমেট।
এখানকার পড়াশোনা শেষ করে ওরা ইউকে পাড়ি দেয়। সে অনেককাল আগের কথা। দুজনেই এখন সেখানে প্রতিষ্ঠিত এবং কর্মরত লন্ডনের কাছা-কাছি দুই হাসপাতালে।
কথায় বলে মনের টান থাকলে দূরত্ব কোন সম্পর্কেরই বাধা হতে পারে না। তাই ওদের সাথে আমাদের মত দেশে থাকা বন্ধুদের যোগাযোগ এখনও অটুট। মোবাইল ফোনে আলাপচারিতা অথবা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে দৈনন্দিন খোঁজ-খবর চলতে থাকে অবিরত।
বেশ কিছুদিন যাবত ওদের “টিকি”-র দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না কোথাও। খবর পেয়েছিলাম দু জনেরই কোভিড ভ্যাকসিনেশন হয়ে গিয়েছে ডিসেম্বর মাসে। তারপর কি কোন শারীরিক সমস্যায় পড়লো? খোঁজ খবর না পেয়ে একটু চিন্তায় ছিলাম সবাই।
কিছুদিন আগে অহনার একটি ফেসবুক পোস্টে পরিষ্কার হলো সব।
ইউকে-তে করোনা অনেক গভীর অবধি ছড়িয়ে পড়েছে। সারাটা বছর হাসপাতালে এবং বাইরে অতিমারীর সাথে লড়াই করতে করতে ডিসেম্বর মাসে ভ্যাকসিন এসে পৌঁছয় ওদের হাসপাতলে।
ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও ওদের কোন অসুবিধা হয়নি।
কিন্তু ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ওদের যমজ পুত্রদ্বয়ের একটির, যার বয়স ১২-র কাছাকাছি, কোভিড সংক্রমণ ঘটে। সামান্য কিছু অসুবিধার পরে আশানুরূপ ভাবে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে সে। কিন্তু অপর জনের টেস্টের রিপোর্টে কোভিড ধরা পরে নি।
এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে। যে পুত্রের কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছিল আচমকাই তার পেট ব্যথা শুরু হয়। ঘরের ওষুধপত্রে রোগ না সারার দরুন ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।এই বয়সে বাচ্চাদের অ্যাপেন্ডিসাইটিস হওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। আমার বন্ধুদেরও এই ক্ষেত্রে সে কথাই মনে হয়েছিল।
কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ইমার্জেন্সি ডাক্তাররা জানান তারা এটাকে অ্যাপেন্ডিসাইটিস নয়, কোভিডেরই একরকম জটিলতা ভাবছেন।ছেলেটির একমাস আগের কোভিড টেস্ট নেগেটিভ ছিল, তা সত্বেও। সে ক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে সেই টেস্ট ছিল ফলস নেগেটিভ।
কোভিডের এই নতুন কমপ্লিকেশনের নাম মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিনড্রোম ইন চিলড্রেন সংক্ষেপে MIS-C। এর কারণ আবার সেই হাইপার ইমিউন রেসপন্স। মানুষের নিজের শরীরের ডিফেন্সকে তার নিজের বিরুদ্ধেই লেলিয়ে দিচ্ছে কোভিড। প্রদাহে জ্বলছে শরীরের যাবতীয় সিস্টেম। একে একে অবশ হয়ে চলেছে হার্ট, ইন্টেস্টাইন, লিভার, কিডনি, ব্রেন। কোভিড ধরার সঙ্গে সঙ্গে ঘটছে না এই জটিলতা। শুরু হচ্ছে কয়েক সপ্তাহ বাদে। তাই এসময় রক্ত পরীক্ষা করলে মিলছে কোভিডের অ্যান্টিবডি।
পেটে যন্ত্রণা থেকে শুরু হয়ে গা হাত পা ব্যথা, বমি, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, শরীরে গুটি গুটি র্যাশ নিয়ে বাচ্চারা ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে। এতদিন যে শিশুদের আমরা ভাবতাম কোভিডের জটিলতা থেকে অনেক দূরে।
ছোট ছেলেটির পেটের যন্ত্রণার সাথে সাথে কমতে
থাকে তার রক্তচাপ। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে হয়, পিডিয়াট্রিক আই সি ইউ-এর সন্ধানে।
বিদেশ বিঁভুইয়ে এই প্রবল করোনা আবহে বাচ্চাকে নিয়ে এই দুঃসহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা পড়ছিলাম ওদের লেখায়। ঘন্টার পর ঘন্টা ঠায় বাচ্চার কার্ডিয়াক মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকা আর ক্রমান্বয়ে নামতে থাকা রক্তচাপের সংখ্যা দেখতে দেখতে ক্রিটিক্যাল কেয়ারে রাত কাটানোর কথা। সেখানকার হাসপাতালের চিকিৎসক আর সেবিকাদের সহমর্মিতার কাহিনী । আসলে বিপদে পড়লেই মানুষ চেনা যায় যে।
প্রথমে কৃত্রিম উপায়ে ব্লাড প্রেসার তুলে রাখতে হলেও ধীরে ধীরে চিকিৎসায় সাড়া দেয় ছেলেটি।শরীরের সমস্ত সিস্টেম স্বাভাবিক হয়ে আসে।
ঠিক নয় দিনের মাথায় সুস্থ হয়ে উঠে বাড়িতে ফিরে যায় সে।
ওদের এই নিদারুণ অভিজ্ঞতা থেকে নতুন একটা ভাবনা শুরু হয়ে গেল তাহলে। বাচ্চাদেরকেও আর ছেড়ে রাখা যাবে না। এতদিন ওরা নিজেরা বিশেষ অসুস্থ না হয়ে (asymptomatic) রোগ ছড়াচ্ছিল (superspreader) সমাজে।
কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সংখ্যায় কম হলেও অনেক শিশুর ক্ষেত্রেই জটিলতা এনে দিচ্ছে কোভিড। হ্যাঁ আমি মাল্টি ইনফ্লামেটরি সিনড্রোমের (MIS-C) কথাই বলছি। যা দেখা যাচ্ছে মূলত তিন থেকে বারো বয়সের বাচ্চাদের মধ্যে।
এটা কোন গল্প নয়। একেবারেই জীবন থেকে উঠে আসা বাস্তব। আশাকরি সবাই বুঝতে পারছেন ঘটনার গাম্ভীর্য। তাই,বয়স্কদের পাশাপাশি বাচ্চাদেরকেও সাবধানে রাখা শুরু করুন এখন থেকে। আমাদের শহর তথা সারা দেশে এমনিতেই পেডিয়াট্রিক সুযোগ সুবিধা কম। তার উপর কোভিডের সেকেন্ড ওয়েভ কি ধরনের মিউটেশন নিয়ে আসছে আমাদের জানা নেই।
তাই, নিজেরা ভ্যাকসিন তো নেবেনই,অন্যদেরও মোটিভেট করুন নেওয়ার জন্য। শুধু আপনি নন সমাজের সবাই ভ্যাকসিন না নিলে আপনিও যে সুরক্ষিত থাকবেন না, এটা বোঝার চেষ্টা করুন। যত ভ্যাকসিন নেওয়ার সংখ্যা বাড়বে ততই কমবে সংক্রমণ।
ইউরোপে ভ্যাকসিন নেওয়ার পর কার কি রিয়্যাকশন হচ্ছে তাতে কান দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। প্রায় ৩ কোটির কাছাকাছি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে আমাদের দেশে, রিয়্যাকশনের সংখ্যা মাত্র ০.০২ শতাংশ। আর হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে আরো স্বল্পসংখ্যক মানুষকে। এটা মাথায় রাখুন।
খুব সম্ভবতঃ মে মাস থেকে ভ্যাকসিন সবার জন্যই আসতে চলেছে। দাঁড়িয়ে পড়ুন সেই লাইনে।
নিজেকে বাঁচান, পরিবারের সাথে সমাজ আর দেশ কে বাঁচান।
তবেই বাঁচবে পৃথিবী।
যত দিন যাচ্ছে মানুষের মধ্যে কোভিড-সংক্রান্ত সাবধানতা কমছে।
ডাক্তারবাবুদের চেতাবনি আশা করি তাদের সচেতন করবে।