থ্রেট সিন্ডিকেট নিয়ে লিখতে হলে স্বয়ং ব্যাসদেবও হার মেনে যেতো। আমি তো সামান্য শিক্ষক চিকিৎসক। কুঁজোরও সময় সময় চিত হয়ে শুতে ইচ্ছা হয়। আমিও তাই থ্রেট সিন্ডিকেটের মাফিয়ারাজের সামান্য কিছু কীর্তিকলাপ সবার সামনে আনার জন্য কলম ধরলাম। আমি আছি রায়গঞ্জে। কলকাতা সহ সারা পশ্চিমবঙ্গে কি ঘটছে সেটা আমার দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি। রায়গঞ্জে থেকেই যেটুকু দেখতে পেয়েছি আর বিশ্বস্ত সূত্রে যা খবর পেয়েছি তার মধ্যেই আমার লেখা সীমাবদ্ধ রাখবো।
প্রথমেই বলে নি রায়গঞ্জ পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে একটি প্রান্তিক জায়গা। রেল বা সড়ক যোগাযোগ কলকাতার সঙ্গে তেমন ভালো নয়। এই কারণে রায়গঞ্জে পোস্টিং অনেক সময় ডাক্তাররা পানিশমেন্ট পোস্টিং বলেই মনে করেন। এই মেডিকেল কলেজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। প্রথম দিকে যাঁরা ফ্যাকাল্টি হয়ে এসেছিলেন তাঁদের অধিকাংশ এখনো এখানেই আছেন। অনেকেই অনেকবার ট্রান্সফারের আবেদন করেছে্ন। কোনো ফল হয়নি। আমি এসেছি ২০২০ সালের শেষের দিকে। তারপর যাঁরা এসেছে তাঁদের সিংহভাগ থ্রেট সিন্ডিকেটের বলি। শিক্ষক চিকিৎসকরা কিভাবে থ্রেট সিন্ডিকেটের বলি হয়েছেন তারই কিছু এখানে লেখার চেষ্টা করবো।
কয়েকটা উদাহরণ দেবো। নাম গোপন করে নয়। প্রত্যেকের নাম দিয়েই। নাম দেবো এই জন্যই যে আপনারা সেই ডাক্তারদের প্রয়োজনে জিজ্ঞেস করে নিতে পারবেন আমার দেয়া তথ্য সঠিক কিনা।
প্রথম যাঁর কথা বলবো তাঁর নাম অধ্যাপক (ডাঃ) বিদিশা ঘোষ নস্কর। রেডিওথেরাপি বিভাগের। ওনার এর আগের পোস্টিং ছিলো আর জি কর হাসপাতাল। ওখানে পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনি ছিলো মুখ্যমন্ত্রীর মনোনীত মেডিকেল কাউন্সিলের সদস্য এবং তিলোত্তমা খুনের সকালে আর জি কর থেকে কুচকাওয়াজ খ্যাত ডাঃ সৌরভ পাল। সৌরভ যখন ফাইনাল ইয়ারে স্টুডেন্ট তখন শিক্ষক হিসেবে বিদিশা ম্যাডাম ওকে একটু পড়াশুনা করতে বলেছিলো। বিন্দুমাত্র পড়াশুনা না করে পরে রুগী মারবে এই ভয় থেকে শিক্ষক হিসেবে স্টুডেন্টের ভালোর জন্যই বলেছিলেন। কিন্তু উনি জানতেন না যে থ্রেট সিন্ডিকেটের মাথাকে পড়াশুনা করতে বলা কত বড় অপরাধ।
হাতেনাতে ফল ফললো। কয়েক দিনের মধ্যেই ম্যাডাম ট্রান্সফার হয়ে চলে এলেন রায়গঞ্জ। ট্রান্সফার অর্ডারে যে আধিকারিক স্বাক্ষর করলেন তিনি স্বয়ং হেলথ সেক্রেটারি শ্রীমান নারায়ণ স্বরূপ নিগম।
এই লিস্টটা খুব ছোটো নয়। ডাঃ তুলিকা ঝা, ডাঃ যাদব চন্দ্র সরকার, ডাঃ অমৃতা সামন্ত কয়েকটি উদাহরণ মাত্র।
যদি মনে করেন এই ট্রান্সফার করেই থ্রেট সিন্ডিকেটের খেলা শেষ তাহলে আপনি মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। আসল খেলার শুরু এখান থেকেই। এই খেলা গভীর এবং ভয়ংকর।
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে। ডাক্তারকেও যেখানেই পোস্টিং দেয়া হোক পরিষেবা দিতেই হয়। থ্রেট সিন্ডিকেট অপরাধ করতে পারে কিন্তু সাধারণ মানুষ কোনো অপরাধ করেনি।
ডাক্তারি এমন একটি পেশা যেখানে মেসিন দিয়ে মানুষের কাজ করা যায়না।
আমাদের এখানকার একটি ডিপার্টমেন্টের উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝাবো। সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্ট। এখানে শিক্ষক চিকিৎসক মিলে থাকার কথা সাত থেকে আটজন। সঙ্গে কয়েকজন সিনিয়র রেসিডেন্ট আর হাউস স্টাফ। সব মিলিয়ে অন্তত জনা পনের। এটা যেহেতু মেডিকেল কলেজ তাই সেখানে রোগী দেখার পাশাপাশি ডাক্তারি ছাত্রছাত্রী পড়ানো, প্রতিবন্ধী সার্টিফিকেট ইস্যু করা, দুয়ারে ডাক্তার থুড়ি সরকার প্রোগ্রামে যাওয়া, কোর্ট কেসে কোর্ট হাজির হওয়া এরকম অজস্র কাজ। তা এই পনেরো জনের জায়গায় এখানে আছেন একজন শিক্ষক চিকিৎসক আর দুজন হাউসস্টাফ। আউটডোরে রুগীর সংখ্যা একই। বাকি কাজ একই। শুধু লোকজন নেই। ফলে যে আছে তাকে উদয়অস্ত পরিশ্রম করে পরিষেবা বজায় রাখতে হচ্ছে। কোনোদিন যদি সে অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে পরিষেবা মুখ থুবড়ে পড়বে।
যিনি শিক্ষক চিকিৎসক রয়েছেন তাঁর একটি অপরাধ আছে । তিনি উত্তরবঙ্গ লবি থুড়ি থ্রেট সিন্ডিকেটের স্নেহভাজন নয়।
মেডিসিন বিভাগ বা গাইনি বিভাগের অবস্থাও তথৈবচ। একই অবস্থা ফিজিকাল মেডিসিন বিভাগের। অর্থোপেডিকস নিয়ে কিছু না বলাই ভালো।
কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার ই ফাইলের পর ই ফাইল করেছেন। ডিএমই কে প্রায় হাত জোড় করে অনুরোধ করেছেন কিছু ডাক্তার দেবার জন্য। কোনো ফল হয়নি।
যাঁরা হাসপাতালের আধিকারিক বিগত কয়েক বছরে এটা জেনে গিয়েছেন যে হাসপাতালে কিছু উন্নতি যদি করতে হয়, কোনো কিছু যদি চাইতে হয় তাহলে স্বাস্থ্য ভবনে জানিয়ে কোনো লাভ নেই। জানাতে হবে অভীক, বিরূপাক্্ সৌরভ পাল বা ডাঃ সুশান্ত রায়কে। দক্ষিণ বঙ্গের কথা জানিনা কিন্তু উত্তরবঙ্গের জন্য এটাই অলিখিত নিয়ম।
একটি ঘটনার কথা বলি। ওএসডি হিসেবে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে নীলবাতির গাড়িতে চড়ে সুশান্ত রায় বেশ কয়েকবার রায়গঞ্জ মেডিকেল কলেজে এসেছে। এরকমই একবার এসেছে। সঙ্গে বিরূপাক্ষ আর কয়েকজন চ্যালা। প্রিন্সিপাল স্যার এমএসভিপি স্যার আর আমিও ওনাকে বললাম ডাক্তারের অভাবে হাসপাতালে পরিষেবা দেয়া অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। তখন উনি বললেন সিনিয়র ডাক্তার দেয়া এখন সম্ভব নয় কিন্তু কিছু জুনিয়র ডাক্তার মানে সিনিয়র রেসিডেন্টের পোস্টিং করে দেবো। এই বিষয়টা বিরূপাক্ষ দেখে। ওর সঙ্গে কথা বলো। তখনই জানলাম ডাক্তারদের ট্রান্সফার স্বাস্থ্যভবন থেকে নয়। বিরূপাক্ষ বিশ্বাসের কলম থেকে হয়।
শুধুমাত্র রোগী পরিষেবার কথা চিন্তা করে বিরূপাক্ষর সঙ্গে আমরা বসলাম। সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার হাসপাতাল থেকে ছাপ্পান্ন জন সিনিয়র রেসিডেন্টের লিস্ট বানিয়ে ফেললো। কি অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি বিরূপাক্ষর। কোনো লিস্ট দেখতে হলো না, কাউকে ফোন করতে হলো না ছাপ্পান্ন জনের লিস্ট বানিয়ে ফেললো। দেখলাম পুরো পশ্চিমবঙ্গের কোথায় কোন সিনিয়র রেসিডেন্ট আছে সব ওর নখদর্পণে। তখনও আমরা ভাবছিলাম ওর কি এতো ক্ষমতা আছে। দুদিন পরে হুবহু বিরূপাক্ষ যে লিস্ট বানিয়েছিল সেই লিস্ট স্বাস্থ্যভবন থেকে অর্ডার হয়ে চলে এলো। আমরা সবাই আনন্দে আছি এবার প্রচুর স্পেশালিস্ট ডাক্তার আসবে। রোগী পরিষেবার উন্নতি হবে।
লিস্ট এসে গেলো কিন্তু কোনো ডাক্তার আর আসে না। দুয়েক সপ্তাহ পরে এখানকার কর্তৃপক্ষ যেখান থেকে সিনিয়র রেসিডেন্টদের আসার কথা সেখানে ফোন করলেন। সব জায়গা থেকে বলা হলো ওরা (মানে সিনিয়র রেসিডেন্ট) কলকাতা ছেড়ে যেতে চাইছে না। কুড়ি বছর সরকারি চাকরি করছি। সরকারি অর্ডার পেয়ে গিয়েও নতুন পোস্টিংয়ের জায়গায় জয়েন না করার মামার বাড়ির আবদার যে করা যায় আর কর্তৃপক্ষ যে সেই আবদার মেনেও নেয় সেটা আমি জানতাম না। অবশেষে সেই ছাপ্পান্ন জনের মধ্যে মাত্র চারজন রায়গঞ্জে এলো। বাকি বাহান্ন জন কলকাতাতে থেকে গেলো। এলোই না। পরে লোকমুখে এটা শুনেছি যে এটাই নর্থ বেঙ্গল লবির খেলা। প্রথমে আপনাকে কলকাতা থেকে দূরে ট্রান্সফার করে দেবে। তারপর বিরূপাক্ষ এন্ড কোম্পানীর সঙ্গে একটু হিসেব নিকেষ করে নিতে পারলে সেই ট্রান্সফার রদও হয়ে যাবে। এবার এই বাহান্ন জন কি লেনাদেনা করেছিল সেটা আমার অজানা। তবে সরকারি অর্ডার হবার পরেও তারা কলকাতাতে বহাল তবিয়তে কাজ চালিয়ে গেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও তাদের রিলিস করে নি।
এই সাতকান্ড রামায়ণ বললাম শুধুমাত্র বিরূপাক্ষ বিশ্বাসের অসীম ক্ষমতা বোঝানোর জন্য। যার তৈরি লিস্ট হুবহু ডাইরেক্টর অফ মেডিকেল এডুকেশন অর্ডার করে বের করে দেয়। সেই অর্ডারই আবার অঘোষিতভাবে বাতিল হয়ে যায়।
আরেকটা কথা বলি এই বিরূপাক্ষ বিশ্বাস এই থ্রেট সিন্ডিকেটের একটি নগণ্য সদস্য মাত্র। আর যারা আছে তাদের ক্ষমতা বিরূপাক্ষ বিশ্বাসের থেকে শতগুণে বেশি।
(চলবে)