থ্রেট সিন্ডিকেট নিয়ে লিখছি কারুর সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতার থেকে নয়। এই অভীক, বিরূপাক্ষ, সুশান্ত, মুস্তাফিজুর, সৌরভ এদের সঙ্গে আমার কোনো ব্যক্তিগত ঝামেলা কোনোদিন হয়নি। ব্যক্তিগত সখ্যতাও হয়নি। আমি সরকারি চাকুরে। সার্ভিস রুল মেনে চাকরি করার অঙ্গীকার করেছি। সেটাই আজকে বিশ বছর ধরে করে যাচ্ছি।
আপনারা হয়তো জানেন দেশ স্বাধীন হবার পরে নেহেরু মন্ত্রিসভায় বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা সাংসদ ছিলেন। একবার নেহেরু রেগে গিয়ে বলেছিলেন বিজ্ঞানীদের ল্যাবরেটরিতে থাকা উচিত। সংসদে নয়।
মেঘনাদ সাহা উত্তর দিয়েছিলেন, রাজনীতিকরা ঠিকঠাক কাজ করলে বিজ্ঞানীকে ল্যাবরেটরি থেকে বেরুতেই হতো না। সেটা করছে না বলেই বিজ্ঞানীকে ল্যাবরেটরি ছেড়ে সংসদে আসতে হয়েছে।
এই কথাটা এখনকার গণ আন্দোলনের ক্ষেত্রে সত্যি। যদি রাজনীতিকরা ন্যায়ের পথে থাকতো তাহলে ডাক্তাররাও হাসপাতালেই থাকতো। রাস্তায় নয়। সঙ্গে থাকা অগণিত সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও এই কথাটা প্রযোজ্য।
যাদের নাম থ্রেট সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িয়েছে তাদের সবার শাস্তি হয়ে গেলেই আমরা শান্তি পেয়ে যাবো এমনটা নয়। এরা কেউ খারাপ স্টুডেন্ট ছিলো না। সবাই নিট পাস করেই মেডিকেল কলেজে ঢুকেছিল। কোন একটি বিশেষ আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে সেই নিট পাস করা স্টুডেন্টরা হয়ে উঠেছে দানব।
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ফলেন পরিচিয়তে। ফল থেকেই গাছের পরিচয় পাওয়া যায়। আমি যে ফল নিয়ে আলোচনা করছি সেটা গাছের পরিচয় পাবার জন্যই। গাছের সব ফল সরিয়ে দিলেও গাছ বেঁচে থাকে। পরের মরশুমে আবার ফল হয়। থ্রেট সিন্ডিকেটের বিনাশ করতে হলে সেই গাছ খুঁজে বের করতে হবে। যে গাছে সুশান্ত, অভীক, বিরু বা মুস্তাফিজুরের মতো ফল জন্মেছে।
কি সেই গাছ?
\\
উত্তর হলো এমন একটা হেলথ সিস্টেম যেটা সরকারি সার্ভিস রুল এবং ভারতীয় ন্যায় সংহিতা মেনে কাজ করে না। তার নিজের নিয়ম তৈরি করেছে। সেটা মেনে চলে। যে নিয়ম সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। প্রতিষ্ঠিত লোভ আর হিংসার ওপর। তাই থ্রেট সিন্ডিকেটকে বিনাশ করতে হলে সিস্টেমকে সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার ওপর আবার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এবার একটা ঘটনার কথা বলে আজকের কিস্তি শেষ করবো। এই ঘটনাটা গভীরভাবে চিন্তা করলে আপনারা নিজেরা বুঝতে পারবেন কিভাবে লুম্পেন গোষ্ঠী দলীয় রাজনীতি আর সরকারি হেলথ সিস্টেম একে অন্যের পরিপূরক হয়ে এই থ্রেট সিন্ডিকেটের জন্ম দিয়েছে।
এখানে এর আগের এমএলএ ছিলেন একটি দলের। তিনি বিধায়ক পদে ইস্তফা দিয়ে অন্য দলের টিকিটে লোকসভার প্রার্থী হন। সেখানে তিনি প্রতিপক্ষের কাছে হেরে যান। এরপর তিনি বিধানসভায় একই দলের টিকিটে উপনির্বাচনে প্রার্থী হন এবং জয়লাভ করেন। যে ঘটনাটার কথা বলবো সেটি এই উপনির্বাচনের কিছুদিন আগে ঘটেছিল।
একদিন রাতে ইন্ডোরে কিছু জুনিয়র ডাক্তার চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগে পেসেন্ট পার্টির হাতে মার খায়। যদিও চিকিৎসায় কোনো ত্রুটি ছিলো না। রোগীও দুদিন পরে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলো। এটা জানা যায় যে পেসেন্ট পার্টির সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতিকদের কাছের লোকজন ছিলো। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো ডাক্তাররা যখন মার খাচ্ছে তখন দুজন প্রাইভেট এজেন্সির সিকিউরিটি গার্ড ওয়ার্ডে ডিউটিতে ছিলো। তারা ডাক্তারদের বাঁচানো তো দূরের কথা তারা নিজেরাই পেসেন্ট পার্টির সঙ্গে ডাক্তারদের পেটায়। পরে জানা যায় পেসেন্ট পার্টির পাড়ার লোক এই দুজন সিকিউরিটি গার্ড।
খবর পাওয়ামাত্র প্রিন্সিপাল এমএসভিপি দৌড়ে যান। পুলিশে খবর দেয়া হয়। জেলা থেকে এসডিও এসপি চলে আসে্ন। কর্তৃপক্ষ এফআইআর করে। পুলিসকে একশন নিতে বাধ্য করে। যারা মেরেছিল তাদের গ্রেফতার করে পরদিন কোর্টে চালান করে। সেখান থেকে পরদিন তারা জামিন পায়। যে দুই সিকিউরিটি গার্ড জড়িত ছিলো তাদের সঙ্গে সঙ্গে বরখাস্ত করা হয়।
এই ঘটনার পরই জুনিয়র ডাক্তাররা কর্মবিরতি আর অবস্থান আন্দোলন শুরু করে। দুদিন এটা চলে। আমরা বারবার ওদের বোঝানোর চেষ্টা করি যে কর্তৃপক্ষ যা করার সব করেছে। এবার কাজে ফেরো। সেই কথায় ওরা কোনো কর্ণপাত করেনা। এর মাঝে অজস্র ঘটনা আছে। সেগুলো আর বলছি না। তখন বুঝতে পারি কলেজ কর্তৃপক্ষের আশ্বাস নয় তার চেয়েও বড় ওদের প্রিয় মানুষ ডিএমই কৌস্তভ নায়েক আশ্বাস দিলে তবে এটা মিটবে।
প্রিন্সিপাল স্যার ডিএমইর সঙ্গে সমস্ত জুনিয়র ডাক্তারের ভার্চুয়াল মিটিংয়ের ব্যবস্থা করে দেন। ওইদিনই রাত নটার সময়। জায়ান্ট স্ক্রিনে জুম মিটিংয়ের ব্যবস্থা হয়। সারাদিনের পরিশ্রমের পর রাত নটায় সব জুনিয়র ডাক্তার প্রিন্সিপাল এমএসভিপি সবাই জুম মিটিংয়ে জয়েন করে। ডিএমই স্যার কৌস্তভ নায়েক জুমে জয়েন করেন। করেই একটি অদ্ভুত কথা বলেন।–অভীক এখনো জয়েন করেনি? অভীক জয়েন করুক তারপর আমি জয়েন করছি।
এরপর অভীক জয়েন করে। সঙ্গে জয়েন করে ডাঃ সুশান্ত কুমার রায়। অভীক আর ডিএমই মিলে সেই কথাগুলোই বলে যেগুলো আমরা বলেছিলাম। এর সঙ্গে অভীক আরেকটি কথাও বলে যে সামনেই বিধানসভা উপনির্বাচন। এই সময় এই আন্দোলন কোনো একজন উঁচুতলার মানুষ ভালো চোখে দেখবে না। তাই আন্দোলন চালানো উচিত নয়। উপনির্বাচন হয়ে গেলে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়া হবে।
যাইহোক আমাদের আশ্বাসে নয় অভীকের আশ্বাসে আন্দোলনে পরিসমাপ্তি ঘটে।
এই ঘটনা থেকেই বুঝতে পারবেন এই সিস্টেমে স্বাস্থ্যভবন প্রাইভেট সিকিউরিটি এজেন্সি অভীকের মতো ক্ষণজন্মা মানুষ আর মেনস্ট্রিম রাজনীতি কিভাবে জড়িয়ে আছে।
এর তদন্ত করতে গেলে ফেলুদা হয়তো ফেল মেরে যেতো। আর লালমোহনবাবু বলতেন হাইলি সাসপিসাস।
(চলবে)