এই পাঁচালি কবে শেষ করতে পারবো জানি না। আসলে থ্রেট সিন্ডিকেট শেষ না হলে পাঁচালি শেষ হবে না। আজকে বিশেষ কারনে থ্রেট এর অন্য একটা দিক তুলে ধরার চেষ্টা করবো। যে থ্রেট সমগ্র ডাক্তার সমাজকে সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়। আমি একটু খাদ্য রসিক। সেইজন্য আমার উপমাগুলো খাবার দাবার নিয়েই হয়।
ধরে নিন কলকাতার কোনো একজন বিখ্যাত মানুষ নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে একটি ভোজের আয়োজন করেছেন। সবার জন্য বিনামূল্যে। তা তিনি এসে একদিন একটি সভা করলেন। সভায় বললেন আপনাদের ভালো খাবার খাবার জন্য আর কলকাতার রেস্টুরেন্টে যেতে হবে না। নিজেদের পছন্দমত খাবার এবার এখানেই পাবেন। ধরে নিন গ্রামে পাঁচ হাজার মানুষ থাকেন।
আপনি হচ্ছেন ওই কলকাতার বাবুটির খাস কর্মচারী। আপনাকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হলো খাবারের বন্দোবস্ত করার। সেই বাবু আপনাকে যে মালমশলা দিয়ে পাঠালো তাতে পঞ্চাশ জনের খিচুড়ি আর একটু লাবড়া রান্না করা গেলো। ভোজের প্যান্ডেলটি হলো চমৎকার। এতো উঁচু যে দূরের পাঁচটি গাঁয়ের থেকে দেখা যায়। এবার ভোজের দিন কি হতে পারে সেটা একটু চিন্তা করুন। ওই পাঁচহাজার মানুষ এসে আপনার কাছে কালিয়া কোপ্তা বিরিয়ানি খেতে চাইবে। আপনার হাতে দেবার মতো শুধু খিচুড়ি লাবড়া আছে। আপনাকে গালাগাল দিতে দিতে প্রথম পঞ্চাশজন খেয়ে নেবে। এরপর বাকিরা যখন কিছুই খেতে পাবে না তখন আপনাকে প্রহারেন ধনঞ্জয় করে ছাড়বে।
এটাই হলো সবচেয়ে বড় থ্রেট। এবার জেনে রাখবেন এই বড় মানুষগুলোর যা কিছুর অভাবই থাকুক না কেনো সর্বত্র মোসায়েবের অভাব কোনোদিন হয়না। সেরকম কোনো মোশায়েব তেনাকে ফোন করে লোকজনকে জানিয়ে দেবে উনি সব ব্যবস্থাই করেছেন। এই ব্যাটা আধিকারিক খেতে দেয়নি। পাবলিক তখন আপনার হাল তিলোত্তমার মতো করে দিলেও অবাক হবার কিছু নেই।
যারা মোশায়েব তাদের আর যাই থাকুক না কেনো একটি জিনিসের অভাব চিরকাল থাকে। সেটি হলো সততা। এরকমই একটি মোশায়েব সেদিন দেখলাম সুপ্রিম কোর্টে। তিনি আর কেউ নন আমাদের মাননীয় হেলথ সেক্রেটারি শ্রীমান পূজ্যপাদ নারায়ণ স্বরূপ নিগম।
ওনার উপস্থিতিতে সরকারি কৌঁসুলি সত্য বলার হলফনামা দিয়ে জানিয়ে দিলো সাগর দত্ত মেডিকেল কলেজে রোগীকে জুনিয়র ডাক্তাররা বেড দেয়নি। চিকিৎসাও করে নি। এটা জানার পর দেশের মানুষের পূর্ণ অধিকার আছে এটা বিশ্বাস করার যে জুনিয়র ডাক্তারগুলো বিনা চিকিৎসায় রুগী মেরেছে।
এবার আসি সাগর দত্ত মেডিকেল কলেজে রোগিনী কেনো বেড পায়নি তার বিশ্লেষণে।
ওই যে ভোজের অনুষ্ঠানের কথা বললাম। সেখানে ঠিক যে কারনে চারহাজার নয়শত পঞ্চাশ জন খেতে পায়নি ঠিক সেই কারণেই এই রোগিনী সাগর দত্ত মেডিকেল কলেজে আইসিইউ তে বেড পায়নি। বেড নেই তাই বেড পায়নি। বেড নেই কেনো ? কারণ পর্যাপ্ত বেডের বন্দোবস্ত আগে করা হয়নি তাই।
ভোজের রান্নার মাল মশলার হিসেব যেরকম নিয়ম মেনে হয় তেমনি দেশে বা রাজ্যে বা জেলায় হাসপাতালগুলোতে কতো বেডের সংস্থান রাখতে হবে তারও হিসেব নিকেষ আছে। সেটা কোনো মন্ত্রী বা আমলার মর্জির ওপর নির্ভর করে না।
এটা হিসেব করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন স্বনামধন্য সর্বজন মান্য সংস্থা আছে। এর মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অন্যতম। আমি তাদের হিসেব অনুযায়ী এখানে হিসেব করবো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই যে কত জনসংখ্যা পিছু সেখানকার হাসপাতালে কতো বেড থাকতে হবে তার হিসেব দীর্ঘ গবেষণা করে স্থিরীকৃত করেছে। এই হিসেব সর্বজন মান্য।
এবার দেখা যাক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঠিক কি বলেছে। সেখানে যে হিসাবটি দেয়া আছে সেটা প্রত্যেক দেশের প্রতি জায়গার জন্য প্রযোজ্য নয়। ভোজ বাড়িতে যেমন বলা সম্ভব নয় একহাজার লোক খেতে ঠিক কত কিলোগ্রাম কতো গ্রাম কত মিলিগ্রাম মাংস লাগবে। ঠিক তেমনি প্রতি হাজার লোকসংখ্যা পিছু কতগুলি নূন্যতম বেড লাগবে তার একটা গোদা হিসেব দেয়া আছে। সেটা আবার বিভিন্ন ক্যাটাগরির হিসেব করে দেয়া আছে।আপনারা জানেন কারুর হাইড্রোসিল হলে তাকে প্রসূতি বিভাগের বেডে ভর্তি করা যায়না। সার্জারির বেডেই ভর্তি করতে হয়। এই সব জটিল হিসেব আমাদের মতো জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের চুলচেরা বিশ্লেষণের বিষয়। আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী মোটামুটি প্রতি 1000 জনসংখ্যার জন্য নূন্যতম 3 টি হাসপাতালের বেড প্রয়োজন। 3 এর জায়গায় প্রতি হাজার জনসংখ্যা পিছু 5 টি বেড হলে ভালো হয়।
এই হিসেব অনুযায়ী একটি গড়পড়তা হিসেব এবার আমরা করার চেষ্টা করবো।
পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা মোটামুটি এখন দশ কোটির কিছু বেশি। দশ কোটি হিসেবে এবার দেখা যাক সমস্ত হাসপাতালে কতো বেড থাকা উচিত। সংখ্যাটা ন্যূনতম 3 লাখ। 5 লাখ হলে ভালো হয়।
এবার আসুন বাস্তবের মাটিতে। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে সমস্ত হাসপাতাল মিলিয়ে বেডের সংখ্যা এক লাখের কাছাকাছি। এবার আপনারা প্রয়োজন আর আয়োজনের ফারাকটা বুঝুন। যেখানে প্রয়োজন তিন লাখ সেখানে আছে এক লাখ। ফলে প্রতি তিনটি পেশেন্টের একজন বেড পাবে। দ্বিতীয় জনকে প্রথমে এক বেডে তিনচার জনের সঙ্গে একসঙ্গে ভর্তি হতে হবে। তাও না পেলে হাসপাতালের মেঝেতে মাদুর পেতে শুয়ে থাকতে হবে। মেঝেতেও জায়গা না পেলে ভগবানের ভরসায় বাড়িতে পরকালের দিন গুনতে হবে। ফলে জুনিয়র ডাক্তার থাকলেও সব পেসেন্ট বেড পাবে না। সব জুনিয়র ডাক্তারকে তাড়িয়ে দিলেও বেড পাবেন না।
আইসিসিউ বেড কেনো পায়নি এবার সেটা একটি বলি। প্রথমত বেড অপ্রতুল তাই।
দ্বিতীয়ত সাধারণ ওয়ার্ডে একটি বেডে চারজন পেসেন্ট ভর্তি করা যায়। মেঝেতে ভর্তি রাখা যায়। আইসিসিউ তে এক বেডে একাধিক পেসেন্ট ভর্তি করা যায়না। মেঝেতেও ভর্তি করা যায়না। তার কারন আইসিসিউ তে যে জীবনদায়ী যন্ত্রপাতি লাগে সেটা বেড পিছু নির্দিষ্ট থাকে। বাড়াবার কোনো সুযোগ নেই।
এবার এটাকেও থ্রেট এর সঙ্গে কেনো যুক্ত করলাম সেটা বলি। আপনারা সাধারণ মানুষ। এই জটিল হিসেব আপনাদের বোঝার কথা নয়। তবুও বোঝানোর চেষ্টা করলাম একটিমাত্র কারনে। কোনো বড় হাসপাতালের বিল্ডিং দেখলেই আপনারা মনে করেন সেখানে আপনাদের সব চিকিৎসা হয়ে যাবে। সেটা এই অপ্রতুল বেড নিয়ে সম্ভব নয়। এর সঙ্গে আছে রাজনৈতিক প্রচার। সেই প্রচারে আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা সব সময় থাকে। আপনাদের বোঝানো হয় আপনাদের চিকিৎসার সব ব্যবস্থা মজুত আছে। আমি হলফ করে বলতে পারি যে সত্য আপনাদের জানালাম সেটা এর আগে কোনো নেতা মন্ত্রী আমলা আপনাদের জানায়নি। তাই জুনিয়র ডাক্তারদের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতির যে দাবি সেটা আসলে আপনাদের দাবি। একটি কথা আরও বলে আজকের কিস্তি শেষ করবো। স্বাস্থ্য দপ্তরের হাসপাতালের যে পরিসংখ্যান তৈরি করা হয় সেখানে কতজন ভর্তি হয়েছে কতজন বহির্বিভাগে দেখিয়েছে বা কতজনের অপারেশন হয়েছে তার হিসেব থাকে। কতজন বেড না পেয়ে ফিরে গেছে তার হিসেব থাকে না। এর ফলে কতজন বেড না পেয়ে প্রয়োজনীয় অপারেশন করাতে না পেরে বাড়িতে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে বা যাচ্ছে তার হিসেব কোনোদিন মিলবে না। এই অপ্রতুল পরিকাঠামোর সমস্ত দায়ভার আমরা ডাক্তাররা বহুদিন নীলকন্ঠর মতো হজম করছি। আপনারা আমাদের গায়ে হাত তুলেছেন বিষ্ঠা মাখিয়েছেন। কিন্তু কোনোদিন প্রশ্ন করেন নি পর্যাপ্ত বেড কেনো নেই। আজকে ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে এই প্রশ্ন তুলুন। এই দাবি জুনিয়র ডাক্তাররা তুলছে। ওদের সঙ্গে থাকুন। বিশ্বাস রাখুন একদিন সব পেসেন্ট আপনাদের হাসপাতালে বেড পাবে। আপনার প্রিয়জনকে বাথরুমের সামনে মাদুর পেতে শুয়ে চিকিৎসা নিতে হবে না। আপনার রোগী হিসেবে মানুষ হিসেবে যে মর্যাদা প্রাপ্য সেটা ছিনিয়ে নিন। যতদিন না পাচ্ছেন ততদিন বাড়ি নয় দাবি আদায়ের মিছিলে হাঁটতে থাকুন।
(চলবে)