শুভাশিসদার সাথে আমার পরিচয় প্রায় বছর দশেক আগে। আমি যখন প্রথম এই হাসপাতালে যোগ দিই জেনারেল সার্জারি বিভাগে, তার কিছুদিন পরেই গাইনোকলজিতে শুভাশিসদা যোগ দেন।বয়সে আমাদের থেকে একটু বড় হলেও কথাবার্তায় কখনোই তা প্রকাশ পেত না ওনার। আর যে ব্যাপারটা অত্যন্ত লক্ষ্য করার মতো ছিল তা হলো যে কোন আলোচনাতেই দাদার একটা স্পষ্ট বক্তব্য। সে রোগী নিয়ে আলোচনাতেই হোক অথবা ফেসবুকে আমার লেখালেখি নিয়ে।
ধীরে ধীরে সময় বয়ে যায়। কাজে অকাজে দেখা হয় আমাদের। ওয়ার্ডে, অপারেশন থিয়েটারে অথবা ইমার্জেন্সিতে। দাদাকে কখনো গম্ভীরমুখে দেখিনি।
সবসময়ই সে মুখে হাসি আর প্রাণবন্ত ব্যবহার।
বয়স বাড়লে সবারই জীবনে সমস্যা আসে। ব্লাড সুগার থেকে কিডনির জটিলতা শুরু হয় দাদার।
প্রথমে ডায়ালিসিস এবং অবশেষে তা কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট অবধি গিয়ে পৌঁছায়। এইসব গুরুগম্ভীর ঘটনার পরেও দাদাকে হাসিমুখে কাজ করতে দেখেছি হাসপাতালে। কিডনি ট্রান্সপ্লানটের পর মাস্ক পড়েও দীর্ঘদিন ওয়ার্ডে দেখেছি রুগী সামলাতে।কিডনি ডোনার জোগাড় করা থেকে অপারেশন পর্যন্ত শারীরিক আর আর্থিক টানাপোড়েনের কথা দাদার মুখ থেকেই শোনা।
একটু সাবধানে থাকার কথা বললে বলতেন, “কি করবো, ছেলেটার তো এখনো পড়াশোনা শেষ হয়নি। আর তারপর তো জানোই এই অপারেশন এবং তার পরবর্তী ওষুধপত্রের খরচের কথা। কাজ না করলে চলবে কি করে!”
অকাট্য যুক্তি। এরপরে আর কথা চলে না। বুকের দীর্ঘশ্বাস বুকেই রয়ে যেতো আমার। শুভেচ্ছা ছাড়া জানানোর আর কিছু থাকতো না তখন।
তাও সবকিছুই মোটামুটি ঠিক চলছিল এতদিন। কোভিড এসে ঘেঁটে দিল সব হিসেব।
আমরা সবাই যতটুকু সম্ভব সাবধানে কাজ করে চলেছি প্রথম দিন থেকেই। কিন্তু সবার শরীর সমান নয়। বিশেষত যারা ট্রান্সপ্লান্ট রোগী, তাদের দৈনিক এমন কিছু ওষুধ খেতে হয়, যাতে তাদের শরীরে যে কোন ধরনের সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেকটাই বেড়ে থাকে।
শুভাশিসদা প্রথম থেকেই চিন্তিত ছিলেন তা নিয়ে।
অপারেশন থিয়েটারেও কাজ করছিলেন খুব সাবধানে। কিন্তু ভাগ্য সবসময় সাহসীদের সহায়তা করে না।
একদিন আচমকাই খবর পেলাম দাদার কোভিড সংক্রমণের। দুশ্চিন্তা বাড়লো আমাদের সবার।
হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হওয়া পর সাধারণ রোগীদের থেকে অনেক বেশী সময় লাগলো দাদার ‘নেগেটিভ’ হতে। ডিসচার্জের পর বাড়িতে গিয়েও সুস্থ হতে পারছিলেন না। শ্বাসকষ্টজনিত শারীরিক অসুবিধা পিছু ছাড়ছিলো না কিছুতেই। আবার ভর্তি হতে হলো হাসপাতালে।
কোভিড ইনফেকশনের এখন নতুন বিপদ এই কোভিড পরবর্তী শারীরিক জটিলতা। নেগেটিভ হয়ে যাওয়ার পরেও শরীর যেন সুস্থ হতে চাইছে না। যে কোনো ভাইরাল ইনফেকশনের পরবর্তী সময়ে একটা সাধারণ দুর্বলতা থাকেই। সেটা ছাপিয়ে কোভিডের ক্ষেত্রে কষ্ট বাড়াচ্ছে ফুসফুসের জটিলতা। শরীর থেকে কোভিড বেরিয়ে গেলেও সংক্রমণের ছাপ রেখে যাচ্ছে ফুসফুসে। কাল হয়ে দেখা দিচ্ছে তা, মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে রোগীকে। এর পোশাকি নাম পালমোনারি ফাইব্রোসিস। বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায় ফুসফুস শুকিয়ে গিয়ে শরীরে প্রাণদায়ী অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেওয়া। তার উপরে দুর্বল শরীরে ঘটছে সুযোগ সন্ধানী ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ।
এছাড়াও অন্য শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপর পড়ছে এই জটিলতার নজর। দুর্বল হয়ে পড়ছে হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশি। অতি সম্প্রতি এই কারণে আমরা হারিয়েছি ‘কোভিড ওয়ারিয়র’ দুই চিকিৎসককে ।একজন আমারই ব্যাচমেট,কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালের ইউরোলজিস্ট। আরেকজন অপেক্ষাকৃত কমবয়সী ত্রিশোর্ধ এক ফিজিশিয়ান।দুজনেই মারা গেলেন কোভিড নেগেটিভ হওয়ার সপ্তাহ কয়েক পর। মৃত্যুর কারণও ঠিক একইরকম, সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট।
জটিলতা তাই ভয় বাড়াচ্ছে কোভিড পরবর্তী সময়ে।সবার নিশ্চয়ই হবে না বা হচ্ছে না। কিন্তু শতকরা হিসাব কিন্তু একদম ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আর হিসাবের খাতায় যাই লেখা থাকুক আপনার কাছে হয় সেটা শূন্য অথবা একশ ভাগ। হয় জটিলতা হলো নতুবা হলো না।
ডাক্তাররা রোগাক্রান্ত হচ্ছেন বেশী। ভাইরাল লোড বেশি থাকার জন্য কিনা তার সদুত্তর যদিও এখনো নেই।
ফিরে আসি শুভাশিসদার খবরে। দ্বিতীয়বার ভর্তির পর ওয়ার্ডে অবস্থার অবনতি হওয়ায় ক্রিটিকাল কেয়ারে স্থানান্তরিত করা হয়েছে এখন দাদাকে।পরীক্ষানিরীক্ষায় পাওয়া গিয়েছে আশঙ্কাজনক পালমোনারি ফাইব্রোসিস এবং তার উপর ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গিয়ে তিনি আপাতত ভেন্টিলেটরের সাপোর্টে।জীবনদায়ী ওষুধপত্র আর অ্যান্টিবায়োটিকের ঘেরাটোপে।
ক্রিটিকাল কেয়ারের ডাক্তারেরা ও কোন আশার কথা শোনাতে পারলেন না। ভীষণ অবসাদের একটা পরিমণ্ডল তৈরী হয়ে রয়েছে হাসপাতালের ডাক্তারদের মধ্যে। এই লড়াই এতদিন ধরে চালিয়ে সবার মধ্যেই ধীরে ধীরে ক্লান্তির ছাপ পড়ছে। বেশীর ভাগ ডাক্তার পজিটিভ হওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করিয়ে আবার নেগেটিভ হয়ে দ্রুত কাজে ফিরেছেন। তাদের বিপর্যস্ত শরীরও আর ধকল নিতে চাইছে না যেন। একটা ‘ওয়ার ফেটিগ ‘ হয়তো গ্রাস করছে সবাইকেই। তার উপর নিজেদের সহকর্মীকে, কে আর দেখতে চায় ভেন্টিলেটরের সাপোর্টে?
তাই আজ বেডের পাশে দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম অচেতন মানুষটার দিকে। অনেক কথাই অনুরণিত হচ্ছিল মনের ভিতরে। আর ভাবছিলাম, সারাজীবনের নানা টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া জর্জরিত শরীরটা পারবে কি এই লড়াইটা থেকে জিতে বেরিয়ে আসতে? নিজের শারীরিক অসুবিধার কথা জেনেও যে অকুতোভয় মানুষটা ঝাঁপিয়ে পড়লেন মহামারীর বিরুদ্ধে এই অসম যুদ্ধে, ভাগ্য কি সহায়তা দেবে তাঁকে? জানি না এর উত্তর।
কার্ডিয়াক মনিটরে চলন্ত লেখচিত্র আর বিপ বিপ আওয়াজ যেন শুধু প্রতি মূহুর্তে জানিয়ে যাচ্ছে মানুষটা এখনো বেঁচে। এখনো সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন দাদা।
অনেক আশঙ্কা বুকে জড়িয়ে বেরিয়ে এলাম হাসপাতাল থেকে। বাইরে হলদে রঙা বিকেল আর স্বাভাবিক কথোপকথনের ভীড়ে ভিতরের এক নাছোড়বান্দা চিকিৎসকের লড়াইয়ের কাহিনী শুধু বুকে কাঁটার মতো বিঁধে থাকলো আমার।
ভবিষ্যৎ কারো জানা নেই।
তবু আশা নিয়েই তো মানুষ বাঁচে।