শুনেছি আমি কাহিনি তিস্তা নদীর
দামাল মেয়ের ভরা যৌবন বরষায়,
হিমালয় থেকে আসে নেমে উচ্ছ্বাসে
প্লাবনে ভাসায় দু কূলের লোকালয়।
এ নদীর সাথে আমার সম্পর্ক বহুদিনের। তিস্তাপারের শহর জলপাইগুড়িতে জন্ম আমার।
সে অনেক কাল আগের কথা। ১৯৬৯ সালের অক্টোবর মাস। আমার সার্জন বাবা সে বার বদলি হয়ে আসেন পুরুলিয়া থেকে।
ঠিক তার আগে, অনেক বারের মতোই তিস্তা প্লাবিত করেছে জলপাইগুড়ি শহরকে। ভয়ানক বন্যায় ভেসে গেছে শহর আর মৃত্যু হয়েছে মানুষের। সেই পটভূমিতে বাবার আগমন ঘটে চাকুরী সূত্রে, জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে।
জন্মের পর যখন কিছুটা বোধোদয় হলো আমার, তখন থেকেই শুনেছি সে সব কথা। তিস্তা নদীর ভয়াল রূপ আর মানুষের প্রাণহানির গল্প। তাই ছোটবেলা থেকেই বুঝি বা না বুঝি সেই নদী সম্পর্কে একটা ভীতি মনের মধ্যে তৈরি হয়েই গিয়েছিল।
যখন বড় হলাম আরেকটু, বাড়ি বদল করে এসে পৌঁছানো হলো তিস্তা বাঁধের পাশে, ব্রিটিশ আমলের তৈরি লাল ইঁটের বিশাল সি এম ও এইচ বাংলোয়, তখন থেকেই মন পরিবর্তন হতে শুরু করলো। এই বাঁধটি কিন্তু তৈরি করাই হয়েছিল, ভরা বর্ষায় তিস্তার জলে বানভাসি হওয়া থেকে শহরটিকে বাঁচাতে।
ছোট্ট একটা লাল রঙা সাইকেল নিয়ে দারোয়ান অথবা বাড়ির বড়দের চোখ এড়িয়ে তাই সুযোগ পেলেই উঠে পড়তাম সেই বাঁধের উপর। মনে হতো সেখানে দাঁড়িয়ে দুই চোখ দিয়ে হয়তো দেখা সম্ভব হতে পারে দূরের তিস্তা নদীটিকে।
কিন্তু হা হতোস্মি! সেই নদীও ছিল আমার ছোট্ট দৃষ্টিপথের বাইরে ।
অনেকটা বালির শুকনো চর পেরিয়ে পৌঁছাতে হত সেখানে। বর্ষা বিহীন নিস্তরঙ্গ সে নদী ছিল আলস্যে শুয়ে থাকা কোন এক সামান্য জলপথ মাত্র। এদিক ওদিকে কিছু যাযাবর শ্রেণীর মানুষ ছাড়া তার ধারেকাছেও কেউ যেত না।
জলপাইগুড়ি শহর ছেড়ে আসার পর সে নদীর সাথে আমার দৈনন্দিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও স্মৃতিতে সে ছিল অটুট। অনেকটা প্রথম প্রেমের মতো। ভোলা যায় না একেবারেই।
তাই উত্তর বঙ্গ যাতায়াতের পথে যেখানেই সুযোগ পেতাম, চোখ ভরে দেখে নিতাম সেই সবুজ চোখের সুন্দরীকে।
এইবারেও তার অন্যথা হলো না। দার্জিলিং শহর থেকে বেরিয়ে ঘুম আর জোড়বাংলো পেরিয়ে বাঁদিকে পেশক রোড ঘুরে গেছে। সে রাস্তায় কালিম্পং যাওয়া যায় তিস্তাবাজার হয়ে। সকাল সকাল তাই বেরিয়ে পড়লাম সে রাস্তা ধরে। আজ সারথি আর গাড়ি দুটোই জুটেছে নতুন। টয়োটা ইনোভার পরিবর্তে মাহিন্দ্রা জাইলো। একটু খাড়া রাস্তার জন্যই নাকি এই পরিবর্তন, জানালো ড্রাইভার।
তবে আবহাওয়ার অবশ্য কোন পরিবর্তন নেই। মাঝে মাঝে মেঘলা সকালে রোদ্দুর উঁকি মারছে বটে তবে বেশিরভাগ সময়ই আকাশ মেঘে ঢাকা। এতটাই যে, মূল রাস্তা মেঘ আর কুয়াশার চাদরে ঢেকে গিয়ে মাঝেমধ্যেই ‘ভিসিবিলিটি’ প্রায় শূন্যের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। কিছুটা পরেই সামান্য পরিষ্কার হচ্ছে যাত্রাপথ। কিন্তু আবার যে কে সেই। আচমকা বৃষ্টি এসে আবার পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে দিয়ে যাচ্ছে।
এসব নিয়েও এগিয়ে চলেছে গাড়ি।পথে দেখা হলো লামাহাট্টা, খানিক জিরিয়ে আর দোকানের মোমো সেবন করে এগিয়ে চলা এবার তিনচুলের দিকে।
মূল রাস্তা দিয়ে কিছুটা উপরে উঠতে হয় সেখানে। চা বাগানের ভিতর দিয়ে উঠে যাওয়া রাস্তা ভারি দৃষ্টি নন্দন। ছোট্ট রাস্তার পাশের দোকানে চা খেয়ে আবার এগিয়ে চলা পেশক রোড হয়ে তিস্তাবাজারের দিকে। আমাদের আজকের মূল গন্তব্য সেখানেই।
পাহাড় থেকে যতই নামা হচ্ছে সমতলের দিকে উপরের কুয়াশা আর মেঘে মাখামাখি বুড়ো পাইন আর সিডারের সাথে পরিবর্তন ঘটছে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলের। সেখানে এখন শুধুই শাল, সেগুন আর শিরিষের সংখ্যাধিক্য, তার সাথে জুটেছে যত পোকাদের তীক্ষ্ণ গলার আওয়াজ। ঝলমলে রোদ্দুরের তেজ বাড়ার সাথে সাথে উধাও হয়েছে কুয়াশা আর লাগছে গরম। সোয়েটার খুলে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে সকলে। চলার পথ চড়াই-উতরাইতে বেশ পরিপূর্ণ। ড্রাইভার নিপুণ কৌশলে পেরিয়ে যাচ্ছেন রাস্তার সব চ্যালেঞ্জ।
পেশক রোড সমতলে নেমে পাহাড়ের তলদেশ ঘেঁষে এবার বাঁদিকে ঘুরে যাচ্ছে।কালিম্পঙ যাওয়ার পুরনো আধভাঙ্গা মিলিটারি ব্রিজকে ডানপাশে রেখে। মিনিট পাঁচেক সেই ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে গাড়ি এগিয়ে গেলেই এসে পড়বে ত্রিবেণী। তিস্তা আর তার মূল উপনদী রঙ্গিতের মিলন স্থল।
গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম তিন জন। ছোট একটা বাজারের পাশ দিয়ে বেলাভূমির দিকে এবার এগিয়ে যাওয়া। বালিয়াড়ির পথে পড়বে বেশ কয়েকটি দড়ি বাঁধা টেন্ট। ক্যাম্পিং এর জন্য তৈরি এখানকার সবাই। এই অঞ্চলেই নদীবক্ষে হয় হোয়াইট ওয়াটার র্যাফটিং। আমাদের নজর সেদিকে ছিল না। আমরা এগিয়ে গেলাম তিস্তা আর রঙ্গিতের সঙ্গমস্থলের দিকে।
নদী দুটি সুদূর হিমালয় থেকে বয়ে এনেছে একরাশ নুড়ি পাথর। তীরবর্তী অঞ্চলের সীমানা তৈরি করেছে সেগুলি। সেখানেই জুতো খুলে বসে পড়লাম আমরা। কুলু কুলু শব্দে দুই নদী এসে মিশেছে এখানে। নীল নয়না রঙ্গিতের সাথে মিলন ঘটেছে সামান্য ঘোলাটে ধুলোমাখা তিস্তার। যদিও দুই নদীর দুই রঙের জলধারা এখানে পরিষ্কার দৃশ্যমান। রঙের সাথে রঙ মিশে যেমন নতুন রঙ সৃষ্টি হয়, ঠিক তেমন ভাবেই দুই রঙ মিলে তিস্তার পরবর্তী ধারার রঙ হয়ে গিয়েছে সবুজ। আমার সেই সবুজ নয়না সুন্দরী!
এই তিস্তাই চলে গিয়েছি আরও দক্ষিণে, ছুঁয়ে গেছে তিস্তাপারের আরেক শহর জলপাইগুড়িকে।
যে নদীর তীরে এককালে ছিল আমার বাসস্থান।
সেকথা ভাবতে ভাবতে কাঁচের মতো স্বচ্ছ ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে আস্বাদন করলাম চারিদিকের প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যকে। সঙ্গম স্থলের তিনদিকে তিন পাহাড়। একদিকে দার্জিলিং, অপরদিকে কালিম্পং আর অন্যদিকে সিকিম। শান্ত নিরিবিলি সেই পরিবেশে কেবলই কানে আসছে বয়ে যাওয়া নদীর শব্দ। যেন আপন মনে দুই সখীর কথা বলে চলা।
পাশাপাশি ক্যাম্পিংয়ের মানুষ জন আছেন। রঙ্গিতে ছিপ ফেলা চেষ্টা চালানো হচ্ছে ট্রাউট মাছ ধরার। রাতের ক্যাম্প ফায়ার হয়তো জমে যাবে ধরতে পারলে।
আমাদের অবশ্য অতক্ষণ অপেক্ষা করা সম্ভব হবে না। কুয়াশা আরও ঘনীভূত হওয়ার আগেই ফিরে যেতে হবে পাহাড়ে। নয়তো বিপদ ঘটতে পারে যে কোন মুহূর্তে। তাই যতক্ষণ সম্ভব ততক্ষণ প্রাণভরে দেখে নিলাম দুই নদীকে।আর আত্মস্থ করে নিলাম প্রকৃতির এই অসাধারণ পরিবেশকে।
কি আপন মনে দুই ভিন্ন ধারা মিশে গেছে একসাথে। দুই ভিন্ন রঙের নদী নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে মিলে এক হয়ে যেতে পারে অথচ মানুষ কেন যে পারে না?
কুয়াশা আর রাস্তার যাবতীয় বিপদকে পেরিয়ে হোটেলে ফিরতে ফিরতে,এই প্রশ্নের উত্তর অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পেলাম না।
তবে এই মাঝবয়সে এসে খুঁজে পেলাম আমার প্রথম জীবনের ভালোবাসাকে। আমার সবুজ রঙা তিস্তা নদীকে! স্মৃতির মনিকোঠায় এই উজ্জ্বল অভিজ্ঞতা রয়ে যাবে আমার বাকি জীবনকাল।
তাই বা কম কি?