(লেখার পটপ্রেক্ষিত মাস চারেক আগের। এ কথা গোড়াতেই বলে রাখা ভালো। নতুবা গড়বড় ঠেকতে পারে ফেসবুকের আঙ্গিকে।
এটা যে সময়ের ঘটনা, তার ঠিক পরপরই বাড়ি গিছলাম আমি। সময়টাকে আরো একবার ঘুরে দেখতে ইচ্ছে হল করোনা-কালে। তাই… লিখলাম।)
◆◆◆◆◆◆◆◆
মা গেছে পুরী ঘুরতে। সঙ্গে ছোটো মাসিমণি, মেসোমশাই আর ওদের এক আত্মীয়। সে যাক। ঘুরুক মজা সে সবাই মিলে দিনকতক। কিন্তু আমার যে মনকেমন হয়। সে মনকেমন কতখানি মায়ের জন্য আর কতখানি ভ্রমণের নিমিত্ত, সেসব যদিও বুঝে উঠতে পারি না।
… জানিও না। কিন্তু হয়।
আমার হাসপাতালে এক কর্মচারী ছিল। তপনদা। গ্রুপ ডি। বয়সে সুবীরদার প্রায় কাছাকাছি। সুবীরদা আমাদের ফার্মাসিস্ট। এ বছরেই রিটায়ারমেন্ট। আর তপনদা রিটায়ার করেছে গত বছরে। দু’জনে এক ঘরেই বসতো পাশাপাশি। ওষুধ পত্তর কাটাকাটি, খাতার সাপ্তাহিক হিসেব মেলানো, আউটডোরের টিকিটে নাম লিখে দেওয়া। এইসব। আর তারই মাঝে চলতো ছোট্ট গেরস্থালী। পান বানাতো তপনদা। চুন সুপারি, মৌরী, বাংলা পাতা। বানিয়ে, তারপর দু’জনে ভাগটাগ করে খেত। গপ্পো করতো টুকটাক। রোগীপত্তর কমসম থাকলে, আমিও কোনো কোনোদিন আউটডোরের চেয়ার ফেলে, সেই ঘরে এসে সেঁধোতুম। দেখতুম– পান বানাচ্ছে তপনদা।
কিছু কিছু মানুষ থাকে, যারা বড্ডো সাদামাটা হয়। সাদাসিধা নয় কিন্তু। বিষয় বাসনা আছে পরিপূর্ণ। কিন্তু সাদামাটা। চারপাশটা আর সবকিছুটা যাদের বড়োই ছোটোখাটো জাগতিক রসনা দিয়ে সঞ্জীবিত।
— “আর পাঁচটা মাস। বুঝলে হে সুবীর…” তপনদা বলতো পান বানাতে বানাতে। তপনদার তর্জনী ফুটিফাটা। তার খাঁজে খাঁজে শুকনো সাদাটে চুনের কলঙ্ক। সেই আঙুলটাই পানের গায়ে ঘষছে সটাসট। টুকরো টাকরা শুকনো চুণের দলা ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে বেছেবুছে। আর তারপর আবার ঘষছে। স্রেফ ওই ঘষাটুকু দেখতেই আমার ভারী ভালো লেগে যেত। মনে হত – যেন একটা আস্ত একটা মানুষ জড়িয়ে মড়িয়ে মাখামাখি আছে অন্নে, শস্যে, দুপুর আলস্যে। চুলে গন্ধতেল। পরনে দর্জির বানানো হাফশার্ট। দাঁতে, গৃহস্থের কুবাস।
— আর পাঁচটা মাস। বুঝলে হে সুবীর.. তারপর কাশী বেনারস যাবো। ঘুরতে। ওর মা কতদিন ধরে বলতেসে…। এইবারেহঃ যাবো। বাড়িঘরদোর ছেলেদের হাতে ফেলে থুয়ে। আর তো পাঁচটা মাস…। বলো?
শুনে আমি অবাক হয়ে যেতাম। বেনারস শুনলেই আমার মনে পড়ে যেত একটি মায়া ভরপুর ছেলের মুখ। আর কিছু কবুতর। ভোরের ঘাটে, দানা খাচ্ছে ঘাড় নাচিয়ে নাচিয়ে আর ডাক দিচ্ছে ঘুঙুর ঘুঁ। কথকঠাকুরের হাত ধরে সেই ছেলেটিই গিছলো একবার আধ-অন্ধকার একখানি দালান বাড়িতে উঠোন পেরিয়ে। পেতলের লোটাতে জল, আটার মোটা মোটা পুরী, বেগুনের বিস্বাদ ঘন্ট আর খটখটে শক্ত লাড্ডু। কথকঠাকুরকে সে বলেছিল– কালে বর্ষতু পর্জন্যং জানেন আপনি? বলুন না একটিবার। আর শুনতে শুনতে ভেবেছিল– বাবার গলাতে শোনায় ভালো। কথকঠাকুরের গলাটি বড় মোটা।
সেইইই বেনারস? সেখানে এখনও লোকজন যায় বুঝি? হেদিয়ে মরে কাশী দর্শনের লোভে? তপনদার কথা শুনে আমি হ্যা হ্যা করে হাসতাম। “আপনিও যেমন তপনদা! কাশী যাবেন! ধুর! বরং হিমাচল ঘুরে আসুন একবার। বৈষ্ণৌ দেবী টেবি..”
তপনদা বোকার মতো মুখ করে তাকাতো। আউটডোর সেদিন হয়তো শেষ হবো হবো। দু চারটে যা রুগী পত্তর এসে পৌঁছচ্ছে আয়াগিরি বা কামলাখাটা শেষ করে, ছেড়ে দিচ্ছি ওই ঘরথেকেই টপাটপ। তারপর এগিয়ে এসে বসছি তপনদারই পাশের চেয়ারে জুত্টি করে। একথা ওকথা সেকথা। কথায় কথায় জীবন সমুদ্দুর।
–” কাকে বলছেন আপনি? হ্যাঁ? বলেন তোঃ! জানেন, তপন এখনো কোলকাতা দেখেনি?” সুবীরদা বললো ।
–” হ্যাট! হ্যাঁ তপনদা? সত্যিই?”
তপনদা আরো জড়সড়ো হয়ে যেত। মুখ ফিরিয়ে দেশলাই কাঠি দিয়ে পানের ছিবড়ে বের করে আনতো দাঁতের ফাঁকের। হাসতো হেঁ হেঁ।– “বাড়ি করে দিসি ছেলেদের। এবার সব দেখব। কলকাতা দিয়েই কাশী যায়…তাই না? ডাক্তারবাবু?”
আমার পুনরায় মনে পড়ে যেত কথকঠাকুরের কথা। পুতুল, খেল্না, শিবলিঙ্গ, মালা, কাঠের কাঁকই জমিয়ে রেখেছিলেন তিল তিল করে। দেশে লইয়া যাইবার জন্য। সবাই যখন বলবে কি এনেচ দেখি… তখন পোঁটলা খুলে বাহির করিবেন একের পর এক আশ্চর্য্য দ্রব্য। কাশীর জিনিস। কা-শী-র…
ক্ষণিকের চটকা ভেঙে যেত সুবীরদার হাসিতে। ঠান্ডা পড়েছে তখন। গভীর শীতের ঋতু। সমস্ত দিনমান বিষাদী কুয়াশা ছড়িয়ে থাকে ঘোলাটে ছানির মতো চরাচরে। জাঁড় লাগে বড্ডো। শীতলতা অনুভূত হয় হাড়ে ও মজ্জাতে। সরকার প্রদত্ত রুম হিটার জ্বলছে কমলা হয়ে একখানা। আর আমরা তিন প্রাণী। কাছাকাছি। ঘরে, ছাঁচি পানের হালকা সুবাস।
সুবীরদা হাসছে। হাতে হেলমেট। আড্ডা ভেঙে উঠবার তোড়জোড়। অথচ মাঘের শীতে জুবুথুবু অলসতা।
–“তপনকে জিগ্যেস করুন। বাড়ির দরজার কথা। বলো বলো তপন। শুনিয়ে দাও একবার! পাগলামির কান্ডটা তোমার।”
আমার দু’চোখে ভুরু তোলা জিজ্ঞাসা। তাইতে ছোঁয়াচ লেগেছে সুবীরদার কৌতুকের।
–“কী ব্যাপার! কী ব্যাপার? তপনদা? দরজাতে?”
তপনদা মাফলারটা জড়িয়ে নিতো। সাইকেলের চাবিটা মুঠোতে নিয়ে হাসত ভালোমানুষের মত। সাইকেল তপনদা চালাতে পারে ভালোই। কিন্তু সাহস নেই। ভীরু ভীতু গোবেচারা মানুষ। এক ফার্লং দূরে রিক্সা দেখলেও নেমে পড়ে ঝপ করে। ফলত, প্রায় পুরোটা রাস্তা পদব্রজেই। বাড়ি থেকে হাসপাতাল। হাসপাতাল থেকে বাড়ি। হোক না হোক মাইল চারেক চোখ বুজে। তপনদা। হাফশার্ট। মাফলার। আর সাইকেল। হেঁটে যাচ্ছে ভয়ে ভয়ে। হাঁটবে… আরো পাঁচটা মাস। তারপর ম্যাজিক। কাশী বেনারাস দশাশ্বমেধ। রিখটার্সভেল্ট কিংবা উত্তমাশা অন্তরীপের চাইতেও নতুন জিনিস ভূমন্ডলের।
–“ছেলেরা বলসিলো! আর বলেন ক্যান! ছেলে ছোকরার কারাবার! তো…দিছি। লাগায়ে দিছি। সেই যে কাচ হয় না? ভিতর থেকে দ্যাখা যায় বাহ্রে? দরজায় লাগায়? তা…দিছি। দুই ছেলের শোবার ঘরেতে দুইখান কাচ। সাতশ টাকা পড়লো। তা পড়ুক। ওরাই তো দেখেদুখে রাখবে ঘরটা…”
এসব শুনে আবার হাসি। সমবেত। আমার আর সুবীরদার। — “ও তপন্দা.. ওওওও তপন্দা.. এগুলোতো আই হোল! সদর দরজায় লাগায়। আপনি ভেতরের ঘরেও….”
তপনদা উত্তরে হাসতো। ওই একই রকম। লজ্জা লজ্জা আর বেয়াকুবের মতো। যেন আনাড়ি হাতে নকল করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে। এক্সপেল হলেই উচ্চমাধ্যমিকের ডিগ্রি বাতিল। দাম পড়ে যাবে পাত্রপক্ষের কাছে। ঠিক যেন আমার মা। ফোনের ওপারে বলছে আবদারী কণ্ঠে –“একবার দার্জিলিংটা আমায় ঘুরিয়ে আন বেটা। আর কিছু চাই না..”
অথচ এর মধ্যে আহা করবার কিছুটি নেই। দার্জিলিং মায়ের দিব্যি ঘোরা। নেপাল ভূটান জলদাপাড়া দীঘা পুরী… অনেক কিছুই। তবুও মা বলে। বলে…কারণ এসব দেখেছিল আধেক-মধুচন্দ্রিমা বয়সে। তখন আমি চার, সাত কিংবা এগারো। যেসব বয়সের স্মৃতি আমার মায়ের চাইতেও তীব্র। তারপর আমার মাধ্যমিক। উচ্চ মাধ্যমিক। ” এ বছরটা থাক্! সামনে পরীক্ষা!” এবং শেষমেশ আমি মেডিক্যাল কলেজ। মা-বাবা পুরুলিয়া।
“থাক! পার্থবেটু এলে ঘুরবো তিনজনে”
পার্থবেটু আর আসে না। তার অনেক কাজ। পড়াশুনা, প্রেম, রক্তস্নাত রাজনীতি। ক্রমে, বাবা মরে যায়। চাকরি ততদিনে পার্থবেটুর সরকারি। নতুন করে ঘোরা আর হয় না। ছুটি নেই। থাকলেও…তাইতে ভ্রমণ নিজস্ব। তাই মা বলে। ঘুরতে যাওয়ার কথা। একসাথে। জায়গাগুলোর নাম অবশ্য পাল্টে যায় মাঝেমধ্যেই।
“একবার তাজমহল দেখাস আমাকে।”
‘মানালি যাবো একবার। বুঝলি? বরফ পাওয়া যায় ওখানে”
“রাজস্থানে তো খুব গরম, বল্!”
আর আমি বুঝতে পারি, সদ্য কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর মুখে শুনেছে এসব কথা। তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এসব কথা বলছে। পাত্তা দিই না। রক্ত গরম আমার। ঘুরে নিতে হবে টাংলাং লা, গুরুদোংমার অথবা উঁচু উঁচু সিড়ি ইলোরার। মা পারবে না ওখানে। আমারই হাঁফ ধরে যায়। বাবাহঃ! মাকে নিলেই হলো আর কি!
তারপর ক্রমশ বয়স বাড়ে। বাড়তে থাকে মায়া। কমতে থাকে উষ্ণতা রক্তের। ঠাকুমাও বলেছিল শুনেছি। বাবাকে।
–“তর রক্তের গরম কমুক রামু..। বুঝবি তখন…।”
এভাবেই বোধহয় সকলে বোঝে। যে বয়সে যেইটা বুঝতে পারার। এতে অধোবদন হওয়ার কিছুটি নেই যদিও। মনুষ্য তো বৃদ্ধ না হইলে সুন্দর হয় না। আমিও তাই বুঝতে পারি অল্প স্বল্প। আবার পারিও না। রক্ত ঠান্ডা হতে সময় লাগবে। কিংবা হচ্ছে। ডাক আসছে, তীব্র হচ্ছে ক্রমেই বাড়ি ফিরবার। ফিরে যাওয়ার। ভিটেতে।পিতৃপুরুষ। পুরুলিয়ায়। তারপর হয়তো এসব জায়গাগুলোতেই মাকে নিয়ে যাবো একবার একবার করে। কিম্বা হয়তো সম্ভব হবে না। মা মরে যাবে তার আগেই। অথবা আমি। অথবা শুভ্রা। তবুও… ইচ্ছেগুলো থেকে যাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ভেজা একটা পাহাড়ি বাঁকে নামছি আমরা। মা বলছে–” আস্তে পার্থ.., পেছনে জিপগাড়ি।” শুভ্রা হাসছে খিলখিল। আর আমি ক্যামেরা তাক করে হিমালয় গাঁথছি।
থেকে যাবে। এইসব। ইচ্ছেগুলো।
এগুলোর নামই পৃথিবী। এগুলোই ভালোবাসা।
থেকে যাবে।
নেপথ্যে কেউ হেঁকে হেঁকে যাবে আশীর্বচন। এঁকে দেবে তাবৎ নিরাময় আশ্বাস আমার প্রতিটি রোগীর প্রতি। লিখে দেবে আমার পরিবারের নিষ্কন্ট ভবিষ্যৎ। সে জন, হয়তো বা আমার লোকায়ত পিতৃদেব স্বয়ং নিজেই।
কালে বর্ষতু পর্জন্যং পৃথিবী শস্যশালিনী
লোকা সন্তুঃ নিরাময়ঃ……..
( ছবিটা, আমার পুরুলিয়ার বাড়ির ছাদের)