চিন্ময়দা ( ডাঃ চিন্ময় নাথ) মেয়েদের বয়স নিয়ে লিখেছেন। তাতে আমার দেখা এক রোগীর প্রসঙ্গ এসেছে। চিন্ময়দার মতো হয়তো লিখতে পারব না, কিন্তু এই বয়স নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা প্রচুর। শুধু মেয়েদের বয়স নিয়ে লিখলে নারী-বিদ্বেষী তকমা জুটে যেতে পারে, তাই প্রথমেই ছেলেদের বয়স দিয়ে শুরু করি।
একরাতে মধ্যমগ্রাম হাই স্কুলের উল্টোদিকের খুপরিতে রোগী দেখছি, এক বয়স্ক থুড়থুড়ে বুড়োকে তাঁর স্ত্রী ধরে ধরে সাবধানে নিয়ে এলেন। বৃদ্ধ মোটামুটি অসুখের ভাণ্ডার। একজন এম বি বি এস ছাত্র এরকম রোগী পেলে অর্ধেক ডাক্তারি শিখে যাবে। বৃদ্ধের সুগার আছে, প্রেশার আছে, হার্টের অসুখ আছে, দুবার সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়েছে। পারকিনসনিজম আছে- কোনো কিছু করতে গেলেই ভয়ানক হাত কাঁপে। ডিমেনসিয়া আছে- ভুলে যাচ্ছেন সব কিছু। এমনকি নাম জিজ্ঞাসা করলেও ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকছেন।
এ তো গেল মেডিসিনের দিক। ওনার সার্জিকাল সমস্যাও আছে। দুপাশের কুঁচকিতেই হার্নিয়া। গল ব্লাডার পাথরে ভর্তি। প্রস্টেট মোটামুটি পিংপং বল সাইজের। তিনি কানেও ভালো শোনেন না, চোখেও ভালো দেখেন না।
তা এহেন হ্যারিসন ও বেইলি লাভের জীবন্ত সংস্করণের বয়স জিজ্ঞাস করে চমকে গেলাম। ওনার স্ত্রী বললেন, চুয়ান্ন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, চুয়ান্ন না চুয়াত্তর কোনটা বললেন?
ভদ্রলোকের স্ত্রী প্রতিবাদ জানালেন, না ডাক্তারবাবু, ওনার এখনও ৬ বছর চাকরি বাকি আছে। বার্থ সার্টিফিকেট দেখাবো… এই যে আমার কাছে জেরক্স আছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, এখনও চাকরি করেন? কীসে চাকরি করেন?
উনি সরকারি স্কুলের ইতিহাস টিচার। স্কুল খোলা থাকলে আমিই ধরে ধরে স্কুলে নিয়ে যাই। ক্লাস চলাকালীন বাইরে বসে থাকি।
উনি এখনও ক্লাস নেন? আমি অবাক হতেও ভুলে যাই। যিনি নিজের নাম ভুলে যাচ্ছেন, তিনি কী করে প্রথম পানিপথ, দ্বিতীয় পানিপথ যুদ্ধের দিনক্ষণ, পাত্র পাত্রীর কথা মনে রাখবেন।
একটু ধমক দিয়েই বললাম, ঠিক ঠাক বয়স বলুন। না হলে ওষুধ পত্রে গণ্ডগোল হবে।
ওনার স্ত্রী বললেন, বয়স আর বাড়ানো যাবে না। আপনার প্রেসক্রিপশনের জেরক্স স্কুলে জমা দিতে হবে। চাকরিতে সমস্যা হবে। আপনার তো একটা বিবেচনা আছে। আপনি সত্তর পেরিয়ে গেছে ভেবে ওষুধ লেখেন।
বিবেচনা করে দীর্ঘশ্বাস চেপে ওষুধ লিখি। সরকারি স্কুলে ছুটি ছাটা বাড়ায় কাদের সুবিধা কাদের অসুবিধা হয়েছে সেটা বিতর্কিত ব্যাপার। তবে এনার বিলক্ষণ সুবিধা হয়েছে।
আমার গ্রামে আর শহরে দু জায়গাতেই ডাক্তারি করার অভিজ্ঞতা আছে। শহরে মেয়েরা বয়স কমিয়ে বলেন, গ্রামে আবার উল্টো। সেখানে মেয়েরা বয়স বাড়িয়ে বলেন।
প্রত্যন্ত গ্রামে অধিকাংশ মেয়েরই কম বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। খুব কম মেয়েই অবিবাহিত অবস্থায় আঠারো বছর পার করে।
কিন্তু এই সব বালিকা বধূদের বয়স জিজ্ঞাস করলেই তারা বলে আঠারো- কুড়ি। সরকারি ডাক্তারকে গ্রামের মানুষেরা বেশ ভয় পান- সমীহও করেন। তাঁদের ধারনা পনেরো বছরে বিয়ে হয়েছে শুনলে ডাক্তারবাবু পুলিশ ডেকে বাবা- মা সমেত বর- বউকে জেলে ঢুকিয়ে দেবেন। গণ্ড গ্রামে মানুষের বয়স হয় কুড়ির গুণিতকে- এক কুড়ি, দুই কুড়ি, তিন কুড়ি…। মাঝা মাঝি কোনো বয়স নেই। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের ২৭, ২৯, ৩২, ৩৮ এরকম বয়স হয়না কখনো। সবে কুড়ি পেরনো তরুণীকে বয়স জিজ্ঞাস করলে সে অবলীলায় বলে দেয় দুই কুড়ি।
শহরে আবার তাঁর উল্টো। এখানে মেয়েরা অনেকেই বয়স কম করে বলেন, এতোটাই কম মাঝে মাঝে চল্লিশোর্ধ মহিলা খুকি হয়ে যান।
কয়েকদিন আগে আমার এক সহপাঠিনী দেখাতে এসেছে। আগের ডাক্তারবাবুর প্রেসক্রিপশনে বয়স লেখা তেত্রিশ। দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, আমরা দুজন এক বছরেই মাধ্যমিক দিয়েছিলাম না?
হ্যাঁ তো।
আমি তো বুড়ো হতে চললাম, তুই তরুণী রয়ে গেলি কী করে?
সেই সহপাঠিনী হাসে। বলে, তোর কাছে আমি একচল্লিশ। আসলে ওই ডাক্তারবাবু আমাকে চেনেন না তো।
একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক দেখাতে এসেছেন। অনেকদিন ধরেই আমাকে দেখান। মাঝে মাঝেই আসেন। নতুন প্রেসক্রিপশনে আগেটার থেকে নাম, বয়স টুকছি, ভদ্রলোক বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনিই একমাত্র ডাক্তার, যার কাছে চিকিৎসা করলে বয়স বাড়ে না।
আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে?
দশ বছর ধরে আপনাকে দেখাচ্ছি। তখন বয়স ছিল পঁয়ত্রিশ। এবারের প্রেসক্রিপশনেও আমার বয়স পঁয়ত্রিশ।
এই হলও টুকলি করার বিপদ। দশ বছর ধরে ভদ্রলোকের আর বয়স জিজ্ঞাসা করিনি। আগের প্রেসক্রিপশন থেকে কপি পেস্ট করে গেছি।