জ্বরের রোগী দেখতে দেখতে ফোন ধরা উচিৎ নয়। কিন্তু কেউ যদি একটানা ফোন করে, করেই যায়; তখন কী করবো?
বাধ্য হয়ে স্টেরিলিটির পিণ্ডি চটকে ফোন কানে লাগালাম। ওপাশ থেকে মার্জিত গলা, ‘স্যার একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
‘সংক্ষেপে বলুন। আমি ব্যস্ত আছি। রোগী দেখছি।’
‘হ্যাঁ বলছি। আমার এক আত্মীয়ের করোনা হয়েছে। বাড়িতেই আছেন। আমি যদি তার সাথে ফোনে কথা বলি তাহলে কি আমার করোনা হতে পারে?’
আমি বাক্যি হারা হয়ে গেলাম। এ প্রশ্নের কি উত্তর দেব! ড্রপলেট ইনফেকশন শুনেছি, vector-borne ইনফেকশন শুনেছি, জল বাহিত ইনফেকশন শুনেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ বাহিত ইনফেকশনের কথা শুনিনি।
জিভের ডগায় চলে আসা গালাগাল সামলে কোনরকমে বললাম, ‘ইঁচিবুচো কালা।’
ভদ্রলোক উৎকর্ণ, ‘এটা কি বললেন?’
‘আপনি কি কাজ করেন?’
‘সরকারি চাকরি। নবান্নে আছি।’
‘তাহলে আমায় এসব না বলে দিদিকে বলুন।’ ফোনটা কেটে মোবাইল সুইচ অফ করে দিলাম।
জ্বরের রোগীটি এতক্ষণ উসখুস করছিলেন। এবার মুখ খুললেন, ‘আচ্ছা ডাক্তার বাবু, RNA ভাইরাসের রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ এনজাইম নষ্ট করার জন্য কোনটা ভালো; কাঁচা হলুদ বাটা না আদা বাটা?’
আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।
‘কতটা গরম খেলে করোনা ভাইরাসের ক্যাপসুল নষ্ট হয়ে যায়?’
আমি বললাম, ‘আপনি আমাকে দেখাতে এসেছেন কেন? পতঞ্জলির করোনিল তো ছিল।’
ভদ্রলোক স্বচ্ছ ক্যাপে ঢাকা মাথা নাড়ালেন,’না না, ডাক্তার বাবু, আমি সাইন্সের ছাত্র। ওসব বুজরুকি বিশ্বাস করি না।’
আমি বললাম, ‘বুজরুকি আর সিউডো সাইন্স বুঝি আলাদা? থালা বাজানোর কম্পাঙ্কে কিভাবে করোনা ভাইরাস ধ্বংস হয়, তাই নিয়ে একাধিক জার্নালে পেপার বেড়িয়ে গেছে।’
নাক ও গলার সোয়াব কোভিড- ১৯ পরীক্ষার জন্য লিখলাম। উনি বললেন, ‘আমার নিশ্চয়ই করোনা হয়নি, কি বলেন?’
বললাম, ‘এর পেছনেও কি আপনার কোনো বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা আছে?’
‘ডাক্তারবাবু, করোনা হলে কি করব? কোথায় যাব? টিভিতে সারাক্ষণ দেখাচ্ছে কোনো হাসপাতালে বেড নেই। ভেন্টিলেটর ফাঁকা নেই। বিনা চিকিৎসায় রোগীরা মরে যাচ্ছে।
‘মরণ কালে হরির নাম করলে এর চেয়ে ভালো কিছু হয় না। সরকারি হাসপাতালে পরিকাঠামোর অভাব নিয়ে বহুকাল ধরে চিকিৎসকরা চেঁচিয়েছেন। জনগণ তাঁদের পিটিয়ে হাতের সুখ করেছেন। আর সরকার মেলায় খেলায় টাকা বিলিয়েছে।’
‘আচ্ছা ডাক্তার বাবু, করোনা হলে আমি কি মরে যাব?’
বললাম, ‘আপনার তো অন্য কোনো অসুখ নেই। ভাগ্য খুব খারাপ না হলে মরবেন না।’
ভদ্রলোক আহত দৃষ্টিতে তাকালেন, ‘আপনি একজন ডাক্তার হয়ে ভাগ্যের হাতে আমার জীবনটা ছেড়ে দিচ্ছেন?’
হাসলাম, ‘শুধু আপনার জীবন নয়, নিজের জীবনটাও ছেড়েছি। আপাতত ভাগ্যের চেয়ে ভরসাযোগ্য কিছু পাচ্ছি না। দয়া করে এর পেছনে কোনো বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা জানতে চাইবেন না।’
পুরোটাই তিনদিন আগের ঘটনা। আজ সেই রোগী কিছুক্ষণ আগেই ফোন করেছিলেন। ওনার কোভিড– ১৯ ধরা পড়েছে। বললাম, ‘টেনশন করছেন নাতো?’
‘না ডাক্তারবাবু। এখন একেবারে চাপমুক্ত লাগছে। জ্বরটাও আর আসছে না। সকালে গরম জলের সাথে পাতিলেবু, তারপর কাঁচা রসুন, দিনে চারবার স্নান- ওভাবে ভয়ে ভয়ে বাঁচা যায় নাকি?’
বললাম, ‘তাহলে এদ্দিন আমার মাথাটা কেন খারাপ করছিলেন? ইঁচিবুচো কালা…’
sir,
এই লেখায় ‘সরকারি’ চাকুরে term টা খুব important। এরা ‘গরম জলে পাতিলেবু’ থেকে শুরু করে যত আজগুবি পন্থা ব্যবহার করছে আর তার পেছনে আজগুবি যুক্তি দিচ্ছে। বুঝিয়েও কিছু হচ্ছে না। এই দলে human physiology তে M.Sc করা high school শিক্ষিকাও রয়েছেন। আছে আমার এক MBBS 1st year (midnapur mc) পড়ুয়া বন্ধুও।
সত্যি covid আমাদের বুঝিয়ে দিল বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানমনস্কতা দুটো প্রায় বিপরীত মেরুতে রয়েছে।
Sir,
এই লেখা পরার পর একটা প্রশ্ন মনে আসছে। এই যে বলা হচ্ছে, হলুদ, আদা, রসুন, লেবু, Zn, Vitamin-C যুক্ত খাবার, অর্থাৎ যে সব খাবারে ph level বেশি সেসব খদ্যতালিকায় থাকলে imunity power বাড়ে, সেটা কতটা সঠিক তথ্য?
আরো এক্টা ❓ গরম জল কি সত্যিই কার্যকর?
এভাবে ‘করোনার দিনগুলি’ শেষ করবেন না। করোনা কিছু টা শেষ করে শেষ করুন। জানি রোজনামচা র একঘেয়েমি আছে।