গোনা ছেড়ে দিয়েছি। মাঝেমাঝেই ফোন পাচ্ছি, ‘ডাক্তারবাবু, করোনার রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। কি করব?’
খবর নিচ্ছি জ্বর কমেছে কিনা। তাঁর কোন শারীরিক অসুবিধা আছে কিনা। সুগার, প্রেশার, হার্টের সমস্যা বা অন্য কোন মর্বিডিটি আছে কিনা।
সারাদিন রোগী দেখি। সকলকেই রাত সাড়ে নটার পর ফোন করতে বলছি। দেড় ঘন্টা ধরে প্রায় জনা কুড়ি রোগীর সাথে কথা বলছি। যাঁরা আজকে পজিটিভ হয়েছেন তাঁদের জিজ্ঞাসা বেশি। পুরনো রোগীদের জিজ্ঞাসা কম।
একটাই ভালো দিক অধিকাংশ রোগী সামান্য সিম্পটোম্যাটিক। বাড়িতেই থাকছেন। তবে অনেককেই হোম আইসোলেশনের নিয়ম কানুন বলতে গিয়ে বিব্রত হচ্ছি।
একজন ভ্যান চালান। তাঁর করোনা ধরা পড়েছে। তিনি বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, আমাদের তো একটাই ঘর। দুটো বাচ্চা। কি করবো?’
বললাম, ‘তাহলে কোথাও ভর্তি হয়ে যান।’
তিনি বললেন, ‘দেখছি, কি করা যায়।’ ফোন কেটে দিলেন।
মধ্যমগ্রাম পৌরসভার উদ্যোগে একটি সেফ হোমের ব্যবস্থা হচ্ছে। এটি তাড়াতাড়ি চালু হলে ভালো হয়। তাতে এইসব নিম্নবিত্ত মানুষদের বড্ড সুবিধা হবে। তাঁদের বাড়ির লোকজন সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে পারবেন।
আরও একটা সমস্যা, অধিকাংশ মানুষই কোভিড টেস্ট করাতে চাইছেন না। একজন মধ্যবয়স্ক রোগীর জ্বর কমছে না। তাঁকে বললাম, ‘আমি তো চারদিন আগেই টেস্ট করাতে বলেছিলাম। করান নি কেন?’
‘ডাক্তারবাবু, অত পয়সা নেই। মিউনিসিপ্যালিটি হাসপাতালে খবর নিয়েছিলাম। দুহাজার টাকার বেশি খরচ। একজনের প্রাইভেট গাড়ি চালাতাম। লকডাউন শুরু হওয়ার পরেই চাকরি চলে গেছে।’
‘তাহলে সরকারি জায়গা থেকে করান। বারাসাত বা ঘোলা হাসপাতাল।’
ভদ্রলোক মাথা নীচু করে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, ভাড়া বাড়িতে থাকি। করোনা ধরা পড়লে বাড়িওয়ালা বার করে দেবে।’
অতি উৎসাহী কিছু কিছু জ্বর ও গলাব্যথার রোগীর দাবি, ‘ডাক্তারবাবু, একবার টর্চ দিয়ে গলাটা দেখলেন না?’
তাঁদের বলছি, ‘মাফ করবেন। এ সময় গলার মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিতে পারব না।’
‘ইস, আপনি ডাক্তার হয়ে এতো ভয় পাচ্ছেন?’
হাসিমুখেই জানাচ্ছি, ‘দেখুন, সাহস ও দুঃসাহস যেমন এক নয়; ভয় ও মুর্খামি দুটোর মধ্যেও পার্থক্য আছে।’
নিজের সুরক্ষার জন্য বাড়াবাড়ি করছি না। কিন্তু সবসময় দুটো মাস্ক ব্যবহার করছি। নীচে একটি সার্জিক্যাল মাস্ক এবং উপরে N95। কোনোভাবেই রোগী দেখার সময় হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করছি না। সে যতই নাক চুলকাক, কান কট কট করুক। আর এইটুকু সুরক্ষার জোরেই শতাধিক করোনা রোগীর সংস্পর্শে এসেও এখনো করোনা আক্রান্ত হইনি।
অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। সারাদিন রোগী দেখে, রাত দশটায় স্নান করে, ফোন পর্ব মিটিয়ে, খাওয়া-দাওয়া সেরে, একলা ঘরে খাতা-কলম নিয়ে বসেছি; এমন সময় কলিং বেল বাজলো। ঘড়ি দেখলাম। রাত ঠিক বারোটা। অত্যন্ত বিরক্তিকর ব্যাপার। এমনিতেই সারাদিনে চৌদ্দ ঘণ্টা রোগী দেখেছি। তার উপর আমার নিজের যে ঘন্টাখানেক সময় সেটাতেও যদি রোগীরা হামলা করতে থাকে, তাহলে মন মেজাজ ভালো রাখা মুশকিল। তাছাড়া এখন রোগী দেখা মানেই জামা কাপড় পাল্টাও, হাত মুখ ধোও।
গোমড়া মুখে দরজা খুললাম। গেটের সামনে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। এক ভদ্রলোক ঘোরাঘুরি করছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি হয়েছে?’
বাড়ির লোকটি বললেন, ‘রোগীর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ডাক্তারবাবু।’
‘কখন থেকে হচ্ছে?’
‘সেই সকাল থেকেই।’
‘তা এই মাঝরাত্রে আনার সময় পেলেন।’
‘দিনের বেলায় আনার উপায় ছিল না ডাক্তারবাবু।’
বললাম, ‘কেন? রোগী কি জঙ্গী টঙ্গী নাকি?’
ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন, ‘রোগীর একাশি বছর বয়স। আমার মা। জঙ্গী কি করে হবেন। তবে এই বয়সে তিনি রোগের জন্য পাড়া-প্রতিবেশী চোখে অপরাধী হয়ে গেছেন। ওনার করোনা হয়েছে।’
আমি বললাম, ‘এভাবে একজন করোনা রোগী নিয়ে আপনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘আমারও করোনা হয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তাই আমার আর ভয় নেই। মায়ের অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমছে। প্রায় ৮০%। কিন্তু ভর্তি করতে চাইছি না। হাসপাতালে ভর্তি করলে কেউ নাকি বাঁচেনা। তার থেকে যা হোক বাড়িতেই হোক।’
অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তাঁকে কাছাকাছি কোভিড হাসপাতলে পাঠালাম।
তবে এগুলি ছোটখাটো সমস্যা। আমার প্রধান সমস্যা মেয়ে দুজনকে কাছে না পাওয়া। একই বাড়িতে থাকছি। অথচ মেয়েদের সাথে খেলতে পারছি না। ছোট মেয়ে রাণী আমার পাশে শুতো। নানারকম আজগুবি গল্প বলতাম। অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে শুনতো। গল্প বলতে বলতে আমি আগে ঘুমিয়ে পড়তাম। পেটে খোঁচা মেরে জাগিয়ে দিতো। ‘গল্প শেষ হয়নি বাবা। ঘুমাচ্ছ কেন? গল্প বলো বাবা।’
যবে থেকে রোগীদের করোনা ধরা পড়তে শুরু করেছে, তবে থেকেই আমি আলাদা। তাও মাসখানেক হতে চলল। মাস্ক পরে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে মাঝে মাঝে একটু গল্প-স্বল্প হয় বটে; কিন্তু তাতে মন ভরে না। সানাই-এর সাথে আর লুডো খেলা হয় না। ও এখন একা একাই মোবাইলে লুডো খেলে। আমার এই একলা থাকা সমস্যার সমাধান কবে হবে বলা মুশকিল।
তবে সব খারাপ কিছুর মধ্যেও একটা ভালো দিক থাকে। মহামারী আমার দুই মেয়েকে অনেক স্বাবলম্বী করে তুলেছে। দিন কয়েক আগে এক রাতে দুই বোন আমাকে ডাকলো, ‘বাবা, দেখে যাও কি করেছি।’
আমি ওদের পিছু পিছু দেড় তলার ঘরে গেলাম। দুই বোন মিলে ঝুলন সাজিয়েছে। বালি, মাটি ইত্যাদি ব্যবহার করার অনুমতি পায়নি। তবুও তারা হতোদ্যম হয়নি।
অনেক ধন্যবাদ স্যার। সুস্থ্য থাকবেন….