অনেকদিন বাদে করোনার দিনগুলির স্মৃতি ফিরে আসছে। রাতে চেম্বার সেরে ঘরে ফেরার পর রোজই দু-তিনটে ফোন পাচ্ছি, ‘ডাক্তারবাবু, মানে ইয়েটা করতে দিয়েছিলেন না… ওটা পজিটিভ এসেছে। কী করব?’
আজ একজন ফোন করলেন। তিনি স্কুল শিক্ষক। স্ত্রীকে জ্বর নিয়ে দেখাতে এসেছিলেন। করোনা ধরা পড়েছে। সব কথাবার্তা শেষ হওয়ার পর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার বাবা- মা দুজনের বয়সই সত্তরের কাছাকাছি। একই বাড়িতে থাকেন। ওঁদের কী আগামীকাল করোনার ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে। করোনার ভ্যাকসিন দিয়ে নিলে ওঁদের আর করোনা হবে নাতো?’
বললাম, ‘এতোদিন কী করছিলেন? ঘুমাচ্ছিলেন?’
‘আসলে ডাক্তারবাবু, ভ্যাকসিন নিয়ে অনেকে মারা যাচ্ছে তো। তাই দিতে সাহস পাইনি। আমারোতো ভোটকর্মী হিসাবে নেওয়ার সুযোগ আছে। এতোদিন নিতে সাহস পাইনি। ভাবছি কালকে নিয়ে নেব।’
অবাক হয়ে বললাম, ‘ভ্যাকসিন নিয়ে মারা যাচ্ছে এই তথ্য পেলেন কোথায়? পশ্চিমবঙ্গে প্রতিদিন গড়ে তিনলক্ষ বয়স্ক মানুষ ভ্যাকসিন পাচ্ছেন। পার্শ্বপতিক্রিয়া হলে লোকজন তো ডাক্তারের কাছে আগে আসবেন। সেরকম কেউই তো আসছেন না।’
ভ্যাকসিন নিয়ে সবার মধ্যে এতো ভয়, অথচ করোনা নিয়ে কারও মন কোনো ভয় আছে বলে মনে হচ্ছে না। সব দলই ভোটের আগে জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য ইশতেহারে দারুণ দারুণ কথা লিখেছেন। কিন্তু সেসব দলের মিছিল, জনসভা দেখলেই টের পাওয়া যায়, ওই কথা গুলি কেবল কথার কথা। নিশ্চিতভাবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যখন বাংলায় ঢুকে পড়েছে, তখনও তারা জনসভায়, মিছিলে ভিড় বাড়াতে ব্যস্ত। যেখানে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্কের ব্যাবহার ইত্যাদির কোনো অস্তিত্ব নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে নীতি- আদর্শগত নানা রকম পার্থক্য আছে, কিন্তু এই একটা ব্যাপারে তারা মোটামুটি একই রাস্তায় হাঁটছে।
যাঁরা জনপ্রতিনিধি হতে চলেছেন, প্রচারের সময় তাঁদেরও অনেকের মুখে মাস্ক নেই। দুঃখের ব্যাপার আমাদের মতো খুপরীজীবী চিকিৎসকদের থেকে এনাদের কথাকে মানুষ অনেক বেশি গুরুত্ব দেন। জনসভাগুলিতে পারস্পরিক খিস্তি-খেউরে মাতার আগে তাঁরা যদি একবারও সকলকে মাস্ক পরার জন্য এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য আবেদন করতেন, তাহলে সচেতনতা অনেক বাড়তো।
তাঁর বদলে তাঁরা যেটা করেছেন, সেটা সব রাজনৈতিক দলই বছরের পর বছর ধরে করে এসেছে। ভোটের প্রচারে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ঘুষখোর ও রাক্ষস হিসাবে তুলে ধরেছে এবং স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যাবতীয় ব্যার্থতার দায় তাঁদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে।
আগে এসবে রাগ হতো। আজকাল আর রাগটাগ হয়না। সব ব্যাপারেই কেমন উৎসাহ হারিয়ে ফেলছি। প্রশংসা শুনলে, হাততালি দিলে বা থালা বাজালে, এমনকি হেলিকাপ্টার থেকে পুষ্প বৃষ্টি করলেও উত্তেজনা হয় না। সবকিছুই কেমন সাজানো সাজানো মনে হয়।
শ্রমজীবী মানুষেরা অনেকেই জিজ্ঞাসা করছেন, ‘ডাক্তারবাবু, ভোটের পরে নাকি লকডাউন হবে? সত্যি…? তাহলে একেবারে শেষ হয়ে যাবো?’
কী উত্তর দেব? সত্যিই যদি তাই হয়, তাহলে আবার সেই পরিযায়ী শ্রমিকদের লংমার্চ, মানুষের হাহাকার, হাততালি, পুষ্পবৃষ্টি- সব মিলিয়ে এক অসহ্য নাটক। যাক, সেসব নিয়ে ভোটের পর ভাবা যাবে, আপাতত এই বিজেপির নির্বাচনী প্রচারের ভিডিওটি দেখুন। সৃজনশক্তির কতটা দৈন্য ঘটলে এমন একটি জিনিস বানানো যায়, সেটা গবেষণার ব্যাপার।