লড়াই করে বাঁচতে চাই
আমার চেম্বারে প্রায় কোনো রোগীই গাড়ি করে আসেন না। বেশিরভাগই আসেন পায়ে হেঁটে। দু’চারজন টোটো বা রিক্সা ভ্যানে। রোগীর অবস্থা খুব খারাপ হলে গোটা অটো রিজার্ভ করে।
এনাদের দেখতে দেখতে আমি এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি, মাঝে মাঝে প্রাইভেট গাড়িতে করে রোগী চলে এলে অস্বস্তিতে পরে যাই। আমার রোগীদের আমি চিনি। তাঁরা ওষুধ পত্রের জন্য কতটা খরচা করতে পারবেন, কোন টেস্ট লিখলে করতে পারবেন সেটা আমি জানি।
এসব আমি অনেক ঠেকে শিখেছি। ওষুধে সুগার কমছিল না, এমন একজনকে ইনসুলিন লিখলাম। ডোজ বাড়িয়েই যাচ্ছি, তবুও সুগার কমে না। অবশেষে একদিন জিজ্ঞাসাবাদ করে জানলাম তাঁর বাড়িতে ফ্রিজই নেই। ইনসুলিন কিনে বাইরে রেখে দেন। তারপর থেকে ইনসুলিন লেখার সময় প্রতিজনকে অন্তত জিজ্ঞাসা করে নিই, ‘বাড়িতে ফ্রিজ আছে তো?’
করোনার সময়েও প্রতিদিন শিখছি। এই সময় অনেক রোগীই দেখাতে আসছেন, যারা এতোদিন চেম্বারে গিয়ে ডাক্তার দেখাননি। হাসপাতালেই দেখাতেন, হাসপাতালের থেকে বিনামূল্যে ওষুধ পেতেন। অনেকেই দেখানোর পর বলছেন, ‘ডাক্তারবাবু, ওষুধ দেবেন না?’
করোনা নিয়ে কতো গবেষণা চলছে। কতো রকমের টেস্ট। বুকের সিটি স্ক্যান, রক্তের সি আর পি, ডি- ডাইমার, ইন্টারলিউকিন ৬, ফেরিটিন। মুশকিল হচ্ছে টেস্টগুলির যা খরচ তাতে চট করে লিখে দেওয়া মুশকিল। এক বাড়িতে পাঁচজনই আক্রান্ত। তাঁদের আয়ের একমাত্র উৎস ফুটপাতে জুতোর দোকান। এমনিতেই লকডাউন লকডাইন খেলায় তাঁদের আয়ের উৎস তলানিতে। তাঁর উপর পাঁচজনই এখন জ্বরে ঘর বন্দী। বয়স্ক একজন মহিলার অবস্থা ভালো নয়। পরীক্ষা নিরীক্ষা দরকার। দুই দিন ধরে হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে কোভিড টেস্টই করতে পারেন নি।
পালস অক্সিমিটার জোগাড় করে নিয়মিত অক্সিজেন মাপা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। বয়স্ক মহিলার ছেলে পরপর দুদিন এলেন। বক্তব্য একই, ‘ডাক্তারবাবু, মা একেবারে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। বিছানাতেই প্রস্রাব পায়খানা করে ফেলছেন।’ রোগীকে আস্তে আস্তে খারাপ দিকে এগিয়ে যেতে দেখলে ডাক্তারদের বড় অসহায় লাগে। অসহায়তা থেকে রাগের জন্ম হয়। আমি অকারণেই ওনার ছেলেকে ঝাড় দিলাম। বললাম, ‘এতোদিনে সামান্য একটা কোভিড টেস্টের রিপোর্ট করে উঠতে পারলেন না, কী করে আশা করেন মা সুস্থ হয়ে উঠবেন? এখনও বাঁচাতে চাইলে মাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।’
ভদ্রলোক আজ এসেছিলেন। বলে গেলেন, ‘মাকে বারাসতে ভর্তি করেছিলাম। সেখানে করোনা ধরা পড়েছে। সেখান থেকে সাগর দত্তে পাঠিয়ে দিয়েছে। তবে মায়ের অবস্থা এখনও ভালো না।’
খবরটা শুনে একটু শান্তি হলো। যাক, উনি অন্তত চিকিৎসাটুকু পাচ্ছেন। এরপর ভালো হন, খারাপ হন সেটা উপরওলার ইচ্ছে। তবে এই একবিংশ শতাব্দীর মহামারীতে বহু মানুষ একেবারেই বিনা চিকিৎসায় মারা পড়ছেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার এতটা উন্নতি স্বত্বেও সেসব খবর আমাদের কাছে পৌঁছায় না।
অথচ অবস্থাটা অন্যরকম হতে পারত। অন্তত হওয়াটা উচিৎ ছিল। ফেব্রুয়ারীর প্রথমদিকেই টীকা দেওয়া শুরু হয়ে গেছিল। চিকিৎসক সংগঠন গুলি তখন থেকেই দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে বারবার সকলকে সতর্ক করছিল। সেসময় যদি সরকার তার সমস্ত শক্তি নিয়ে সাধারণ মানুষের টীকাকরনের কাজে ঝাপিয়ে পড়তো তাহলে এই দিন দেখতে হতো না। হয়তো যারা মারা গেছেন, তাঁরা অনেকেই বেঁচে থাকতেন।
টীকা নেওয়ার পর অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে তাঁদের সমস্যা অন্যদের থেকে কম হচ্ছে। প্রত্যেক জ্বরের রোগীকেই জিজ্ঞাসা করছি, ‘আপনি কী টীকা নিয়েছেন?’ রোগী হ্যাঁ বললে অনেকটা স্বস্তি বোধ করছি। তবে দুঃখের বিষয় খুব কম মানুষই হ্যাঁ বলছেন।
চারিদিকে অদ্ভুত এক ডামাডোল চলছে। সরকার আংশিক লকডাউন ঘোষণা করেই খালাস। লোকাল ট্রেন বন্ধ। লোকেরা সংক্রণের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে বাসে ঝুলে ঝুলে বিপজ্জনক ভাবে কলকাতা যাচ্ছেন। অনেকে আবার সাইকেল বের করেছেন। রোজ ৫০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে মধ্যমগ্রাম থেকে বৌবাজার, বড়োবাজার যাতায়াত করছেন। পেটের দায় বড়ো দায়।
তবে এর মধ্যেও আশার আলো আছে। প্রচুর ছেলে-মেয়ে মহামারীর বিরুদ্ধে এক অসম লড়াইয়ে নেমেছেন। রোগীদের বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিচ্ছেন। নিজের বাড়িতে খাবার রান্না করে রোগাক্রান্তদের বাড়ি বাড়ি পৌছে দিচ্ছেন। অসুস্থ ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। আজ এক ডাক্তারবাবুর সাথে কথা হলো। ওনার ছেলে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ে। মানে ভর্তি হয়েছে, করোনার দয়ায় একবছরের মধ্যে কলেজ যাওয়ার সুযোগ পায়নি। ওনার সাথে রাত দশটা নাগাদ ফোনে কথা হচ্ছিল। উনি জানালেন, ‘ছেলে এখনও বাড়ি ফেরেনি। স্কুটার নিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই অনেকক্ষণ বেড়িয়েছে। কয়েকজন করোনা আক্রান্ত নিম্মবিত্ত পরিবারে রোজ রাতের খাবার পৌছিয়ে দেয়।’
রোজা চলাকালীন আর একটি ছেলের বাবার করোনায় মৃত্যু হয়েছে। তারপর থেকেই সে প্রায় মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। দিনরাত্রি এক করে ছুটে চলেছে। কারও জ্বর হয়েছে শুনলেই তাঁকে জোর করে বাড়ি থেকে তুলে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে আসছে। তাঁদের যাবতীয় সমস্যার খেয়াল রাখছে।
কয়েকজন দূর্বল চেহারার যুবক, প্রেসক্রিপশন বা জ্বরের রোগী নিয়ে আসছেন। প্রথমেই বলছেন, ‘ডাক্তারবাবু, আমি রেড ভলিন্টিয়ার্স।’ বলার সময় তাঁদের চেহারা থেকে দৈনন্দিন জীবন যাপনের সব মালিন্য উধাও হয়ে যাচ্ছে। চোখ গর্বে ঝকমক করে উঠছে। স্যালুট তাঁদের সকলকে, যারা এই অস্থির সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষকে ভরসা যোগাচ্ছেন।
যদিও এই দায়িত্ব নেওয়ার কথা সরকারের ছিল। কতিপয় মানুষের প্রাণপণ প্রচেষ্টা কখনোই ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্যের’ লক্ষ্যকে সফল করে তুলতে পারে না। তবু আমাদের লড়তে হবে। প্রত্যেককে এই মহামারীর বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে হবে। যে যেখানে যেভাবে লড়ছে, তাঁদের সাথে যেন একাত্ম বোধ করতে পারি। মৃত্যু ভয়ের চেয়েও ভয়ঙ্কর একাকীত্বের ভয় যেন বড় না ওঠে।