২০২৪-এর ২১শে ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্যের বৃত্তে-ডক্টরস’ ডায়লগ-প্রণতি প্রকাশনীর উদ্যোগে ভাষা দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানে দু’চার কথা বলার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। এই সুযোগ দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই সংগঠকদের। বিশেষত সার্থকনামা ডাক্তার পুণ্যব্রত গুণকে।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আমার বয়স ছিল দুই বছর। তখন আমি পূর্ব পাকিস্তানে থাকলেও ভাষা আন্দোলনের সেই স্মৃতি আমার মনে নেই। থাকার কথাও নয়। কেননা পাঁচ বয়স বয়সের আগের স্মৃতি আমরা মনে রাখতে পারি না। অমর একুশের যে স্মৃতি আমার স্মৃতিপটে আঁকা আছে তা প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। ভাষা সৈনিক সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর এবং আরও অনেক শহিদের রক্তে বাঙালি সেদিন যে জাতীয়তাবাদের বীজ বুনেছিল তাই পরবর্তী কালে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল এবং বাংলাভাষাকে সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষায় পরিণত করেছিল। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। আজ সেই দিন। এই সুযোগে বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সেই জানা-অজানা শহিদদের জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। সেইসঙ্গে শ্রদ্ধা জানাই অসমের বরাক উপত্যকার ভাষা শহিদদেরও।
এবার চলে আসি মূল আলোচনায়। বাংলায় চিকিৎসাবিজ্ঞান চর্চা। জানলে আশ্চর্য হবেন, ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে যখন কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন মেডিকেল কলেজে পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যম ছিল বাংলা। ১৮৩৫ থেকে ১৮৫৩ – এই উনিশ বছর বাংলাতেই পাশ্চাত্য চিকিৎসা বিদ্যা পড়ানো হতো। ১৮৫৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ডাক্তারি শিক্ষার মাধ্যমটা পালটে হয়ে গেল ইংরেজি। তা সত্ত্বেও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় চিকিৎসাবিদ্যা রচনায় অভূতপূর্ব জোয়ার এসেছিল। বিনয়ভূষণ রায়ের গ্রন্থে প্রায় সাড়ে সাতশো বাংলা ডাক্তারি বইয়ের কথা উল্লিখিত আছে।
দেশ স্বাধীন হয়েছে ৭৫ বছর পেরিয়ে গেল, সংবিধানে আঞ্চলিক ভাষায় ডাক্তারি অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার অধিকার থাকলেও ডাক্তারি চর্চার মাধ্যমটা কিন্তু ইংরেজিই রয়ে গেল। কেননা বহু ভাষাভাষীর দেশ ভারতের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হলো ইংরেজি। তাছাড়া আন্তর্জাতিক ভাববিনিময়ের মাধ্যমও ইংরেজি। বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় ডাক্তারি পাঠ্য বইয়ের অপ্রতুলতাও একটা বড়ো অজুহাত হিসাবে দেখানো হলো। প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা কিন্তু বাংলা। সেখানেও একই চিত্র। বাংলায় উপযুক্ত পাঠ্য বইয়ের অভাব এবং পরিভাষার অপ্রতুলতাকে বড়ো কারণ হিসাবে দেখানো হলো। অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও সেই সমস্যার সমাধান কিন্তু আজও করা যায়নি। অথচ আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি, ইউনানি তো বাংলাতেই অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করা হতো এবং এখনো হচ্ছে। তা যদি সম্ভব হয়ে থাকে তাহলে পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতি কেন অসম্ভব ? সমস্যার মূল তাহলে কোথায় ? বাংলায় চিকিৎসাবিজ্ঞান চর্চার মূল সমস্যাগুলিকে এবার আমি সংক্ষেপে আলোচনা করব।
সাধারণ সমস্যা
১. মানসিকতার সমস্যা : দীর্ঘ কাল ইংরেজের ঔপনিবেশিক শাসনে থাকার ফলে ইংরেজি ছাড়া গতি নেই এমন একটা ঔপনিবেশিক মানসিকতার শিকার হয়েছে দুই বাংলার মানুষই। এমনই আর একটি মানসিকতা হলো চাকরি ছাড়া গতি নেই। এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা এবং পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই চিকিৎসা বিদ্যার চর্চা হয় ইংরেজির মাধ্যমেই। যেহেতু চিকিৎসা বিদ্যার অগ্রগতি মূলত ঘটছে পাশ্চাত্যে সেহেতু ইংরেজির ডিঙি নৌকা বেয়েই সেই খবর আমাদের কাছে এসে পৌঁছাচ্ছে। আবার এটাও ঠিক যে পৃথিবীর অনেক দেশেই ডাক্তারি পড়া ও পড়ানো হয় মাতৃভাষায়। যেমন চীন, জাপান, জার্মানি, স্পেন, রাশিয়া। জাপান একটা মধ্যপন্থা বের করে নিয়েছে, পরিভাষাগুলি থাকছে ইংরেজি কিন্তু পড়াশুনাটা হচ্ছে জাপানি ভাষায়।
২. পরিভাষার সমস্যা : প্রতিটি পরিভাষার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট অর্থ পোরা থাকে। বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে সেই বিশেষ অর্থেই সেই বিশেষ পরিভাষা ব্যবহৃত হয়। ইংরেজরা এদেশে আসার আগে ভারতের একটা নিজস্ব চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল। চরকসংহিতা ও সুশ্রুতসংহিতার মাধ্যমে সেই আয়ুর্বেদ চর্চা হতো সংস্কৃত ভাষায়। বাংলায় আয়ুর্বেদ চর্চা হতো সংস্কৃত এবং বাংলার মাধ্যমে এবং এখনও তাই হয়। আয়ের্বেদে ছিল প্রচুর পারিভাষিক শব্দ। দুশো বছরের ইংরেজি চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার ফলে সেসব পরিভাষা অনেক হারিয়ে গেছে, যারা টিকে ছিল দীর্ঘকালীন অব্যবহারে তারাও তলিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। তাছাড়া সংস্কৃত আজ মৃত ভাষা। ফলে আয়ুর্বেদিক পরিভাষাগুলি আজকের প্রেক্ষিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তাহলে পরিভাষা নির্মাণের উপাদান কি হবে ? জীবন্ত ভাষা প্রতিনিয়ত পালটায়, কিন্তু মৃত ভাষা পালটায় না। পরিভাষার চাই একটা স্থায়ী রূপ, পরিভাষা পালটালে চলে না। এই কাজে ইংরেজি ভাষা পরিভাষা নির্মাণ করছে মৃত ভাষা গ্রিক ও লাতিন থেকে। আমাদেরও এই কাজে মৃত ভাষা সংস্কৃতকে কাজে লাগাতে হবে। সংস্কৃতের আছে প্রায় এক কোটি শব্দভান্ডার। এর মধ্যে বেশ কিছু শব্দ বাংলার আটপৌরে শব্দ হয়ে গেছে। পূর্ব পরিচিত শব্দ সহযোগে গঠিত নতুন পরিভাষার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে, অর্থবোধেও ক্লেশ আসে না। তাই অপেক্ষাকৃত পরিচিত সংস্কৃত শব্দ দিয়ে নতুন পরিভাষা বানালে তা সহজে পালটাবে না এবং পরিভাষার গ্রহণযোগ্যতাও বাড়বে বলে আমার বিশ্বাস। একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটাকে সহজ করার চেষ্টা করছি। গ্রিক শব্দ trophe-এর সংস্কৃত প্রতিশব্দ পুষ্টি। বাঙালির খুব পরিচিত শব্দ। পুষ্টি শব্দ দিয়ে অনেক প্রতিশব্দ নির্মাণ করা যায় যা বাঙালির কাছে অর্থবোধ্য এবং গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হওয়া স্বাভাবিক। যেমন atrophy = অপুষ্টি, dystrophy = অপপুষ্টি, trophonosis = পুষ্টিবিকার, trophrcyte = পুষ্টিকোষ, trophic = পৌষ্টিক ইত্যাদি।
৩. নতুন শব্দ নির্মাণের সমস্যা : প্রত্যেক ভাষাতেই নতুন শব্দ তৈরি করার নিয়ম-কানুন আছে, রীতি-নীতি আছে। বাংলা ভাষাতেও আছে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে উনবিংশ শতকে প্রচুর চিকিৎসা পরিভাষা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বাঙালি তাদের গ্রহণ করেনি এবং ব্যবহার করেনি বলে তারা হারিয়ে গেছে। কেন বাঙালি তাদের ব্যবহার করল না ? হয়তো এসব পরিভাষা তাদের কাছে কঠিন প্রতিভাত হয়েছিল। অনেকেই সহজ পরিভাষার পক্ষে মত দেন। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় একবার আমায় বলেছিলেন হাট-মাঠ-ঘাটের মানুষের মুখের ভাষাগুলিকে তুলে এনে পরিভাষার মর্যাদা দেওয়ার কথা। দুটো দৃষ্টান্ত দিয়ে কবির কথাকে সহজ করছি। মলাশয়ের স্খলন কে গ্রাম বাংলায় বলা হয় হারিশ এবং স্তন্যদায়ী মায়ের স্তনের ফোড়াকে মা-ঠাকুমারা বলেন ঠুনকো। সুন্দর, সহজ এবং গ্রহণযোগ্য পরিভাষা। শব্দ দুটির ব্যবহার আছে বলেই পরিচিতি আছে, এবং পরিচিতি আছে বলেই সহজতা আছে। কিন্তু সব অঙ্গের স্খলনকে তো আর হারিশ দিয়ে চিহ্নিত করা যায় না, দেহের সব অঙ্গের ফোড়াকেও ঠুনকো নামকরণ করা যায় না। এই ধরনের নামকরণের জন্য সাধারণ সূত্রগুলিকে খুঁজে নিতেই হয়। তা না হলে বিজ্ঞানচর্চা চলে না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ডাক্তারি বিদ্যায় -একটোমি (-ectomy), -ওটোমি (-otomy) এবং -ওসটোমি (-ostomy) নামক তিনটি শব্দ আছে যা দিয়ে হাজার হাজার চিকিৎসা পরিভাষা নির্মাণ করা হয়। এই শব্দ তিনটির বাংলা যদি যথাক্রমে -কর্তন, -ছেদন এবং -মুখায়ন করা হয় তাহলে মিটে যায় কয়েক হাজার পরিভাষা নির্মাণের সমস্যা।
৪. গ্রহণযোগ্যতার সমস্যা : এই যে তিনটি প্রতিশব্দ নির্মাণ করা হলো তা কী আপনি পরিভাষা হিসাবে গ্রহণ করবেন ? আপনি তা নাও করতে পারেন। কারণ প্রতিশব্দগুলির নির্মাতা বিখ্যাত ব্যক্তি নয় এবং প্রতিষ্ঠিত ভাষাবিদ নয়। অথচ এই পরিভাষা যদি পশ্চিমবঙ্গের বাংলা আকাদেমি বা ঢাকার বাংলা একাডেমি নির্মাণ করতেন তাহলে নিসন্দেহে তার মান্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা বাড়ত। প্রাগুক্ত প্রতিশব্দ যখন ভাষা নিয়ামক সংস্থা কর্তৃক সম্মিলিত সম্মতি পায় তখনই সেটা পরিভাষার মর্যাদা লাভ করে। গ্রহণযোগ্যতার সমস্যা মিটাতে আমাদের যেমন গ্রহণমুখী আনুগত্য চাই তেমন চাই ভাষা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির আরও সক্রিয়তা। এই প্রসঙ্গে ইজরায়েলের দৃষ্টান্ত টানা যায়। আমাদের দুই বছর পরে, ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে, স্বাধীনতা লাভ করে ওরা গড়ে তুলেছে ভাষা নিয়ামক সংস্থা ‘হিব্রু একাডেমি’। এই একাডেমি প্রতি বছর ২,০০০ বিদেশি শব্দকে হিব্রুতে পরিবর্তিত করে সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। এই ভাবে নিয়ন্ত্রিতভাবে মৃতভাষা হিব্রুকে ওঁরা পুনরুজ্জীবিত ও সমৃদ্ধ করে তুলছে।
৫. প্রমিতকরণের সমস্যা : পশ্চিমবঙ্গে আছে বাংলা আকাদেমি, বাংলাদেশে আছে বাংলা একাডেমি। হালে ত্রিপুরাতেও তৈরি হয়েছে ত্রিপুরা বাংলা আকাদেমি। এগুলি সবই ভাষা নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ভাষার পরিকল্পিত বিকাশে দিশা দেখানোই এদের কাজ। বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা সম্মিলিতভাবে পরিভাষা নির্মাণ করবেন এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে নির্মিত প্রতিশব্দগুলিকে গ্রহণ-বর্জন-পরিমার্জনের মাধ্যমে মান্যায়িত করবেন এটাই ভাষাপ্রেমীদের আশা।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
১. বাংলায় চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার সাধারণ সমস্যাগুলি আমি এতক্ষণ ধরে আলোচনা করলাম। এবার আমি আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে সমস্যাগুলির পর্যালোচনার চেষ্টা করব। অনুরোধ করি, এই পর্যালোচনাকে আত্মপ্রচার বলে ভাববেন না। স্নায়ুশল্যবিদ্যার প্রশিক্ষণ শেষ করে বিলেত থেকে ফেরার পরে এই কাজের সূত্রপাত হয় গত শতাব্দীর শেষ দশকের শুরুতে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বেশ কিছু জনবোধ্য প্রবন্ধ এবং স্নায়ুতন্ত্রের ওপর কয়েকটি সহজবোধ্য পুস্তিকা রচনার মধ্য দিয়ে আমার এই পাগলামির সূত্রপাত হয়। একে একে প্রকাশিত হয় মৃগীরোগ ও তার চিকিৎসা (১৯৮৩), কোমরে ব্যথা (১৯৯৪), মাথাব্যথা (১৯৯৬), স্নায়ুতন্ত্রের রোগ (১৯৯৭), বিকল্প চিকিৎসা (১৯৯৭), ঘাড়ে ব্যথা (১৯৯৯), স্মৃতি বিস্মৃতি (২০০০)। শেষোক্ত বইটিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সত্যেন্দ্র পুরস্কার দেয় ২০০২ সালে।
এসব বইগুলি রচনা করার সময় থেকেই বাংলা চিকিৎসা পরিভাষার অভাব অনুভব করি এবং একটি পরিভাষা সংকলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। দীর্ঘ দশ বছরের প্রচেষ্টায় তিলে তিলে গড়ে ওঠে চিকিৎসা পরিভাষা অভিধান (২০০১)। আমার এই একক প্রচেষ্টায় অকুণ্ঠ উৎসাহ এবং সহায়তা দিলেন অধ্যাপক শিবনাথ চট্টোপাধ্যায়, অশোকেন্দু সেনগুপ্ত, সুজিত ঘোষ, বন্ধুবর দিলীপ ঘোষ, নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায়, সহকর্মী ডা. মনীষা দেবনাথ এবং আরও অনেকে। উক্ত অভিধানটি প্রকাশনার অনুরোধ নিয়ে বাংলা আকাদেমি এবং এশিয়াটিক সোসাইটির দরজায় বহুদিন ঘোরাঘুরি করি। বাংলা আকাদেমি অক্ষমতা জানালেও এশিয়াটিক সোসাইটি বইটি প্রকাশে আগ্রহ প্রকাশ করে। শেষ অবধি জ্যোতিপ্রকাশ চাকী এবং অভীক সরকারের বদান্যতায় বইটি ২০০১ সালে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয় এবং ২০০৬ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার পায়। দীর্ঘ ১৪ বছর বাদে ২০১৪ সালে বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয়। এই পরিভাষাগুলির ব্যবহারে এপার-বাংলার চিকিৎসক ও লেখকরা কমবেশি অনীহা দেখালেও ওপার-বাংলার জনাব বজলুর রহিম সম্পাদিত মাসিক গণস্বাস্থ্য পত্রিকাটি পরিভাষাগুলিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে পরিচিতির পরিমণ্ডলে নিয়ে আসতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়।
পরিভাষাগুলির প্রায়োগিক যথার্থতা যাচাই করতে আমি নিজেও এগুলিকে প্রয়োগ করতে শুরু করি বিভিন্ন প্রবন্ধে ও চিকিৎসা সংক্রান্ত পুস্তকে। এরপর আমার কলম থেকে একে একে প্রকাশিত হলো ভাষা ও মস্তিষ্ক (২০০২), বিজ্ঞানচর্চায় বাংলা পরিভাষা: ইতিহাস, সমস্যা ও সমাধান (২০০২), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ভাবনা (২০১২), স্নায়ুতন্ত্রের অসুখবিসুখ (২০১৩), স্নায়ুতন্ত্র : জানা অজানা নানান কথা (২০১৫) এবং স্মৃতিশক্তি ও মস্তিষ্ক (২০২০)।
২. বাংলা পরিভাষা নির্মাণ ও বাংলায় চিকিৎসাবিদ্যা রচনার আমাদের পরবর্তী প্রচেষ্টা ছিল চিকিৎসকদের সম্মিলিত ও যৌথ প্রয়াস। সে যুগের অনেক বাংলাপ্রেমী চিকিৎসককে এই কাজে আমরা আমাদের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছিলাম। প্রথম থেকেই এই কাজের সঙ্গে যারা সরাসরি যুক্ত ছিলেন তাদের অনেকেই আজকের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছেন। ২০০২ সাল থেকে ২০১৭ – এই ১৫ বছরের সাধনায় রচিত হলো চিকিৎসাবিজ্ঞানকোষ, যা আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হলো ২০১৭ সালে। আমার সঙ্গে এই কাজে যারা প্রথম থেকেই সরাসরি যুক্ত ছিলেন তারা হলেন ডা. স্থরির দাশগুপ্ত, ডা, পুণ্যব্রত গুণ, ডা. জয়ন্ত দাস, ডা. সুমিত দাশ, ডা, শর্মিষ্ঠা দাশ এবং ডা. শর্মিষ্ঠা রায়। সম্পাদনার কাজে যেসব ডাক্তাররা পরবর্তীতে যুক্ত হয়েছিলেন তাদের দীর্ঘ তালিকা উক্ত গ্রন্থে দেওয়া আছে। দেশ পত্রিকায় গ্রন্থটির বিস্তারিত ইতিবাচক ও সপ্রসংশ পর্যালোচনা হয়েছিল এবং গ্রন্থটি ২০১৮ সালে আনন্দ পুরষ্কারের জন্য মনোনীতও হয়েছিল।
৩. বাংলা পরিভাষা নির্মাণ ও প্রয়োগের আমাদের সর্বশেষ প্রচেষ্টা ‘নার্সিং-এর সহজ পাঠ’ (২০১৭, ২০২২)। দধীচি কমিউনিটি কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ওই কলেজের শিক্ষকমণ্ডলী দ্বারা লিখিত হলেও বইটি জিএনএম ছাত্রীদের কাছেও বেশ সমাদৃত হয়েছে। এই বইয়ে আমরা ইংরেজি পরিভাষাগুলিকে ভাষান্তরিত না করে লিপ্যন্তরিত করেছি মাত্র। ডা. পুণ্যব্রত গুণও এই বইয়ের একটি অধ্যায় লিখেছেন যা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। ইংরেজি পরিভাষাগুলিকে সরাসরি আত্তীকরণের একটি বড়ো সমস্যা আছে। প্রায় দেড় লাখ চিকিৎসা পরিভাষা রাতারাতি বাংলার দেড় লাখের শব্দভাণ্ডারে ঢুকে পড়লে অপরিচিত ও পরিচিত শব্দের অনুপাত দাঁড়াবে ১:১। তাতে ভয় হয়, বাংলা ভাষাটাই না দুর্বোধ্য হয়ে হারিয়ে যায়। হারিয় যাওয়া ভাষার ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত অনেক আছে।
উপসংহার : সারা জীবনের সাধনায়ও বাংলায় চিকিৎসাবিদ্যা চর্চায় দাঁত ফুটাতে পারিনি। তাই এখন ওপার-বাংলার দিকে না চেয়ে থেকে উপায় নেই। আমি পারিনি, হয়তো ওঁরা পারবেন। কেননা বাংলা ওদের শুধু মাতৃভাষা নয়, রাষ্ট্রভাষাও বটে। দুই বাংলার জন্যই ঢাকার প্রতীক প্রকাশনী থেকে এই বছর (২০২৪) প্রকাশিত হলো আমার রচিত আরও বিস্তারিত বাংলায় ‘ডাক্তারি অভিধান’। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমি আজও বিশ্বাস করি, বাংলায় চিকিৎসাবিজ্ঞান চর্চার স্বপ্ন একদিন সফল হবেই।
এখন আর বাংলায় চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে লেখালেখি করি না। হালে প্রকাশিত আমার দুটির গ্রন্থের নাম ‘বাংলার শব্দকথা’ এবং ‘দুই বঙ্গের স্থাননাম’। প্রকাশিতব্য আর একটি গ্রন্থের সম্ভাব্য নাম ‘বাংলায় দেশি শব্দের অভিধান’।
আপনাদের মূল্যবান সময় খরচা করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা ও নমস্কার জানিয়ে আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করলাম।